Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সাজানো ছবিতে রোহিঙ্গাদের দায়ী করার ব্যর্থ চেষ্টায় মিয়ানমার!

বিবিসির প্রতিবেদন

ইনকিলাব ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট সহিংসতায় রোহিঙ্গারাই নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে বলে দাবি করছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। আর তাদের এই দাবিকে সত্য প্রমাণ করতেই আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় গণমাধ্যমের একদল সাংবাদিককে। তাঁদের হাতে সাজানো ছবি তুলে দেওয়া হয়। সেই কারসাজি অবশ্য ধোঁকা দিতে পারেনি বিবিসির সাংবাদিক জনাথন হেডসহ অন্য সাংবাদিকদের।
বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিনিধি জনাথন হেড জানতেন, এই ধরনের সরকারি সফরে সরকার যা দেখাতে চায়, তা-ই দেখতে হয়। তবে কখনো কখনো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বোঝা যায় অনেক কিছু।
জনাথন হেড বলেন, প্রথমে তাঁদের রাখাইনে মংডুর একটি স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে বাস্তুহারা হিন্দু পরিবারগুলো ঠাঁই নিয়েছে। পুরো স্কুলটি ঘিরে রেখেছে সশস্ত্র পুলিশ। এখানে আশ্রয় নেওয়া সবাই একই কথা বলছেন রোহিঙ্গারা তাদের ওপর আক্রমণ করেছে, তারা পালিয়ে এসেছে। এর আগে জনাথন হেড বাংলাদেশ সীমান্তে পালিয়ে আসা রাখাইনের হিন্দু বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাঁরা সবাই জনাথনকে বলেন, রাখাইনদের আক্রমণে তারা পালিয়ে এসেছেন। কারণ, তাঁরা রোহিঙ্গাদের মতোই। মংডুর স্কুলটি পরিদর্শনের পর জনাথনের মনে প্রশ্ন জাগে, আসল সত্যটা কী? কিছুক্ষণের মধ্যে জেনেও ফেলেন সত্যটা। সরকারি বেষ্টনীর মধ্যেই স্কুলে আশ্রিত একজনের বক্তব্য নেন জনাথন। ওই ব্যক্তি বলেন, সেনারা গ্রামের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে দ্রুত ওই ব্যক্তিকে শুধরে দেন পাশের জন। তাতেই আসল সত্যটা বুঝে নেন বিবিসির এই সাংবাদিক।
এরপর সাংবাদিকদের দলটিকে স্থানীয় বৌদ্ধমন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও একজন বৌদ্ধভিক্ষু অবিরামভাবে বর্ণনা করেন রাখাইন ও অন্যদের ওপর রোহিঙ্গাদের অত্যাচারের কথা। কীভাবে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা, সে কথা। প্রমাণ তুলে ধরতে সাংবাদিকদের কাছে ছবিও দেওয়া হয়। তবে ছবিগুলো সাজানো বলে ধরতে পারেন জনাথন। একটি ছবিতে রোহিঙ্গা নারী বলে দাবি করা দুজনকে একটি বাড়িতে আগুন লাগাতে দেখা যায়। এই দুই নারীর একজনকে জনাথন মংডুর স্কুলে হিন্দু নারী হিসেবে আশ্রিত হিসেবে দেখেছিলেন। একই ছবিতে ওই দুই নারীর সঙ্গে একজন রোহিঙ্গা পুরুষ বাড়িতে আগুন দিচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়। ওই পুরুষকেও জনাথন দেখেছেন সেই স্কুলে নির্যাতিত হিন্দু হিসেবে আশ্রিত। আরেকটি ছবি স্কুলে আশ্রিত নারীকেই অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন জনাথন।
পরে সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় সীমান্ত নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী কর্নেল ফোন টিন্টের কাছে। তাঁর মুখেও একই বক্তব্য। রোহিঙ্গারা নির্যাতন করছে গ্রামবাসীর ওপর। তিনি দাবি করেন, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা। টিন্টে বলেন, আরসার সদস্যরা রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তারা প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে সদস্য চায় তাদের সংগঠনের জন্য। যারা রাজি হয়নি, তাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। আরসার সদস্যরাই মাইন পেতেছে, তিনটি সেতু ধ্বংস করেছে।
কর্নেল ফোন টিন্টের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, পুরো গ্রাম-ঘরবাড়ি কি আরসাই পুড়িয়ে দিয়েছে? জবাবে তিনি বলেন, এটা শতভাগ নিশ্চিত। সেনাবাহিনী কোনো অত্যাচার করছে না?এমনটা জানতে চাইলে সরকারের ওই প্রতিনিধি বলেন, প্রমাণ কোথায়?
সরকারি নিরাপত্তাবেষ্টনী ছেদ করে অল্প কিছু রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন জনাথনেরা। এই রোহিঙ্গারা প্রত্যেকেই ভীত, আতঙ্কিত, ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চান না। তারপর রোহিঙ্গারা বর্ণনা দেন কীভাবে খাদ্যঘাটতি, তীব্র ভয় থাকা সত্তে¡ও সেনাবাহিনীর ভয়ে পালিয়ে যেতে পারেননি তারা। এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তবে তাদের নেতা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে থেকে যাওয়ার চুক্তিতে যান। আরেকজন জানান, তার মূল ভয় মিয়ানমারের সরকারকে। সাংবাদিকদের মূল ভ্রমণের অংশ ছিল মংডুর উপকূলীয় এলাকা আলেল থান কাউ। এখানেই ২৫ আগস্ট রাতে পুলিশ ও সেনাচৌকিতে হামলা চালিয়েছিল আরসা। সেখান থেকে ফেরার পথে গ্রামের পর গ্রাম কারও দেখা পাননি সাংবাদিকেরা। মংডু থেকে ফেরার পথে বিচ্ছিন্নভাবে অন্তত তিনটি স্থানে ধোঁয়া উড়তে দেখে সাংবাদিকদের দলটি। বনের পাশে থাকা ধানখেত থেকেও বড় ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা যায়। বিষয়টি ভালোভাবে জানতে তাদের বহনকারী পুলিশের ভ্যান থামাতে বলেন সাংবাদিকেরা। ছুটে যান সেই ধোঁয়ার কুন্ডলীর কাছে। তাঁরা আগুনের চিহ্ন দেখতে পান, বুঝতে পারেন আগুনের ঘটনাটি কিছুক্ষণ আগের। সাংবাদিকদের সঙ্গে থাকা পুলিশও দ্রæত সেখানে যায়। ‘এটা নিরাপদ গ্রাম নয়’বলে সেখান থেকে সাংবাদিকদের সরিয়ে নেয় পুলিশ।
রাখাইনের মংডু পরিদর্শন শেষে ফিরে আসার সময় পুড়িয়ে দেওয়া কিছু বাড়িঘর নজরে আসে জনাথনের। তখনো সেখান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের বলা হয়, রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে। তবে কারও সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি সাংবাদিকদের।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ অগাস্ট রাতে একযোগে রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ঘাঁটিতে হামলা পর রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর দমন পীড়নের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। তারপরও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মংডু রাজ্যে কড়া পাহারায় জনাথন হেডসহ ১৮ জন স্থানীয় ও বিদেশি সাংবাদিককে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল মিয়ানমার সরকার। সাংবাদিকদের শর্ত দেওয়া হয়েছিল, সবাইকে একসঙ্গে চলাফেরা করতে হবে। স্বাধীনভাবে কোনো কিছু পরিদর্শন করা যাবে না। শুধু সরকারের নির্দিষ্ট করে দেওয়া জায়গাগুলোই দেখা যাবে। তবে যে কারণে মিয়ানমারের এই চেষ্টা, তা সফল হয়নি। রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে এই সাংবাদিকদের কাছে। সূত্র: বিবিসি



 

Show all comments
  • Shariful islam ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৮:০২ এএম says : 1
    কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছি। শুধু মুসলিম উম্মার কাছে একটা কথা জানিয়ে দিতে চাই। মুসলমান ভাই ভাই।এক ভাই কষ্টে থাকলে অন্য ভাই যদি তার পাশে না দারায় তাহলে বুজতে হবে তারা ..........
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ দেলোয়ার হোসেন ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৯:৫৯ এএম says : 1
    হে আল্লাহ মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি তুমি রহম কর। তাদের দুঃখ দুর্দশা তুমি দূর করে দাও। তাদের তুমি হেফাজত কর। তাদের যার রেকম প্রয়োজন সমস্ত প্রয়োজন তুমি মিটিয়ে দাও। তাদের মনের অশান্তি দূর করে শান্তি দাও। হে আল্লাহ তুমি তাদের সাহায্য কর। তুমিই তো শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী। আমীন
    Total Reply(0) Reply
  • MD Monir ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:১৩ পিএম says : 1
    হায় কোথায় গেলো অাজ বিশ্ব মানবতা যারা বিশ্বের বড়ো বড়ো মোড়ল তারা এতো কিছু দেখার পরও কেনো নিরব ভুমিকা পালন করছে মনে হচ্ছে তাদের কিছুই করার নাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Rafiq Islam ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:১৫ পিএম says : 0
    Yaa Allah save our Muslim brothers and sisters
    Total Reply(0) Reply
  • মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:২৬ পিএম says : 0
    “রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর ইতিহাসের নৃশংস গণহত্যার জন্য নরপিশাচ মায়ানমার সরকারের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়া উচিৎ”
    Total Reply(0) Reply
  • আবু রায়হান ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:২৭ পিএম says : 0
    মানবতার এই রক্তক্ষরণ একদিন হয়তো স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রের বীজ বপণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে ইনশা’আল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • জেরিন ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:৩০ পিএম says : 0
    আরাকানে বৌদ্ধদের এই জঘন্যতম গণহত্যা, বর্বর নির্যাতন ও জাতিগত নিধন পৃথিবীর ইতিহাসকে কলংকিত করেছে। এই নৃশংস গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে নরপিশাচ মায়ানমার সরকারের বিচার হওয়া উচিৎ
    Total Reply(0) Reply
  • কামাল ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:৩১ পিএম says : 0
    মায়ানমারে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন, আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপ, মায়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীর গণহত্যার বিচার এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব ও পুনর্বাসন করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • লোকমান ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:৫৯ পিএম says : 0
    আল্লাহর রহমতে কোন ষড়যন্ত্রই সফল হবে না
    Total Reply(0) Reply
  • রাজিব খাঁন ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১:০০ পিএম says : 0
    বিবেকবান সকল মানুষের উচিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ