হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
বাংলাদেশ নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি গত ৮ মাসে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করেছে। সেই তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৫ মাস সময়ে গেল ক’বছরের তুলনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৭২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এদিকে গেল আট মাসে সর্বনিম্ন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে আগস্ট মাসে। এই মাসে ২১৭টি দুর্ঘটনায় ২৭৯ জন নিহত হয়েছে। জানুয়ারিতে ৩৫০টি দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন, মার্চে ৩৩০টি দুর্ঘটনায় ৩৬২ জন, এপ্রিলে ৩২০টি দুর্ঘটনায় ৩৪৯ জন, মে মাসে ৩৪৬টি দুর্ঘটনায় ৪১০ জন, জুনে ২৬৫টি দুর্ঘটনায় ৩৩৩ জন এবং জুলাইয়ে ২১৯টি দুর্ঘটনায় ২৭৯ জন নিহত হয়েছে। এ তথ্য জাতীয় কমিটি কর্তৃক প্রদান করা হলেও বেসরকারি হিসাব মতে, সড়ক দুর্ঘটনা এবং নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেক বেশি। নৌ, সড়ক, রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, এসব দুর্ঘটনায় তারা ৭টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ওভারলোডিং ও ওভারটেকিংয়ের সময় নিয়ম ভাঙা, বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও সড়কের বেহাল দশা, ত্রুটিপূর্ণ বা ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ; সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চরম অবহেলা এবং দুর্নীতি, নির্লিপ্ততা, রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠনের অবৈধ প্রভাব এসব দুর্ঘটনার জন্য কম দায়ী নয়।
আমরা অনেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস কপালকুন্ডলা পড়েছি। কপালকুন্ডলাতে, গভীর অরণ্যের মধ্যে উ™£ান্ত নবকুমারকে কপালকুন্ডলা প্রশ্ন করেছিল, ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ স্থান কাল পাত্র যদিও সমান নয়, তবু আমাদের বর্তমান উ™£ান্ত দেশে সরকারকে একই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ পথ হারিয়ে না থাকলে দেশের পথগুলো এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে কেন? ডনশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বললে হয়তা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ফোঁস করে উঠবে। সঙ্গে সঙ্গে ফাইল খুলে সারা দেশে কত শত কিলোমিটার পাকা রাস্তা হয়েছে, কত হাজার পাকা সেতু তৈরি হয়েছে, কত হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে, তার ফিরিস্তি শুনিয়ে দেবে। কিন্তু দেশের আমজনতা নিজের গায়ের অথবা শহরের রাস্তাগুলার শোচনীয় অবস্থাতো রোজই দেখছে, তদুপরি নানাবিধ সংবাদ মাধ্যমের সহায়তায় সারাদেশের রাস্তাঘাটের হাল হকিকতও জেনে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, দেশের বিশেষ করে রাজধানী আর ক’টি জেলা ও বিভাগীয় শহরের কয়েকটা পথের বিশেষ কিছু নির্বাচিত অংশ ছাড়া সারাদেশের প্রায় সব পথের নাভিশ্বাস উঠেছে। পথিক পথ না হারালেও নিজেরাই হারিয়ে যাচ্ছে। পথগুলোর যেন মা নেই, বাপও নেই। যত্ম করার কেউ নেই, তাই হাড় জিরজির ভাঙাচোরা চেহারা। তার উপর হাজার হাজার গাড়ির অবিশ্রাম চক্রাঘাত। রাস্তা নামক লম্বা লম্বা জীবগুলোর জিব বের হয়ে যাচ্ছে, মরতে আর দেরি নেই। চিড়ে চেপ্টা হয়ে যাচ্ছ!
কিন্তু মানুষকে তো চলতে হবে। চলতে গেলে তো পথ লাগবেই। জীবনের ধর্মই তো চলা। চলার নামই তো জীবন। চল-চল-। ‘হেথা নয় হেথা নয়-অন্য কোথা, অন্য কোন খানে...।’ বৌদ্ধিক, আধ্যাত্মিক, আত্মিক, মানবিক প্রভৃতি কত শত পথে চলে চলে মানুষ আদিম অন্ধকার থেকে পৌঁছে গেছে তাঁর বর্তমান রূপে। কিন্তু এসব তো বড় কথা, এসব নিয়ে ভাববে বড় মাথা। আমরা যারা সাধারণ মানুষ আমাদের প্রয়োজন পায়ের তলার মাটির উপরের পথটি। পথটি যেন মসৃণ, নিরাপদ হয়, যেন কর্দমাক্ত না হয়, এটুকুই আমাদের চাহিদা। কিন্তু এ দেশের বেশিরভাগ সড়কে আর নরকে বেশকম নেই। গোটা দেশের সিংহভাগ পথের করুণ, অবস্থা দেখে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ‘পথ নির্মাতা, তুমি কি পথে বসিয়াছ? অবস্থা দেখে মনে হয় সরকার পথে বসেছে, নয়তো পথে বসতে চলেছে।
ভাঙাচোরা পথঘাটে দুর্ভোগ নিয়ে সারাদেশেই চলছে তুমুল শোরগোল। পথের দাবিতে মানুষ পথে নামছে, পথ অবরোধ করছে কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা কিছুতেই পথে আসছে না। অবশ্য যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঈদের পূর্বে রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা আঁচ করে তা মেরামতের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন পথে পথে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, যারা একাজের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত তারা সারাটা বছর কী করলেন? কর্দমাক্ত পথে ধান রোপণ করে, পথের গর্তে মাছ শিকার করে জনতা সরকারকে লজ্জা দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দায়িত্বশীলদের চামড়ায় সুড়সুড়ির মতো এগুলো কোন কাজেই লাগছে না। অথচ পথ নির্মাণ, মেরামতি ইত্যাদির জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা, বস্তা বস্তা টাকা মঞ্জুর হচ্ছে অনবরত। কিন্তু টাকাগুলোতেই আসল গলদ। টাকাগুলো সম্ভবত কর্পূর দিয়ে তৈরি হয়। নইলে পথের জায়গায় পথ তেমনি থাকে এবং টাকা নাকি উড়ে যায়। কর্পূর খোলা রাখলে যেমন বাতাসে উবে যায়, ঠিক তেমনি আজকাল সরকারি টাকাও বাতাসে মিলিয়ে যায়। কোন কোন নিন্দুকের মতে, মঞ্জুরিকৃত টাকা নাকি রক্ষকেরাই রাক্ষস হয়ে ভক্ষণ করে ফেলে।
সেদিন পথের গর্তে হোঁচট খেয়ে হাঁটু ভাঙ্গা এক রোগী হাসপাতালের বেডে শুয়ে বলছিলেন, আমাদের গাঁয়ের রাস্তাটি মাত্র তিন-চার মাস আগে মেরামত করে দিয়ে গেল। কিন্তু এরই মধ্যে রাস্তা ভেঙ্গে আগের চেয়েও খারাপ হয়ে গেছে। তাতে হোঁচট খেয়েই তো হাসপাতালে পড়ে আছি। একটা আইন করা উচিত, এখন থেকে রাস্তা তৈরির কাজ শেষ হলে একটা এক্সপার্ট কমিটি এসে সে কাজ পরীক্ষা করে দেখবে। যদি দেখা যায় রাস্তা ঠিকঠাকভাবে তৈরি হয়েছে তবেই পথ নির্মাতাকে তার প্রাপ্য টাকা দেওয়া হবে। আর যদি কাজে ফাঁকিঝুঁকি থাকে তবে পথ নির্মাতার কঠোর শাস্তি হবে। কোনও আপিল চলবে না। বুঝা গেল বেচারা হাঁটুর যন্ত্রণায় পথ নির্মাতাদের উপর চটে লাল হয়ে আছেন। কথাগুলো তিনি যাকে বলছিলেন তিনিও পাশের বেডের কোমর ভাঙ্গা রোগী। পথের কল্যাণে রিক্সা থেকে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ফেটে গেছে। তিনি বললেন, ওইসব আইনে কিচ্ছু হবে না। কেবল পয়সা মারার আরেকটা ঘাট তৈরি হবে। এক দল পথ পরীক্ষক মোটা মোটা বান্ডিল কামাবে আর গোবর দিয়ে লেপন করে রাস্তাকে প্রথম শ্রেণির পিচ রাস্তা বলে রিপোর্ট দেবে। রাস্তাফাস্তা কোনও কিছুই মেরামত হবে না, যতদিন না আমাদের ভাঙ্গাচোরা চরিত্র মেরামত হয়।
চরিত্র মেরামত হোক আর না হোক, রাস্তা সম্পর্কে সরকারি বয়ান নতুনভাবে মেরামত করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আর দেরি হবে না। আগামী ছয় মাসের মধ্যেই দেশের সব রাস্তা সারিয়ে তোলা হবে। ছয় মাসের মধ্যেই দেশের সমস্ত রাস্তার কাজ সম্পূর্ণ করা হবে। মাত্র ছয় মাস সময় নিচ্ছে দশ বছর ধরে হবে, হচ্ছে করা, টালবাহানা করা সরকার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মাত্র ছয় মাসে সত্যিই কি সরকার এই অসাধ্য সাধন করতে পারবে? আমি বলি, না পারলেও তাদের ভয় নেই। কারণ তারা সেই রাজার বাড়ির সাদা হাতির গল্পটা জানেন। গল্পটা হয়তো অনেকেই জানেন। তবু সংক্ষেপে আবার বলছি। এক দেশে এক রাজা ছিল। তার ছিল একটা সাদা রঙের হাতি। রাজা হাতিটাকে খুব ভালবাসতেন। সেই হাতির সেবাযতœ করার জন্য রাজা একজন পাকা মাহুত নিযুক্ত করলেন এবং হাতির জন্য প্রচুর খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে দিলেন। দিন যেতে লাগল। কিছুদিন পর দেখা গেল হাতিটা ভারি রোগা হয়ে গেছে। রাজা গুপ্তচর লাগিয়ে জানতে পারলেন, মাহুত হাতির বরাদ্দ সব ভালো ভালো খাবার জিনিস চুরি করে বিক্রি করে অনেক অর্থ জমিয়ে চলেছে।
রাজার আদেশে মাহুতকে বন্দি করে আনা হলো। তার বিচার হলো। রাজা তার মৃত্যুদন্ড দিলেন। তখন মাহুত হাতজোড় করে বলল, ‘মহারাজ আমাকে একটা বছর সময় দিন। আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। আমি এই এক বছরের মধ্যে হাতিটাকে মানুষের মতো কথা বলতে শিখিয়ে দেব।’ রাজা এই অদ্ভুত চমৎকার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে মাহুতকে এক বছরের সময় দিলেন। তখন মাহুতের বন্ধুরা মাহুতকে বলল, এটা তুই কী করলি। হাতি আবার মানুষের মতো কথা বলবে নাকি? মাহুত বলল, আরে ভাই, এক বছর তো বেঁচে থাকি আগে। এই এক বছরের মধ্যে অনেক কিছুই তো হয়ে যেতে পারে। যেমন এক বছরের মধ্যে রাজা মরে যেতে পারে, আমি মরে যেতে পারি, তাছাড়া হাতিটা তো কথা বলে ফেলতেও পারে। আর তা যদি না পারে তবে হাতিটাও তো মরে যেতে পারে।
আমাদের রাস্তাঘাটের মাহুতরাও ছয় মাসের সময় চেয়ে নিয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে তারা দেশের সবগুলো পথকে খানাখন্দহীন, মসৃণ, ঝকঝকে এবং নিরাপদ করে দেবে। এমনকি তখন পথগুলো পথিকদের ‘সুস্বাগতম’ ‘ওয়েলকাম’ ইত্যাদির সাথে অন্যান্য কথাও বলবে। আর এসব যদি নাও হয় তবু এর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যেতে পারে.। তারপর যদি রাজা চলে যায় তবে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। আর যদি রাজা পাঁচ বছরের জন্যে ফের বেঁচে যায় তবে তখন চেয়ে নেওয়া ছয় মাস সময়ও শেষ হতে ওই পাঁচ বছরই লাগবে। কথায় বলে আঠারো মাসে বছর। তখন হবে ‘পাঁচ বছরে ছয় মাস।’ আসলে হবে না কিছু ঝরবে শুধু রঙিন কথার ফুলঝুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।