Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গ

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য কমিশনারকে মনোনয়ন বা নিয়োগ দেওয়ার জন্য কোনো আইন বাংলাদেশে নেই; যদিও সংবিধান মোতাবেক থাকা প্রয়োজন। যেই নিয়মে মনোনয়ন দেওয়া হয়, সেটা গত ছয় বছরের পুরানো একটি রেওয়াজ। যাহোক, আমরা সেই পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করছি না। কমিশনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বলছি যে, কমিশনের সদস্যগণের দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যদি অপসারণ করতে হয়, তার জন্যও আলাদা কোনো আইন নেই। তাঁদের অপসারণের পদ্ধতি হবে ঐ পদ্ধতিটিই যেটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণের জন্য প্রযোজ্য; এটিই সংবিধানের ভাষ্য। অর্থাৎ সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে গুরুত্ব দিয়েছে। শুধু কি গুরুত্ব, ক্ষমতা কি দেয়নি? ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে কিন্তু ব্যক্তিত্বগণ কর্তৃক সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করার প্রবণতা কম, আগ্রহ কম। এই প্রসঙ্গটি আজকের কলামে আলোচনা করবো সবার আগে। তারপরে অন্যান্য দু’চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজকের কলামে আলোচনাটি অসমাপ্ত থাকবে; আগামী সপ্তাহের কলামে সমাপ্ত হবে। 

সবাই জানা ভালো। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ এবং মিডিয়া জগতের প্রতিনিধিগণের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। সংলাপের পরপরই, আমরা দেখতে পেয়েছি, পড়তে পেরেছি সংলাপে আদান-প্রদান করা বক্তব্যগুলো। সংলাপ থেকে বের হয়ে, অংশগ্রহণকারীগণের মধ্য থেকে অনেকেই পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখেছেন, যার মাধ্যমে আমরা অনেকেই অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আমরা উৎসাহিত হয়েছি। ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন তারিখে একাধিক রাজনৈতিক দলও সংলাপে গিয়েছে। তাদের বিষয় যৎকিঞ্চিত সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সকালবেলা, আমরা গিয়েছিলাম নির্বাচন কমিশনে। সেখানে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। নির্বাচন কমিশন যে সাত দফা কর্ম পরিকল্পনা ১৬ জুলাই ২০১৭ জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে, আমরা সবগুলো দফায় আমদের বক্তব্য রাখিনি। আমাদের দৃষ্টিতে যে কয়েকটি বিষয় সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে, আমরা তার উপর বক্তব্য রেখেছি। ঐরূপ উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এক. নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুই. নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং তিন. নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ও পার্লামেন্ট। দেশবাসীর সঙ্গে আমাদের বক্তব্য শেয়ার করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। আজকের কলামে বেশি অংশ এবং আগামী সপ্তাহের কলামে অবশিষ্ট অংশ শেয়ার করবো বলে আশা করি।
নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা শুরু। নির্বাচন কমিশন ধারাবাহিকভাবে সংলাপ করছে, স্টেকহোল্ডারগণের সাথে। রাজনৈতিক দল অবশ্যই অন্যতম স্টেকহোল্ডার। সুষ্ঠু নির্বাচনের সবচে বড় বেনিফিশিয়ারি বা সুবিধাভোগী হন, জনগণ তথা ভোটারগণ। এই প্রক্রিয়ায় মাধ্যম হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈকিত দলগুলো। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় প্রধানতম ক্যাটালিষ্ট বা প্রধানতম নিয়ামক, শক্তি হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। অতএব নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করাটাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সক্ষমতার অনেকগুলোর আঙ্গিক আছে। একটি আঙ্গিক হল আইণগত শক্তি। আরেকটি আঙ্গিক অদৃশ্য কিন্তু অনুভবনীয় যথা: অন্তরের শক্তি বা আন্তরিকতা বা ইচ্ছাশক্তি বা নিয়ত। উভয় আঙ্গিক সম্মিলিতভাবে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতাকে দর্শনীয় করে তোলে বা প্রায়োগিক রূপ লাভ করে। অনেক বিজ্ঞজনই বলেছেন যে বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক আইনগত ক্ষমতা যথেষ্ট, কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট আগ্রহী নয় বা আন্তরিক নয়। রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবের বাইরে গিয়ে স্বাধীন চেতনা নিয়ে কাজ করতে নির্বাচন কমিশন লাজুক বা অনাগ্রহী।
দুইজন অসাধারণ নাগরিকের কথা। আমরা সাধারণ নাগরিক, সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী। আমাদের কথা মূল্যবান মনে হতেও পারে নাও হতে পারে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই অসাধারণ ব্যক্তিগণের অসাধারণ কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। তাই আমি বাংলাদেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় দুইজন প্রধান বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন সেই মন্তব্যগুলো আপনাদের সদয় দৃষ্টিতে আনছি। প্রথমে আমি সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (২০১১-২০১২)-এর মন্তব্যগুলো উপস্থাপন করবো। পরবর্তীতে আমি বর্তমান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার (২০১৭) মন্তব্যগুলো থেকে ভাবার্থ উপস্থাপন করবো।
বিচারপতি খায়রুল হক-এর রায় থেকে উদ্ধৃতি। এক. এবিএম খায়রুল হক মহোদয়ের রায়ের অনুচ্ছেদ ১১৭৭-এর সারমর্ম: ... কারচুপিমুক্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন সত্যকার স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল জ্ঞানী ও গুণি ব্যক্তিগণের একান্ত নির্ভেজাল প্রচেষ্টা প্রয়োজন। দুই. এবিএম খায়রুল হক মহোদয়ের রায়ের অনুচ্ছেদ ১১৭৮। নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে স্বাধীন করিতে হইবে। ইহাকে সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে। লোকবল নিয়োগে কোনো প্রকার বাঁধা সৃষ্টি করা যাইবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠান করিতে সর্বপ্রকার প্রয়োজন নিরসনকল্পে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ লইবেন। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সকল প্রকার সহায়তা সরকারের নির্বাহী বিভাগ তড়িৎ প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবেন, অন্যথায় তাহারা সংবিধান ভঙ্গ করিবার দায়ে দায়ী হইবেন। এই ব্যাপারে কোনো তরফে কোনো গাফিলতি দেখা দিলে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করিবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তড়িৎ গ্রহণ করিবেন, অন্যথায় তাহারাও সংবিধান ভঙ্গের দায়ে দায়ী হইবেন। সাধারণ নির্বাচনের তপসীল ঘোষণার তারিখ হইতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা অনুসারে, যাহারা এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সেই সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে। নির্বাচন কমিশনারগণ অন্তমুর্খী হইবেন না। যতদূর সম্ভব তাঁহাদের দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা বজায় রাখিবেন। সতত মনে রাখিবেন যে জনগণের নিকটেই তাঁহাদের জবাবদিহিতা। তাঁহারা সকলে জনগণের সেবক মাত্র। তাঁহারা কি কাজ করিতেছেন তাহাও জনগণের জানিবার অধিকার রহিয়াছে, তাঁহারা কি কাজ করিতে পারিতেছেন না এবং কেন পারিতেছেন না তাহাও জানিবার অধিকার জনগণের রহিয়াছে। নির্বাচনী আইন বা বিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনগত পদক্ষেপ তড়িৎ লইতে হইবে। এ ব্যাপারে কোনোরূপ শৈথল্য প্রদর্শন চলিবে না। শৈথিল্য প্রদর্শন করিলে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে আইন অমান্যকারী হইবেন। তিন. এবিএম খায়রুল হক মহোদয়ের রায়ের অনুচ্ছেদ-১১৭৯। শুধু তাহাই নহে, সংবাদ মাধ্যম ও আপামর জনসাধারণ তাহাদের অধিকার সম্বন্ধে শুধু ওয়াকিবহাল নয়, সোচ্চার হইতে হইবে। তাহা হইলেই শুধু নির্বাচন কমিশন ও সরকার এর জবাবদিহিতা নিশ্চিত হইবে এবং তাহারা সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকিবেন।
বিচারপতি সিনহার রায় থেকে উদ্ধৃতি। এক. এসকে সিনহা মহোদয়ের রায়ের অনুচ্ছেদ ১৯২ এর ভাবার্থ। খায়রুল হক মহোদয়ের নেতৃত্বে যে রায় দেওয়া হয়েছিল সেই রায়ে, আশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে শক্তিশালী করবে যে, ঐ নির্বাচন কমিশন যেন ফ্রি এন্ড ফেয়ার তথা স্বাধীন ও উন্মুক্ত বা পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারেন। সেই রায়ে আশা করা হয়েছিল যে, সরকারের হস্তক্ষেপ ব্যতিতই নির্বাচন কমিশনে শূন্য পদগুলো পূরণ হবে। এসকে সিনহা মহোদয়ের নেতৃত্বে প্রদত্ত রায়ে মন্তব্য হচ্ছে, ২০১১ বা ২০১২ সালের পরবর্তী বাংলাদেশের কোনো সরকারই উপরে ব্যক্ত আশাগুলো পূরণের লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সিনহা মহোদয়ের নেতৃত্বে প্রদত্ত রায়ে মন্তব্য হচ্ছে যে, বিরোধী দলও এই বিষয়টি পার্লামেন্টে বা অন্য কোনো ফোরামে উপস্থাপন করেননি। সিনহা মহোদয়ের নেতৃত্বে প্রকাশিত রায়ে মন্তব্য হচ্ছে, সরকার বা বিরোধী দল কর্তৃক এইরূপ নিষ্ক্রিয়তা বা নিশ্চুপতার ফল হলো এই যে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। দুই. এসকে সিনহা মহোদয়ের ১৯৩ অনুচ্ছেদের প্রথম অর্ধেকের ভাবার্থ। জাতীয় সংসদের নির্বাচন যদি স্বাধীনভাবে, পক্ষপাতহীনভাবে এবং কোনো প্রকারের হস্তক্ষেপ ব্যতিত অনুষ্ঠান করা না যায় বা অনুষ্ঠান করা না হয়, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যতিত, গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠিত করা বা গঠন করা সম্ভব নয়। ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং আমাদের দেশের পার্লামেন্ট এখনও শৈশবেই রয়ে গেল। জনগণ এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের উপরে বিশ্বাস বা আস্থা স্থাপন করতে পারছেন না। যদি এই দুইটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিকরণের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও সম্মান অর্জন করা না হয় তাহলে কোনো বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যতিত, জ্ঞানী বা মেধাবী রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ পার্লামেন্ট-এর সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না এবং এর কারণে পার্লামেন্টের প্রাতিষ্ঠানিকরণ প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়।
সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আন্তরিকতা প্রয়োজন, এই প্রসঙ্গে একটু আলোচনা। এই প্রসঙ্গে আমাদের আবেদন, আপনাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বস্তুগত উপাত্তগুলো সরকারের নিকট থেকে আদায় করে নেবেন। কিন্তু আপনাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আপনাদের আন্তরিকতা আপনাদের সদিচ্ছা বৃদ্ধিতে সরকার সাহায্য করতে পারবে না। এর জন্য আপনারাই যথেষ্ট। আমাদের আবেদন: বাংলাদেশের এই সংকটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পরিবেশে আপনারা নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করুন। অন্ততপক্ষে বৃদ্ধি না করলেও যতটুকু সক্ষমতা আছে বলে সকলেই বিশ্বাস করেন, সেটুকু অন্তত প্রয়োগ করুন। সংবিধান যতটুকু ক্ষমতা আপনাদেরকে দিয়েছে ততটুকু প্রয়োগ করতে গেলে যদি বাধা আসে, তখন নিশ্চিতভাবেই দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী আপনাদের পক্ষে থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আপনারা যদি আপনাদের সক্ষমতা প্রয়োগ না করেন তাহলে কোনোমতেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৬৬ নিয়ে আলোচনা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদ নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা প্রসঙ্গে অতি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ৬৬(১) এবং ৬৬(২)(চ) পড়ার পর পরবর্তী তিনটি পড়লে ভালো। ৬৬(৩) এবং ৬৬(৪) ও ৬৬(৫) এখানে হুবহু, সম্মানিত নির্বাচন কমিশনের সমীপে পড়ে শোনানো হয়। কোনো একজন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত এবং সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন না কী কী পরিস্থিতিতে বা শর্তে, সেগুলো সংবিধানের ধারা ৬৬(১), ৬৬(২), ৬৬(৩), ৬৬(৪) ইত্যাদিতে বর্ণিত আছে। এখানে ঐ ধারাগুলো উদ্ধৃত করছি। ৬৬(২) কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি (ক) ..., (খ) ..., (গ) ..., (ঘ) ..., (ঙ) ..., ৬৬(২)(চ) আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করিতেছে না, এমন পদ ব্যতিত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ধারা ৬৬(৩) উদ্ধৃত করছি। এই অনুচ্ছেদের (অর্থাৎ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৬র) উদ্দেশ্য সাধনকল্পে কোনো ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না। এমপিগণ, আমাদের দৃষ্টিতে, এমপি পদে বহাল থেকে আরেকবার এমপি নির্বাচন এইজন্যই করতে পারবেন না। অনুচ্ছেদ ৬৬(৪) উদ্ধৃত করছি। কোনো সংসদ সদস্য তাহার নির্বাচনের পর এই অনুচ্ছেদের (২) দফায় বর্ণিত অযোগ্যতার অধীন হইয়াছেন কিনা কিংবা এই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হইবে কিনা, সে সম্পর্কে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে শুনানী ও নিষ্পত্তির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রেরিত হইবে এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইবে। উদ্ধৃতি শেষ। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সকালবেলা, আমাদের প্রতিনিধি দল, নির্বাচন কমিশনের প্রতি আবেদন রেখেছি, আহ্বান রেখেছি, যেন নির্বাচন কমিশন তাঁদের ক্ষমতা প্রয়োগে আগ্রহী হন। আমাদের প্রতিনিধি দল মৌখিকভাবে উদাহরণ তুলে ধরেছেন এমন এমন ঘটনার যেখানে, নির্বাচন কমিশন নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগে অনিহা প্রকাশ করেছেন বা এমনকি ক্ষমতা পরিত্যাগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই কথাগুলো প্রযোজ্য এ জন্য যে, বাংলাদেশের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ব্যক্তিত্বগণ নিজেদের অনিহার কারণে বা অনাগ্রহতার কারণে বা সীমাবদ্ধতার কারণে সেই ক্ষমতাগুলো প্রয়োগ করেননি; যার কারণে মানুষ মনে করে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট সক্ষম নয়। আমাদের প্রতিনিধি দল উৎসাহিত করতে চেষ্টা করেছে যেন তাঁরা নিজেদের ক্ষমতাকে প্রস্ফূটিত করতে আগ্রহী হন। যেন তাঁরা দেশের রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন।
এখন সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গ। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কি হবে না এটা একটা আলোচ্য বিষয়। নির্বাচন কমিশন প্রথম সংলাপ করেছিলেন সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গদের সঙ্গে। নির্বাচন কমিশন মিডিয়া ব্যক্তিত্বগণের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করেছেন। একাধিক রাজনৈতিক দলও ইতোমধ্যে এসেছেন। সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে প্রত্যেকটি বৈঠকেই আলোচনা হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ আলোচনাগুলোর বর্ণনার উপর নির্ভর করে আমরা বলছি যে, বিষয়টিতে বেশিরভাগ আলোচকই সেনা মোতায়েনের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। কিছু কিছু পত্র-পত্রিকায় এসেছে এই মর্মে একটি কথা যে, কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচন একটি সিভিল বিষয়, এখানে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন কী? এইরূপ কথা যখন উত্থাপিত হয়েছিল এই সম্মেলন কক্ষে, তখন অন্যান্য আলোচকগণ পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন এইরকম যে, সেনাবাহিনী যদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইন-শৃংখলা উন্নয়নে বা শান্তি-শৃংখলা উন্নয়নে এবং নির্বাচন কাজ সম্পাদন করানো কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে কেন পারবে না? আরও একটি যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সেনাবাহিনী সবসময় ত্রাণ কাজে, সরকারের হুকুমে, জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যতীত আরও বহুবিধ কাজে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ঐ কাজগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য বা ক্রাইটেরিয়া হলো দুইটি যথা কাজগুলো জনগণের কল্যাণে বা উপকারের জন্য কিনা দ্বিতীয়ত, কাজগুলো করার জন্য সেনাবাহিনীর সক্ষমতা, দক্ষতা আছে কিনা।
আমাদের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত যুক্তি। উপরে উল্লেখিত যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির অতিরিক্ত আমরা কিছু কথা উপস্থাপন করবো। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান একজন সাবেক সৈনিক। ১৯৭০ সাল থেকে নিয়ে ১৯৯৬ সালের জুন পর্যন্ত পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় সেনাবাহিনীর মোতায়েন নিয়ে তিনি জড়িত ছিলেন। যখন কনিষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন, তখন সরাসরি সৈন্য দল নিয়ে মাঠে-ময়দানে ছিলেন। যখন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হয়েছেন তখন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ছিলেন বা বৃহত্তর কমান্ড পর্যায়ে ছিলেন। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ১৯৮৬ সালের নির্বাচন, তখন তিনি একজন প্রশিক্ষক হিসেবে ব্যস্ত ছিলেন।
বহুল পরিচিত স্ট্রাইকিং ফোর্স-এর ধারণা বর্তমানে অকার্যকর। সেনাবাহিনী মোতায়েনের একটি সাধারণ ধারণা হলো তাদেরকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখা হবে। অর্থাৎ কোনো গোলযোগ দেখা দিলে এবং সেই গোলযোগ যদি সাধারণ আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সামলাতে না পারে, তাহলে সেনাবাহিনীকে ডাকা হবে। এই তত্ত¡টি বর্তমানের জন্য আংশিকভাবে (বৃহদ-অংশ) অপ্রযোজ্য। ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মরিয়া গেল- এইরকম একটি বাংলা প্রবাদ আছে। নির্বাচনকালে যে সকল গন্ডগোল হয়, সেগুলো যারা করে তারাও খুব ভালো করে জানে যে, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী আছে। অতএব স্ট্রাইকিং ফোর্সকে ডাকার প্রয়োজন পড়বে এমন কোনো গন্ডগোল তারা করে না, আবার আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো গন্ডগোল সামলাতে না পারলেও অফিসিয়ালি স্বীকার করতে চায় না যে, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলশ্রæতিতে স্ট্রাইকিং ফোর্সকে ডাকার প্রয়োজন পড়ে না। এই যুগকে আমরা ডিজিটাল যুগ বলতে পারি। ডিজিটাল যুগের অপরাধগুলোও ডিজিটালাইজড হয়ে গিয়েছে, তথা অতীতের তুলনায় রূপান্তরিত হয়েছে।
ভোটারগণের নিরাপত্তা কোথায় কোথায় প্রয়োজন এই প্রসঙ্গে আলোচনা অতি গরুত্বপূর্ণ। আমাদের দরকার জনগণ যেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারে। শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে হলে কয়েকটা জিনিস নিশ্চিত করতে হবে যথা (১) ভোটের আগে প্রার্থীগণ যখন ভোটারদেরক সন্ধান করে বা প্রার্থীগণ যখন ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তখন যেন ভোটারগণের সামনে কোনে কথা না থাকে (২) ভোটের দিন ভোটারগণ যেন শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে। (৩) ভোট কেন্দ্রে যেন শান্তিপূর্ণভাবে নিয়ম-শৃংখলা মেনে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে পারে। (৪) ভোট দেওয়ার সময় যেন ভোটারকে কেউ ভিতরে ভয়-ভীতি না দেখায় এবং তার সিল মারা ব্যালটটি যেন বাক্সে ফেলতে পারে। (৫) ভোটার যেন ভোট কেন্দ্র থেকে নিরাপদে নিজ বাড়িতে ফেরত এসে অবস্থান করতে পারে। (৬) ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন ভোট গণণা হবে তখন যেন কেউ সেখানে আক্রমণ না করে বা ভোটের বাক্স কেড়ে না নেয় বা ফলাফলের পরিবর্তনে কাউকে বাধ্য না করে।
আজকের জন্য কলামটি শেষ করছি। আগামী সপ্তাহের কলামে দুটি বহুল পরিচিত শব্দ (যথা মাস্তান ও ক্যাডার) নিয়ে আলোচনা করবো; ভোটারদের ছয়মান্ত্রিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করবো। তাছাড়া আগামী সপ্তাহে, একটি কঠোর, কঠিন, অপ্রীতিকর প্রশ্ন তুলে, সে প্রশ্নের উত্তর আলোচনা করে, সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রসঙ্গেটি শেষ করবো। আগামী সপ্তাহের কলামে, নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আইটেমগুলোও আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
পরিচিত দুইটি শব্দ ও তাদের ব্যাখ্যা উপস্থাপন। উপরের অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছয়টি উপাত্ত বা ছয়টি কর্ম দ্রষ্টব্য। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, এই কাজগুলোতে কে বাধা দিচ্ছে? আমি ব্যাখ্যা করবো এই বলে যে, বাংলাদেশে বর্তমানে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। গুম, খুন, অপহরণ ইত্যাদি নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়। দেশের বহু জায়গাতেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দাপট প্রচন্ড। গত নয়-দশ বছরে ক্ষমতাসীন সরকারের পরিকল্পিত কর্মকান্ডের কারণে হোক বা ঘটনাক্রমেই হোক তথা যে কোনো কারণেই হোক, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজনীতিকরণ হয়ে গিয়েছে। অনেক সদস্যবৃন্দের চিন্তা-চেতনা সরকারের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার দিকে ঝুঁকে আছে এবং তাদের কর্মকান্ডের লক্ষ্যবস্তুই হয় ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন দেওয়া বা ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। বাংলাদেশে দুইটি শব্দ বহুল পরিচিতি, মাস্তান এবং ক্যাডার। এখনকার মাস্তান এবং ক্যাডারদের নিকট মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। সরকারি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এলাকায় এলাকায় মহল্লায় মহল্লায় জেলায় জেলায় ক্যাডার বাহিনী ও মাস্তান বাহিনী দোর্দন্ড প্রতাপে বিরাজ করছে। এই ধরনের মাস্তান ও ক্যাডার বাহিনী নির্বাচনের আগে আগে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। নির্বাচন কমিশনের নিকট যে দাবি বছরের পর বছর করে যাওয়া হচ্ছে, সেটি হলো নির্বাচনকালে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চাই। অর্থাৎ প্রতিদ্ব›দ্বী রাজনৈতিক দল বা জোটগুলোর জন্য রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা, প্রচারের সুযোগ সুবিধা সমান করতে হবে। ২০১৭ সালের বাংলাদেশে, ক্ষমতাসীন মাস্তান ও ক্যাডারদের ভয়ে বা তাদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাধারণ গ্রাম্য নাগরিকগণের পক্ষে বাড়িতে থাকা অথবা ভোট কেন্দ্রে যাওয়া বা না যাওয়া কোনোটাই সম্ভব নয়। এইরূপ পরিস্থিতিতে কী করণীয়? আজকের কলামটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে বিধায়, এখানেই থামছি।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ