Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নয়নের জঞ্জাল ফ্লাইওভার

টাকা পায় ছালাম গালি খায় নাছির

শফিউল আলম ও রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সামান্য বৃষ্টি হলেই কদমতলী ফ্লাইওভারের নিচে ফলের আড়তের সামনে জমে যায় কোমরসমান পানি। একই অবস্থা বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের নিচে বহদ্দারহাট মোড়েও। সিটি কর্পোরেশন অভিযোগ করছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় কদমতলী এলাকার ৬ ফুট নালা ভরাট করে ২ ফুটে নিয়ে এসেছে। আর বহদ্দারহাটে নালা মাঝখানে পড়েছে ফ্লাইওভারের পিলার। ফলে ওই দুই এলাকায় পানিবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব সিডিএ’র। অথচ তাদের বিরুদ্ধেই অপরিকল্পিত স্থাপনা প্রতিষ্ঠার অভিযোগ উঠল। গত কয়েক বছরে উন্নয়নের নামে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার বানিয়েছে সিডিএ। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, কোন প্রকার সমীক্ষা বা পরিকল্পনা ছাড়াই এসব ফ্লাইওভার নির্মিত হওয়ায় তার সুফল পাচ্ছেনা নগরবাসী। তারা এগুলোকে উন্নয়নের জঞ্জাল হিসেবে অবহিত করছেন। উন্নয়নের নামে যত্রতত্র ফ্লাইওভার নির্মাণ নিয়ে খোদ সরকারি দলের নেতাদের মধ্যেও রয়েছে বিতর্ক। এ বিতর্কের জেরে সরকারের এক মন্ত্রী ও সাবেক এক মন্ত্রীর একে অপরের প্রতি তেড়ে আসার ঘটনাও ঘটেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক বাহবা পাওয়ার জন্য তৈরি এসব ফ্লাইওভার নগরীর যানজট নিরসনে কোন ভূমিকা তো রাখছেই না বরং আধুনিক মহানগরী হিসেবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ নগরীর বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনাকেই রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
দুই দফা দুর্ঘটনায় ১৪ জন মানুষের লাশের উপর দাঁড়িয়ে গেছে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার। এক কিলোমিটার দীর্ঘ এ ফ্লাইওভারে গাড়ি চলে হাতেগোনা। ফ্লাইওভারের নিচে তীব্র যানজট অথচ পুরো ফ্লাইওভার ফাঁকা- এমন দৃশ্য এখন প্রতিদিনের। প্রায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ফ্লাইওভার যে কোন কাজে আসছে না তা এখন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে। ২০১০ সালে সিডিএ আবদুচ ছালাম হঠাৎ করে নগরীর বহদ্দারহাট জংশনে ৫টি ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেন। প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে এ ৫টি ফ্লাইওভারের ভিত্তিও স্থাপন করা হয়। পরে ওই পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বহদ্দারহাটে একটি এবং মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত আরও একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বহদ্দারহাট জংশনে ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে নগর বিশেষজ্ঞ এমনকি সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরাও অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণের বিরোধিতা শুরু করেন। তাদের যুক্তি ছিল সিডিএ’র মাস্টারপ্ল্যানে ওই এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণের কোন কথা ছিল না। তাছাড়া ফ্লাইওভার যদি হয় তাহলে নগরীর প্রধান সড়ক বিমানবন্দর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত ফ্লাইওভার করা জরুরী। তবে সবার আপত্তি উপেক্ষা করে বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভার নির্মাণ শুরু হয়। নগরীতে কোন স্থাপনা নির্মাণকালে নির্মাণকাজে জড়িতদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সিডিএ’র। অথচ বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণকালে দুই দফা গাডার ধসের ঘটনা ঘটে। প্রথম দফায় প্রাণহানী না ঘটলেও দ্বিতীয় দফায় প্রাণ যায় ১৪ জনের। পঙ্গুত্ববরণ করেন আরও অনেকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ফ্লাইওভারের বাকি কাজ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হওয়ার আগেই কদমতলীতে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও একটি ফ্লাইওভার বানায় সিডিএ। বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের মতো এটিও এখন ফাঁকা। এর পাশাপাশি দেওয়ানহাট জংশনে আরও একটি ওভারপাস তৈরি করে সিডিএ। এরপর মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণ শুরু হয়। শুরুতে এ ফ্লাইওভারের জন্য বাজেট ধরা হয় ৪৬২ কোটি টাকা। কয়েক দফায় ফ্লাইওভারের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়। নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গিয়ে ৬৯৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। রোজায় ঈদের আগে হঠাৎ ফ্লাইওভারটি খুলে দেয়া হয়। এরপর বন্ধ করে দেয়া হলেও কোরবানি ঈদের আগে আবারও ফ্লাইওভারটি খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিডিএ। তবে এখনও ফ্লাইওভারের পুরো কাজ শেষ হয়নি। মূল ফ্লাইওভারের কাজ শেষ করা হলে ২নং গেইট ও জিইসি মোড় এলাকায় ফ্লাইওভারে উঠা-নামার সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ঈদের জন্য এটি খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে উঠানামার সড়কের কাজের জন্য এটি আবার বন্ধ করে দেয়া হবে। ফ্লাইওভারটি কিছুদিন খোলা থাকলেও ওই এলাকায় যানজট কমেনি। কারণ উঠানামার সড়ক না থাকায় ফ্লাইওভারটিতে যানবাহন চলেছে হাতেগোনা। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহদ্দারহাট ও কদমতলী ফ্লাইওভারের মতো এটিও নগরবাসীকে কোন সুফল দেবে না।
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া বলেন, যে কয়টি ফ্লাইওভার দাঁড়িয়ে গেছে তার সবকয়টি অপরিকল্পিত। কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা কিংবা বিশেষজ্ঞের মতামত ছাড়াই এসব নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ফ্লাই অর্থ উড়ে যাওয়া। ফ্লাইওভার দিয়ে নগরীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে হবে। তাহলে যানজট কমবে। কিন্তু যে কয়টি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে তাতে যানজট আরও বেড়ে গেছে। কারণ ফ্লাইওভারে উঠেই যানবাহনগুলোকে আবার নিচে নামতে হচ্ছে। এতে করে ফ্লাইওভারের দুইপ্রান্তে যানজট তীব্রতর হচ্ছে। তিনি বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এ মহানগরীতে ফ্লাইওভারে কয়টি গাড়ি উঠবে সে হিসেব না করে কত মানুষ পার করা যাবে সে হিসেব কষতে হবে। কিন্তু এসব ফ্লাইওভার যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে তাতে ব্যাপকহারে যানবাহন উঠার কোন সুযোগ রাখা হয়নি।
প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার মনে করেন, যত্রতত্র অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার নির্মাণ আধুনিক মহানগরী হিসেবে চট্টগ্রামের বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এসব স্থাপনা উন্নয়নের জঞ্জাল হিসেবে চিহ্নিত হবে। নগরীর যেসব এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণ জরুরী সেসব এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়নি। এ কারণে এর সুফল নগরবাসী পাচ্ছেনা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ