Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নেত্রকোনায় বাড়ছে মাতৃমৃত্যু

গর্ভকালীন অসচতেনতা ও যোগাযোগের দুরাবস্থা দায়ী : গর্ভবতীদের সেবায় ফ্রি এ্যাম্বুলেন্স

হাসান সোহেল, নেত্রকোনা থেকে ফিরে | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অভাব যেমন পিঁছু নিয়েছিল, তেমনি ছিলো পরিবারের মধ্যে কুসংস্কার। আর তাই বয়স ত্রিশের কোটা পেরুনোর আগেই বাড়িতে অদক্ষ দাই’র হাতে তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করতে হয়। বলছিলাম নেত্রকোনার কলমাকান্দা গ্রামের রাবেয়া বেগমের কথা। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গর্ভকালীন সময়ে পরিবারের যাবতীয় কাজকর্মও করতে হয়েছে রাবেয়াকে। একই কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মদন বারহাট্টা উপজেলার বাউসী গ্রামের স্বজল মিয়ার স্ত্রী তাসলিমা আক্তার (২২)। ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসীর মতে, অদক্ষ দাই ছাড়াও অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা এবং সচেতনতা এখানকার প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। স্ত্রী হারানো স্বজল মিয়া জানান, মাইলের পর মাইল কাঁচা রাস্তা পায়ে হেটে গর্ভবতী মহিলারা সদর হাসপাতালে যেতে পারেন না। তাই গ্রামের ধাত্রী বা দাই’র ওপর নির্ভর করতে হয়। তার স্ত্রী তাসলিমার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন স্বজল। তিনি বলেন, গর্ভকালীন সময়ে পিএইচডি’র (পার্টনারস ইন হেলথ্ ডেভলপমেন্ট) সহযোগিতায় বাউসী ইউনিয়নে কমিউনিটি গ্রæপ আয়োজিত মা সমাবেশে অংশগ্রহণসহ রক্তের তিনটি পরীক্ষা, নিয়মিত প্রসব পূর্ব সেবা (এ.এন.সি) গ্রহণ করেন তাসলিমা। এমনকী পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও সিএইচসিপিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। কিন্তু যাতায়াত সমস্যার কারণে অদক্ষ দাই’র ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। আর তাই মৃত্যু সন্তান জন্ম দেওয়ার ১ঘন্টা পর খিচুনীরত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাসলিমার মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩১ লাখ শিশু জš§ দিতে গিয়ে ৫ হাজার ২৭০ জন মায়ের মৃত্যু হয়। অর্থাৎ ৬০০ শিশু জš§ দিতে গিয়ে ১ জন মা মারা যান। মাত্র ৪২ শতাংশ প্রসব প্রশিক্ষিত সেবিকাদের হাতে হয়ে থাকে। বাকি ৫৮ শতাংশ গর্ভবতীর প্রসব অপ্রশিক্ষিত ধাত্রী বা আত্মীয়স্বনের হাতে হয়ে থাকে। এর মধ্যে আবার ৬৩ শতাংশ গর্ভবতীর প্রসব বাড়িতে হয়ে থাকে। আর মাত্র ৩৭ শতাংশ গর্ভবতীর ক্লিনিক বা হাসপাতালে প্রসব হয়। মা ও শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ বাড়িতে অপ্রশিক্ষিত ধাত্রী বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে প্রসব করানো।
অপরদিকে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যানসেট-এর তথ্য মতে, সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেক গর্ভবতী মা অপুষ্টিতে ভোগেন। যে কারণে প্রায় ৮৩ হাজার নবজাতকই জন্ম নেয় মৃত অবস্থায়।
নেত্রকোনা জেলা সিভিল সার্জন ডা. তাজুল ইসলাম খান বলেন, দেশের অন্যতম অবহেলিত একটি এলাকা নেত্রকোনা। এখানকার প্রধান সমস্যা মাতৃ ও শিশুমৃত্যু। এটা ঠেকানো জরুরী হয়ে পড়েছে। এছাড়া এখানকার মানুষের গড় উচ্চতা বাংলাদেশের মধ্যে সর্বনি¤েœ (৬৪)। তিনি নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে চিকিৎসকসহ জনবল সঙ্কটে চিকিৎসা সেবা অনেকটা ব্যবহত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।
নেত্রকোনা জেলার তথ্য সূত্র অনুযায়ী, ১ থেকে ২ মাসের শিশুর সংখ্যা ৫ হাজার ৫০৭ জন। শূন্য থেকে ১ বছরের শিশুর সংখ্যা ৬৬ হাজার ৮৭ জন, শূণ্য থেকে ৫ বছরের শিশুর সংখ্যা ৩ লাখ ৩০ হাজার ৪৩৫ জন। ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মহিলা রোগীর সংখ্যা ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭৫৯। হাউজ হোল্ডস (এইচএইচ) ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৩২২।
নেত্রকোনা জেলায় মাতৃমৃত্যু কমাতে পার্টনার্স ইন হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (পিএইচডি) ২০১৪ সাল থেকে ১০টি উপজেলায় ইউনিসেফের আর্থিক সহযোগিতায় ‘আইএইচএন্ডএনএইচএমওয়াইসি’ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। সংস্থাটি কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সক্রিয় করার মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধিতে কাজ করছে। তাই নেত্রকোনার অধিকাংশ এলাকায় আগের তুলনায় কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা গ্রহীতার হার ও সেবা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেবা বঞ্চিত মায়েদেরকে খুঁজে সেবার আওতায় নিয়ে আসছে। পাঁচ বছরেরে কম বয়সী শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করার জন্য (নেত্রকোনা জেলা ২০১৫ সালে অনলাইন রেজিস্ট্রেশনে দেশে প্রথম হয়েছিল) স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠ পর্যায়ের স্টাফরাও সহযোগিতা করছে।
এছাড়াও কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং সেবার মান বৃদ্ধির জন্য ‘মা সমাবেশ’ নামে একটি ইনটারভেনশন পরিচালিত হচ্ছে যার মাধ্যমে গর্ভবতী মায়েদের, রক্তের গ্রæপ নির্ণয়, হিমোগেøাবিন পরীক্ষা, সুগার পরীক্ষা, কাউন্সিলিং, গর্ভকালীন সেবা এবং রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করা হয়। রেজিস্ট্রেশনের পর থেকে সার্বক্ষনিক মায়েদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এখান থেকে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী মা’কে পাওয়া গেলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে রেফার করা হয়। সূত্র মতে, নেত্রকোনার কমিউনিটি পর্যায়ে এই ‘মা সমাবেশ’ ব্যাপক সারা জাগিয়েছে। ২২২টি মা সমাবেশের মধ্যে ৩২টি কমিউনিটির সহযোগীতায় হয়েছে। যেখানে ১৯ হাজার ৮৭৫ জন মা সেবা পেয়েছেন। এছাড়া মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমিয়ে আনা এবং সেবার মান বৃদ্ধি করার জন্য একটি কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যে ব্যবস্থার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ মা ও পাঁচ বছরেরে কম বয়সী শিশুকে উন্নত সেবা নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি পর্যায় থেকে উপজেলা এবং জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়। রেফার ব্যবস্থায়, ২৫৭৬ মা এবং ৯৯৭ পাঁচ বছরেরে কম বয়সী শিশুকে সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
নেত্রকোনা জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোলাম মো. আজম বলেন, পার্টনার ইন হেলথ ডেভলপমেন্ট (পিএইচডি) ভালো কাজ করছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সচেতনতায় তারা মা সমাবেশ ও কিশোরী সমাবেশ। এছাড়া মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমাতে এলাকায় এ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু করা হয়েছে। গর্ভবর্তী মা’রা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই সেবাটি পাচ্ছেন। এই সেবাটি কার্যকরভাবে করতে পারলে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এই এলাকায় কিছুটা হলেও কমবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় অনেক যায়গায় এ্যাম্বুলেন্স সেবা পৌছেনি। এছাড়াও ইউনিসেফ অবহেলিত নেত্রকোনা জেলায় কানাডার আর্থিক সহায়তায় সদর হাসপাতালে স্ক্যানো ওয়ার্ডসহ ১০টি উপজেলায় মা ও শিশুর উন্নয়নে কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন গোলাম মো. আজম। মদন উপজেলার কাপাসাটিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইডার (সিএইচসিপি) মাখন মিয়া বলেন, এখানকার মায়েদের সব ধরনের তথ্য আমাদের কাছে আছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি বলেন, পিএইচডি’র সহায়তায় সবার এলাকার মানুষের অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, তথ্য বোর্ড, স্বাস্থ্য ম্যাপ, মাসিক সভা এবং রেজুলেশন তৈরি এবং রেফারের তথ্য সর্বদা হালনাগাদ করা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ