Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা গণহত্যা, কুর্দি রেফারেন্ডাম মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তরকোরিয়া প্রসঙ্গ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বার্মিজ সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা জাতিগত নির্মূল অভিযানের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের সবচে বড় মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস রচিত হয়েছে। একাত্তুরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে ২৫শে মার্চ রাতে সূচিত পাকিস্তানী বাহিনীরক্রাকডাউন অভিযান থেকে বাঁচতে প্রায় কোটি মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে গেলেও সেখানে এমন মানবিক বিপর্যয়ের উদাহরণ তৈরী হয়নি, যেটি বর্তমানে আরাকান-বাংলাদেশ সীমান্তে ঘটছে। হাজার বছরের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের সুমহান ঐতিহ্য সত্তে¡্বও রোহিঙ্গারা কোন স্বাধীন আবাসভূমি চায়নি, তারা শুধু আরাকানের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায়। এমনকি গণহত্যা ও রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিং-এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিও স্বাধীন আরাকান গঠনের ডাক দেয়নি। তাদের এই অবস্থান সঠিক না বেঠিক সে আলোচনা এখানে অবান্তর। সাড়ে ৬ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বার্মায় শতাধিক নৃগোষ্ঠির মানুষ বসবাস করলেও স্থানীয় ভূমিপুত্র, হাজার বছরের ইতিহাসের ধারক রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পেছনে সুদুর প্রসারি ভূ-রাজনৈতিক চক্রান্ত ও জায়নবাদি ষড়যন্ত্রের যোগসুত্র বেরিয়ে আসছে। গত কয়েকদশক ধরেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদেরকে বিশ্বের সবচে নির্যাতিত, স্টেটলেস ও মোস্ট প্রসিকিউটেড এথনিসিটি হিসেবে আখায়িত হলেও তাদেরকে রক্ষায় বিশ্বসম্প্রদায়ের উদ্যোগ খুবই অপ্রতুল। বিশ্ব্সম্প্রদায়ের এই নীরবতাই বার্মিজদেরকে রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিং অপারেশনের সাহস যুগিয়েছে। এখন বার্মিজ গণহত্যার মুখে রোহিঙ্গাদের পুরো জনগোষ্ঠির প্রায় ৭০ শতাংশ রাখাইন থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের চাপ ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করলেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বৃহৎ প্রতিবেশিদের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা এই সংকটকে আরো জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী করে তুলবে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মত পরাশক্তির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক মিসাইলের হুমকির মুখে যেন আবোল তাবোল বকতে শুরু করেছেন। গত সত্তুর বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার উপর আন্তর্জাতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরও যখন উত্তর কোরিয়াকে দুর্বল করতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা, তখন পারমানবিক বোমা ও আন্ত:মহাদেশিয় ব্যালেস্টিক মিসাইলের অধিকারি উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সা¤্রাজ্যবাদের হুমকি কোন কাজে আসছেনা। মার্কিনীরা যতই হুমকি দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া ততই বেপরোয়া হয়ে নতুন নতুন ক্ষেপনাস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে। মার্কিন হুমকির বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার এমন অনমনীয় মনোভাব গ্রহণের জন্য রয়েছে মার্কিনীদের মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধ ও বিশ্বাস ভঙ্গের দীর্ঘ ইতিহাস।
যেখানে সামরিক শক্তিকেই বিশ্বের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করছে বিশ্বনেতারা। বিগত দুইটি মহাযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ও শত শত শহর ও জনপদ ধ্বংসস্তুপে পরিনত হলেও সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে যুদ্ধবিরোধী বিশ্বসম্প্রদায়ের আবেগ ও ইচ্ছাকে কোন পাত্তাই দেয়নি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব নেতারা। লিগ অব নেশনস এবং জাতিসংঘ গঠনের মূল লক্ষ্য হিসেবে শান্তির স্বপক্ষে যুদ্ধবিরোধি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার কথা বলা হলেও জাতিসংঘ গঠনের সেই লক্ষ্যকে পশ্চিমা উদ্যোক্তারা শুরুতেই চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে। এর প্রথম উদাহরণ ১৯৪৮ সালে পশ্চিমা সামরিকশক্তির বলে ফিলিস্তিনি আরবদের ভ‚-খন্ডে মানবিক বিপর্যয় ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের মাধ্যমে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক বিবর্তনের ঘটনাক্রমকে পাশ কাটিয়ে সামরিক শক্তি দিয়ে জায়নবাদি ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের প্রভাবে শুধুমাত্রমধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই ভ‚লুণ্ঠিত হয়নি, মানবদেহের ক্যান্সারের মত তা ক্রমে সারাবিশ্বে ছড়িয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এথনিক ক্লিনজিং তার সর্বশেষ উদাহরণ। এ কাজে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ইসরাইলী বাহিনীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও পেয়েছে বলে জানা যায়। ফিলিস্তিনী মুসলসমানদের তাড়িয়ে তাদের গ্রামগুলো বুলডোজারে গুড়িয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে সেখানে নতুন ইহুতি বসতি, শহর ও রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি ও অস্থিতিশীলতার সংকট একদিনের জন্যও থামেনি। অব্যাহতভাবে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা-পৃষ্ঠপোষকতা লাভের পরও গত সত্তুর বছরে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল তার প্রতিবেশি ও বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার জুজুকে কাজে লাগিয়েই টিকে থাকার ক‚টকৌশল গ্রহণ করেছে ইসরাইল ও তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখন আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে দক্ষিন এশিয়ায় আরেক ফিলিস্তিনের জন্ম দেয়া হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশকে সিরিয়া ও লেবাননের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়ার সম্ভাব্য একটি নীল নকশা সক্রিয় থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আরাকানের উগ্রপন্থী বুদ্ধিস্টরা চরম সাম্প্রদায়িক জায়নবাদের ভ‚মিকায় অবর্তীণ হয়েছে। ইঙ্গ-মার্কিনীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এখন বার্মিজ সামরিক শাসকদের তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে হিন্দুত্ববাদি ভারত এবং চরম পুঁজিবাদি চীন। উল্লেখ্য, গণভোটের মধ্য দিয়ে বার্মায় ইতিমধ্যেই একটি কথিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে এখনো মূলত: পাঁচ দশকের সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতাই দেখা যাচ্ছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভ‚ষিত অং সান সুচির নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের সময় এমন নৃশংস গণহত্যার ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, বার্মায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রত্যাশা সুদূরপরাহত। বার্মার বিভিন্ন অঞ্চলে এখন অন্তত একডজন বিচ্চিন্নতাবাদি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। সে সব এলাকায় বার্মিজ বাহিনী কখনো এমন ক্র্যাকডাউন বা গণহত্যাকারির ভূমিকা গ্রহণ না করলেও আরাকানের মুসলমানদের বিতাড়িত করে এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন মানতে বাধ্য করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে চীন ও ভারতের মত আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সক্রিয় ভ‚মিকা থাকতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্বের দৃষ্টি এখন মধ্যপ্রাচ্যের প্লেগ্রাউন্ড থেকে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিন চীন সাগরে নিবন্ধ। বিশেষত: উত্তর কোরিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারনায় উত্তর কোরিয়ার শাসকদেরকে ইনসেইন বা পাগল আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তবে ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, একটি অনিবার্য মানবিক,রাজনৈতিক ও সামরিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে উত্তর কোরিয়া টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে ৬ দশক ধরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয় বিশ্বকে আমেরিকা ও রাশিয়া প্রভাবিত বলয়ে বিভক্ত করে দিলে ইউরোপ-এশিয়ায় জার্মানী, কোরিয়া ও ভিয়েতনামকে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত করে দেয়। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর বার্লিন দেয়াল দিয়ে বিভক্ত পূর্ব ও পশ্চিমা জার্মানী পুনরায় একত্রিত হলেও উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া একত্রিতকরণের স্বপ্ন ক্রমশ আরো দু:স্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দুই কোরিয়ার তিক্ততার মূল অনুঘটক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বযুদ্ধ শেষে উত্তর -দক্ষিণে বিভক্ত কোরিয়ার মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ ঘনীভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৫০ সালে কোরিয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই ছিল সবচে বড় ধরনের আঞ্চলিক সামরিক সংঘাত দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার সহায়ক শক্তি হিসেবে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান যুদ্ধকে এক জটিল সমীকরণে ঠেলে দেয়। অবশেষে ১৯৫৩ সালে একটি অলিখিত যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব উভয় পক্ষ মেনে নিলেও কোন আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি না থাকায় কোরিয় যুদ্ধ এখনো চলছে বলেই ধরে নেয়া যায়। বিশেষত: মার্কিন সামরিক বাহিনীর লাখ লাখ সদস্যকে ফিরিয়ে নিতে কথিত যুদ্ধবিরতির কথা বলা হলেও কোরিয়ার দুই অংশের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার কোন পদক্ষেপ বিশ্ব সম্প্রদায় নেয়নি। বার্লিন দেয়াল ভেঙ্গে দেয়ার পর দুই কোরিয়ার পুনরেকত্রিতকরণের অনেকটা সম্ভাবনা দেখা গেলেও সাম্রাজ্যবাদি স্বার্থের নিগড়ে বন্দি আঞ্চলিক শক্তিগুলো এ ক্ষেত্রে সব সময়ই বড় বাঁধা হয়ে দাড়ায়। এ ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের অহেতুক বৈরিতা, অবরোধ এবং কোরীয় যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার উপর মার্কিন বাহিনীর অস্বাভাবিক ধ্বংসলীলার ইতিহাস উত্তর কোরীয়দের জন্য এখনো দগদগে ক্ষতচিহ্ন হয়ে আছে। যখন পিয়ংইয়ংয়ের লোকসংখ্যা ছিল ৪ লাখের কম তখন মার্কিন বাহিনী পিয়ংইয়ং এর উপর ৪ লাখ ২৮ হাজার বোমা ফেলেছিল। যুদ্ধে সামরিক বিজয় নিশ্চিত করতে রাসায়নিক অস্ত্র, জীবাণু অস্ত্রসহ প্রচলিত অপ্রচলিত সব ধরনের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেছিল মার্কিনীরা। কোরিয় যুদ্ধে মার্কিনীদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের হাজার হাজার ঘটনার তথ্য প্রমান উত্তর কোরিয়ার ওয়ার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এমনকি ১৯৫৩ সালের যুদ্ধবিরতির পর থেকে ৮ হাজার বার যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘনের তথ্য প্রমানও ওয়ার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনে কোরীয় যুদ্ধ ছাড়াও কিউবা, ইরান, গুয়াতেমালা বিভিন্ন দেশে সামরিক-বেসামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এসব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশগুলোর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেছে এবং দীর্ঘমেয়াদি বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কিউবার মিসাইল ক্রাইসিসসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক ও সামরিক পরাজয় প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসি। তবে এসব যুদ্ধের হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ দেশগুলোর মানুষের মনে দগদগে ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। বিশেষত: উত্তর কোরিয়ার জনগন সেই ক্ষতচিহ্নকে বুকে ধারণ করেই নিজেদের জাতিগত ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেছিল। মুক্ত বিশ্ব থেকে উত্তর কোরীয়দের বিচ্ছিন্ন করে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি এবং নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে কোরিয়াকে দুর্বল করে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতজানু করার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যম উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে যে সব প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসছে তার বেশীর ভাগই মিথ্যা, সাম্রাজ্যবাদি প্রপাগান্ডার অংশ।
জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ সম্মেলনের চলমান অধিবেশনে উত্তর কোরিয়ার মিসাইল সংকট এবং মিয়ানমার বাহিনীর রোহিঙ্গা গণহত্যা অন্যতম আলোচ্য ইস্যু। এ ইস্যুগুলো ছাড়াও সিরীয় যুদ্ধ, ইয়েমেনে সউদি সামরিক হস্তক্ষেপ, কাতারের উপর জিসিসি দেশগুলোর অবরোধ, কুর্দিদের স্বাধীনতার কথিত রেফারেন্ডাম ক্রম অশান্ত বিশ্বপরিস্থিতির জন্য অন্যতম নিয়ামক ঘটনা। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও এথনিক ক্লিনজিং থেকে শুরু করে এই মুহুর্তে মধ্যপ্রাচ্য তথা এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকায় সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার সাথেই ইসরাইলের জায়নবাদি ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বা সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের সব আঞ্চলিক সংঘাত, আইএস, আলকায়েদা, পেশমার্গার তৎপরতার সাথে ইসরাইলী মোসাদের সম্পৃক্ততার ফ্যাক্টস নতুন করে বর্ণনার প্রয়োজন নেই। রাখাইনে সাম্প্রতিক গণহত্যা শুরুর আগে বার্মিজ সেনাবাহিনী ও ইসরাইলী সামরিক কমান্ডার ও যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদকদের বৈঠকাদির খবর নানা মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। মূলত মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিটি আঞ্চলিক ও কৌশলগত কনফ্লিক্টে ইসরাইলীদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়। এই মুহর্তে আরাকানের মুসলমানরা যখন গণহত্যা ও নিজেদের ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত হয়ে মানবিক বির্যয়ের মধ্যে পড়েছে এবং রাখাইনকে একটি বিরাণ ভষ্মিভুত জনপদে পরিনত করা হয়েছে, তখন ইসরাইলীরা ইরাককে ভেঙ্গে এর উত্তরাঞ্চলে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চূড়ান্ত ধাপে অগ্রসর হচ্ছে। প্রথম গাল্ফ ওয়ারের মধ্য দিয়ে ইরাকে জাতিগত বিভেদ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে সেখানে একটি কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু হয়। পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকতায় আইএস ও সিরীয় বিদ্রোহীরা সফল হলে এতদিনে হয়তো ইরাক ও সিরিয়ায় আরো অন্তত তিন-চারটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটত। মূলত: মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙ্গে দুর্বল করে ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে দেয়ার সাম্রাজ্যবাদি পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য। একটি কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর যে গণভোট আয়োজনের প্রক্রিয়া চলছিল ইতিমধ্যেই ইরাকের সর্বোচ্চ আদালত তা বেআইনী আখ্যায়িত করে রায় দিয়েছে। এর আগেই ইরাকি পার্লামেন্ট, ইরান, সিরিয়া, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্টগুলোর তরফ থেকে কুর্দি গণভোটের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। এমনকি ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও শেষাবধি কুর্দি রেফারেন্ডামের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও শুধুমাত্র ইসরাইল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ইরাকের ক্ষুদ্র এথনিক গ্রæপ কুর্দিদের সাথে ইসরাইলীদের যোগাযোগ ও প্রভাব বিস্তার এবং বিচ্ছিন্নতাবাদে উদ্বুদ্ধ করার ইতিহাস ১৯৬০ সাল থেকে। মূলত: মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিগত সমস্যাকে বহুগুনে বাড়িয়ে তোলার মধ্য দিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রকে বিভক্ত করার কৌশলকে শুরু থেকেই কাজে লাগাচ্ছে ইসরাইল। এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের নিরাপত্তা ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি স্বার্থ একাকার হয়ে আছে। পঁচিশ সেপ্টেম্বরের কথিত রেফারেন্ডামের বিরুদ্ধে ইরাক-ইরানসহ সব আরব প্রতিবেশি রাষ্ট্রের তীব্র বিরোধিতা, ইরাকি পার্লামেন্ট এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পাশাপাশি ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার পরও কুর্দি নেতা মাসুদ বারজানি গণভোট প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। মাসুদ বারজানির পেশমার্গা আর্মি ইসরাইলী সহায়তায় গড়ে উঠেছে। একটি কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইরাকে আরেকটি ইসরাইলের জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বেশ কয়েক বছর ধরেই কুর্দিদের স্বাধীনতার পক্ষে একজন আন্তর্জাতিক ক‚টনৈতিক মাউথপিস হিসেবে কাজ করছেন। নিউইয়র্কে চলমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের শিডিউল অনুসারে ১৯ সেপ্টেম্বর ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যে হয়তো এসব বিষয়ে তাদের ভূমিকার প্রতিফলণ থাকবে। ইতিমধ্যে নেতানিয়াহু ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের যুক্তি দেখিয়েছেন বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। আর জাতিসংঘের বক্তৃতায় নেতানিয়াহু ইরাকে কুর্দিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো মতামত তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দূরের কথা তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও যেন কারো কোন মাথাব্যথা নেই। মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেতা অং সান সুচি জাতিসংঘ অধিবেশনে যাচ্ছেননা। একইভাবে সুচি’র সামরিক পদক্ষেপ সমর্থনকারি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেননা। এমনকি রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও চলতি অধিবেষণে যোগ দিচ্ছেননা। এসব গুরুত্বপূর্ণ নেতার অনুপস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে তাদের অবস্থানগত দুর্বলতার প্রমান দেয়। এখন রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে চীন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। তারা হয়তো উত্তর কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য পারমাণবিক হুমকি ও সঙ্ঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়েও ব্যস্ত থাকবে। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও শরনার্থী সংকট নিয়ে ইতিমধ্যে আরো বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের ক‚টনৈতিক তৎপরতা ও সমর্থন কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘে যৌক্তিক ও মানবিক দাবীর সপক্ষে বড় ধরনের ক‚টনৈতিক বিজয় অর্জন করা বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘের কর্মকান্ডের সমালোচনা করে জাতিসংঘের সংস্কারের কথা বলেছেন। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মার্কিন চাঁদা ও মানবিক সহযোগিতা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ভেটো-ক্ষমতার অপপ্রয়োগসহ এসব কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই ঠুটোজগন্নাথে পরিণত হয়েছে। মার্কিনী ইসরাইলীরা জাতিসংঘকে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। এখন চীন ও রাশিয়াও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে। সেখানে মুসলমানদের স্বার্থ ও নিরাপত্তার কোন মূল্য নেই।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ