হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যার সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হলো এই যে, সমস্যাটির সমাধানের কোনো আলোর রেখা এখনো দেখা যাচ্ছে না। তবে এবার সমস্যাটি দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে পলিটিশিয়ান, রাষ্ট্রনায়ক এবং মিডিয়া পর্যায়ে এই ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর এবং আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যে, যেসব দেশ এই ইস্যুটিতে মুসলমানদের সমর্থন করেনি এবং যারা বলতে গেলে অং সান সুচির অবস্থানকেই সমর্থন করেছে তারাও বিপন্নমানবতা অর্থাৎ মজলুম রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠাচ্ছে এবং সহিংসতা বন্ধ করতে বলছে। প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ভারত এবং চীন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে গিয়ে সুচির সাথে মিলিত হন এবং তাঁর সরকারের অবস্থানের প্রতিশর্তহীন সমর্থন ব্যক্ত করেন। এমনকি রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা বর্মী নাগরিকত্ব দাবি করেছে তাদের তিনি দুষ্কৃতিকারী এবং সন্ত্রাসী বলে অপবাদ দেন। তিনি আরো বলেন যে, মিলিটারী অপারেশনের ফলে যে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে ঢুকে গেছে তাদেরকেও ভারত থেকে বের করে দেওয়া হবে। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী নরেন্দ্র মোদির এই অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা হিন্দু না মুসলমান সেটা আমি বুঝতে চাই না। ওরা মানুষ। মানবতা এখানে বিপন্ন হয়েছে। তাই পশ্চিমবঙ্গে যেসব রোহিঙ্গা ঢুকেছে মানবিক কারণে তিনি তাদেরকে বের করে দেবেন না।
এদিকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। অতীতে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল সেই ৪ লাখ রোহিঙ্গাতো রয়েই গেছে, নতুন করে এসেছে আরো ৪ লাখ। জাতিসংঘ আশংকা করছে, এই সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে ১০ লাখে উন্নীত হবে। এদের নিয়ে বাংলাদেশ সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ একটি গরীব দেশ। তারপরেও এই ৮ লাখ মানুষকে আশ্রয় ও খাওয়ার দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের এত বড় বিপদেও ভারত যদি বাংলাদেশের পাশে না থাকে তাহলে সে বাংলাদেশের কেমন বন্ধু? মানুষ শেখ হাসিনার উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন করছে, বাংলাদেশ মানুষ ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে। অথচ বিনিময়ে বাংলাদেশকে বস্তগতভাবে কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, বাংলাদেশের এই দুর্দিনে ভারত তার পাশে এসেও দাঁড়ায়নি। উল্টো সে দাঁড়িয়েছে মিয়ানমার তথা সুচির পাশে। সে কারণেই নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য এবং পরবর্তীতে ভারতের এই অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে রাগে ফুঁসছে। তাই শেখ হাসিনাকে খুশি করার এবং বাংলাদেশের জনগণের রাগ প্রশমনে ভারত কিছু ত্রাণসাহায্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার মূল অবস্থান পরিবর্তন করেনি।
ওই দিকে চীনের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিশর যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল চীন সেটিতে বাধা দিয়েছে। তারপর ধরি মাছ না ছুই পানি জাতীয় একটি প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে। গত রবিবারের পত্রপত্রিকায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও সুচির প্রতি চৈনিক সমর্থন পূনর্ব্যাক্ত করা হয়েছে।
গত রবিবারের পত্রপত্রিকায় আর একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হল রাশিয়ার অবস্থান। যারা পত্রপত্রিকা খুটিয়ে পড়েন এবং যারা ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করেন তারা অবশ্য ব্যাপারটি আগেই টের পেয়েছিলেন। খবরটি হল, রাশিয়া রাখাইন ইস্যুতে মিয়ানমারের সামরিকবাহিনীও সুচির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটকে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ বিষয় দাবী করে দেশটিতে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে রাশিয়া। রোহিঙ্গা সঙ্কটে বর্হিবিশ্বের হস্তক্ষেপ মিয়ানমারে ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করে রাশিয়া। রাশিয়া বিষয়টিকে আন্তধর্মীয় বলে আখ্যায়িত করেছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কে এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এটা মনে রাখা দরকার যে একটি সার্বভৌম দেশের হস্তক্ষেপের ইচ্ছা কেবল আন্তধর্মীয় বিরোধ বাড়িয়ে দিতে পারে। আমরা সরকারের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি এবং ঐ ধর্মের সমর্থকদের প্রতি উগ্রপন্থীদের উস্কানির পথে পা না দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’ \ দুই \
ওপরের এই আলোচনায় দেখা গেল যে, বিশ্বের তিনটি বড় শক্তি অর্থাৎ ভারত, রাশিয়া এবং চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং সুচিকে নির্শত সমর্থন দিয়েছে। এর সোজা অর্থ এই দাঁড়ায় যে, লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সুচি এবং তার সামরিক বাহিনী যে বর্বর জুলুম চালাচ্ছে, বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, এ পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশী রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করেছে, সেই সবগুলো অপকর্মকে ভারত, রাশিয়া এবং চীন সমর্থন করেছে। এর পরেও যখন বলা হয় যে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নিতে হবে তখন সেই কথাটি আকাশে তীর ছোঁড়ার মতই মনে হয়। এখনো মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক উভয় পক্ষই সাফ বলে দিচ্ছে যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। সুতরাং তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। তাদেরকে নাগরিকত্ব না দেওয়ার পক্ষে এই যুক্তি বড় অদ্ভুত।
তারা বলছে যে রোহিঙ্গারা মুসলমান, এই কারণেই তারা রোহিঙ্গাদেরকে বিতাড়ন করছে না। রোহিঙ্গারা নাকি সকলে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী তারা নাকি বাঙ্গালীদের বংশধর। তাদের পূর্ব পুরুষ নাকি সব বাঙ্গালী ছিল। এই কারণে তারা তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে ঠিকই, কিন্তু মুসললিম সন্ত্রাসী বা মুসলিম জঙ্গী বলে না। রোহিঙ্গা কর্তৃপক্ষ বলে যে, ওরা ‘বাঙালী টেরোরিস্ট’ বা ‘বাঙ্গালী সন্ত্রাসী।’ এই যেখানে বর্বরতার পেছনে যুক্তি সেখানে বাংলাদেশ সরকার কেমন করে আশা করে যে, ওদেরকে বলা হলো, তোমরা রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নাও, আর ওরা সুড় সুড় করে নিয়ে গেল। বলা হচ্ছে যে, ওদেরকে ফেরত নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা হবে। কাদের ওপর প্রয়োগ করা হবে এই চাপ?
এটা পরিষ্কার, বিশ্বের তিনটি বৃহৎ শক্তি বার্মার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। আমেরিকা দুমুখো নীতি গ্রহণ করেছে। শনিবার রাতে টেলিভিশনে দেখলাম বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রেস কনফারেন্স করছেন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতন ও বর্বরতার তীব্র নিন্দা করলেন। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন নেত্রী সুচির পক্ষে সাফাই গাইলেন। বললেন, সুচি নাকি এখন খুব বিপদে আছেন। তাই এখন তার সমালোচনা করা ঠিক হবে না। তবে তিনি বাংলাদেশে আসা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য দেওয়ার আবেদন করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার ভূমিকাও এব্যাপারে অত্যন্ত পরিষ্কার। তারা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য সে সরকারকে কোন চাপ দেবে না। তবে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কারণে যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব ততটুকু করবে। এর অর্থ হলো এই যে, বাংলাদেশে অতীতে এবং বর্তমানে যত রোহিঙ্গা এসেছে তারা থেকে যাবে। অতীতে যারা এসেছিল তারা থেকে গেছে। বর্তমানে যারা এসেছে তারাও থেকে যাবে। তাহলে হিসাবটা এই দাঁড়াচ্ছে যে অতীত এবং বর্তমান মিলে যে ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে তারা বাংলাদেশেই থেকে যাবে।
তবে এখানে ছোট্ট একটি কথা আছে। অতীতে যত রোহিঙ্গা এসেছিল তাদের সকলেই যে বাংলাদেশে রয়ে গেছে সেই কথাটি ঠিক নয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলেও এই সমস্যার উদ্ভব ঘটেছিল। তখন প্রেসিডেন্ট জিয়া বলিষ্ঠ কূটনীতি অনুসরণ করেছিলেন। তিনি তৎকালীন বর্মী প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক করেন এবং কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গাকে নিরাপত্তা দিয়ে বর্মী প্রেসিডেন্ট তাদেরকে বার্মায় ফেরত নেন।
\ তিন \
সত্য কথা হলো এই যে, এবার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান স্ট্রং বলে মনে হচ্ছে না। তবে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে যে, ভারত মিয়ানমারকে নি:শর্ত সমর্থন দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকার এব্যাপারে স্ট্রং পজিশন নিতে পারছে না। কিন্তুু সব ক্ষেত্রেই তো ভারতকেন্দ্রীক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা চলবেনা। জাতীয় স্বার্থে এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কিন্তুু শক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। যেসব প্রতিরক্ষা জার্নাল বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সেইসব জার্নালে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের ডিফেন্স সার্ভিস মিয়ানমারের তুলনায় দুর্বল। তাদের পরিসংখ্যান মোতাবেক মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী বাংলাদেশের চেয়ে নাকি বেশী শক্তিশালী। এই খবরটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য শুধু দূর্ভাগ্যজনকই নয় রীতিমত হতাশাব্যাঞ্জক। মিয়ানমারের সাথে কূটনীতির টেবিলে শক্তভাবে কথা বলতে হলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে তার চেয়েও বেশী শক্তিশালী করতে হবে। মিয়ানমারের লোকসংখ্যা ৬ কোটি। সেই ৬ কোটি লোকের সেনাবাহিনীর সদস্য যদি হয় ৩ লক্ষের ও বেশী তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৫ লক্ষ হবে না কেন? অনুরূপভাবে বিমান বাহিনীতেও আধুনিক বিমান সংযোজন করা হবে না কেন?
একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী পেছনে থাকলে রোহিঙ্গারা নিজদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্টা নিতে পারে। এই প্রচেষ্টায় ঝামেলাও আছে, ঝুঁকিও আছে। তবে সরকার যদি শক্তিশালী হয় দেশের সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনী যদি শক্তিশালী হয় তাহলে সরকারের শক্ত নীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাফল্য বয়ে আনে। সুতরাং আর কালবিলম্ব না করে এই মুহূর্ত থেকেই আমাদের সামরিক বাহিনীকে দুর্জয় সামরিক বাহিনীতে পরিণত করার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে এই কথাও বলতে চাই যে, আমরা যুদ্ধবাজ জাতি নই। আমরা যুদ্ধ চাইনা। তবে একথাও সত্য যে ৮ লক্ষ রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য যা কিছুই করা দরকার সেটি আমাদের করতেই হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।