Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রূপগঞ্জে তাঁত শিল্পের কারিগররা ব্যস্ত শীতবস্ত্র তৈরিতে

| প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে: নারায়ণগঞ্জের অন্যতম উপজেলা রূপগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তাঁত কারিগরের তৈরী চাদরসহ বিভিন্ন প্রকার শীতবস্ত্র দেশের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে বিদেশে। আয় করছে বিদেশী মূদ্রা । তবে নানা সমস্যা থাকায় দেশের বাজারে বিদেশী কাপড়ের ও প্রযুক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁতীরা। তাই দেশীয় তাঁতের কাপড়ের চাহিদা দিনকে দিন কমেই আসছে। ফলে হাতে বোনা তাঁতি ও পাওয়ালুম চালিত দেশীয় তাঁতের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের দুর্দশা দেখার যেন কেউ নেই। দেশীয় তৈরি তাঁতের বাজার তৈরি না হওয়ায় ইতোমধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ তাঁত বন্ধের পথে। কেউ কেউ এ ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসায় ঝুঁকছেন। ফলে এই এলাকার তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নানা বাঁধা সত্বেও শীতের প্রস্তুতি নিতে এখানকার কারিগররা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, এখানকার তাঁতীদের জন্য নানা সমস্যার পরেও দেড় শতাধিক টেক্সটাইল মিলস টিকে আছে। তাদের তাঁতে দেশীয় কাপড়ের পরিবর্তে বিদেশী প্রযুক্তির সব রকম ব্যবহার দেখা গেছে। টি শার্ট, থ্রি পিস, বিদেশী গেঞ্জির কাপড় চীন, থাইল্যান্ড, জাপানি ও ভারতীয় সুতায় তৈরি করছে এসব কাপড়। ফলে দেশীয় তাঁত এখন হারাতে বসেছে তাদের চিরচেনা জমজমাট চিত্র। পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন দেশীয় তাঁতিরা। তবে শীতবস্ত্র হিসেবে এখানকার চাদরগুলো বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। তাই শীত শুরু হওয়ার আগমুহুর্তে রূপগঞ্জের কাঞ্চণের তাঁতীদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এসব তৈরী চাদরগুলো ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন পাইকার , এজেন্ট ও বিদেশের রপ্তানির জন্য বিশেষ প্যাক তৈরী হয়। পরে চলে যায় প্রতিবেশি দেশ ভারত, ইন্দোনেশিয়া,জাপান, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে। প্রচুর চাহিদা থাকায় এ শিল্পটি নানা সমস্যার পরও টিকে আছে কোনমতে।
স্থানীয় তাঁত শিল্প মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় কাপড় ও তৈরি কাপড়ের দখলে থাকা দেশী মার্কেটগুলোর সাড়া না পেয়ে এ দুর্দিনে পতিত হচ্ছেন তারা। দেশীয় কাপড় না কিনে বিদেশী কাপড় ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এমনটি ঘটেছে বলে মনে করেন তারা। সূত্রে জানা যায়, রূপগঞ্জের তারাব পৌর এলাকার নোয়াপাড়ার জামদানি পল্লীতে বিখ্যাত জামদানি কারিগররা এক সময় বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় বুনত। এসব মসলিন কাপড়ের ছিল বেশ কদর। একটি ১০ হাতের মসলিন শাড়ি কাপড় দিয়াশলাইয়ের বক্সে অনায়াসে রাখা যেত। আর এই কাপড় বুনত রূপগঞ্জের তাঁতিরাই। তৎকালীন দেশের সেরা ধনী মরহুম গোলবক্স ভূঁইয়া রূপগঞ্জের তাঁতিদের সুবিধায় কালীগঞ্জে মসলিন কটন মিল প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন। রহস্যজনক তা বন্ধ হয়ে যায়। আর তাই কালের বিবর্তে ওইসব তাঁতিদের এখন জামদানি ও দেশীয় মোটা কাপড় বুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এসব তাঁতিরা তাঁত বুনন শিল্প রপ্ত করেছেন তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে। সরকারীভাবে গ্রামীণ জনপদে প্রশিক্ষণের কোন সুব্যবস্থা না থাকায় কেবল দেশীয় তাঁত বিদেশী প্রযুক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে দেশীয় তাঁত পড়েছে হুমকির মুখে।
কোন কোন তাঁতশিল্পী এখন তাদের পুরনো পোশাকে আধুনিক জামদানিনির্ভর কাজ করে কিছুটা হলেও স্বস্থ্যি পাচ্ছেন। তবে এখানেও তারা ভাল নেই। দেশীয় তাঁতে ব্যবহৃত সুতা, রংসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদির দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি, আমদানিতে বাড়তি টেক্স ইত্যাদি কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন মালিক পক্ষ। দেশের বৃহত্তম পাইকারি মার্কেট রূপগঞ্জ থানার গাউছিয়া, নরসিংদীর সেখের চর, তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়া জামদানি পল­ী, কাঞ্চন বাজার, মুড়াপাড়া বাজার, ইয়াপুরার হাটে সপ্তাহের বিভিন্ন দিন জমজমাট হাট বসে। প্রতি মঙ্গলবার গাউছিয়ার পাইকারি বাজারে দেশীয় কাপড় বিক্রি হয় নিলামে। আর ভারতীয় কাপড় সাজানো থাকে অভিজাতসহ সাধারণ কাপড়ের দোকানে। অন্যসব হাটে ও দেশীয় তাঁতের কদর কম লক্ষ করা গেছে। দেশীয় বাজার না পাওয়ায় এসব হাটে স্থানীয় তাঁত শিল্পে উপস্থিতি কমে গেছে। এসব বাজারের প্রতিটি দোকানে দেখা মেলে বিদেশী কাপড়ের তৈরি পোশাক। নানা সমস্যার কারণে ক্রমাগত লোকসানের মুখে দেশীয় তাঁত এখন হুমকির মুখে। তাঁতিদের বোনা উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত থাকায় তাঁত শিল্পের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের পাওনা মজুরি পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান ঋণের বোঝা বাড়তে থাকায় বিক্রি করে দিয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠান। কোন কোন স্থানে সময়মতো বেতন ভাতা পরিশোধ না করায় মালিক শ্রমিকদের সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এসব নানা কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁত শিল্প।
কাঞ্চণ পৌর এলাকার রূপা টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক সাদিকুর রহমান বলেন, ক্রেতারা দোকানে এসেই ভারতীয় কাপড় চায়। কেউ কেউ চায়না কাপড়ের ভক্ত। দেশীয় তাঁতের তৈরি পোশাক আর কেউ খুঁজে না ফলে পাইকারিভাবেও দোকান পাটে দেশীয় কাপড় রাখা হয় না। যত সামান্য লোকেই এ কাপড় কিনেন বলে জানান তিনি। একই টেক্সটাইলের মালিক মালিক খলিল সিকদার বলেন, দেশীয় তাঁত রক্ষায় সরকার আমাদের তেমন সহযোগিতা করছেন না। ফলে আমার মিলে উৎপাদিত শীতের চাদর, মশারি, দেশীয় লুঙ্গির কাপড় যথাসময়ে উৎপাদন করলেও বাজারে ঠিকমতো বিক্রি হচ্ছে না। তাই মন্দাভাবেও শীত বস্ত্র তৈরী করে কিছুটা ক্ষতিপুষে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে বেতন ভাতা না পেয়ে অনেক কারিগর এ পেশা ছেড়ে দিতে চায়। ফলে দেশীয় তাঁত দিয়ে টিকে থাকা এখন চ্যালেঞ্জ।
কেন্দুয়া পারার শ্রমিক আব্দুস সোবহান বলেন, একজন রিকশাচালক দিনে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা রোজগার করেন। আর তাঁতের কারিগরের ভাগ্যে দিনে ২০০ থেকে ৫০০ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে আমাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে গেলেও অবিক্রীত থাকার অজুহাতে মালিক যথাসময়ে আমাদের শ্রমের মূল্য দেন না। এ পেশায় থেকে জীবন চালানো যাবে না বলে দাবি তার। তবে শীতের কাপড়গুলো ও বিশেষ চাদর তৈরী হওয়ায় এখনো টিকে আছেন তারা।
সূত্রে জানা যায়, তাঁত শিল্প উন্নয়নের জন্য বিগত সরকার ১৯৮৩ সাল থেকে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিয়ে আসছেন। তবে এখন তাঁত শিল্পের দুরবস্থায়ও কোন ব্যাংক এ খাতে ঋণ দিতেও গড়িমসি করছেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, এ খাতে ঋণ দিলে বেশির ভাগ মালিক লোকসানের অজুহাতে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। তাই ব্যাংক কোন ঝুঁকি নিতে চায় না। স্থানীয় তাঁত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সরকার বস্ত্রনীতিতে প্রকাশ্য বৈষম্য না রাখলেও দেশীয় বাজার রক্ষায় কোন পদক্ষেপ নেননি। ফলে এতিহ্যবাহী জীবিকা ছেড়ে এখন অনেক তাঁতির জীবন চলে মাটি কেটে ও কিংবা দিনমজুরের কাজ করে। সরকারী নজরদারি বৃদ্ধি করার দাবি করেন তারা। তাঁত ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকার তার পৃষ্ঠপোষকতার হাত একটু বাড়িয়ে দিলেই দেশীয় শিল্প বাঁচাতে সক্ষম হবে। অন্যথায় চিরচেনা দেশীয় তাঁত হারাবে বাংলাদেশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ