Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

৯/১১’র স্মৃতি

| প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম


নিউইয়র্ক থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদ : ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাসীর কাছে দিনটি ৯/১১ বলে পরিচিত। ৯/১১ বিশ্ববাসীর মতো আমার কাছেও এক ভয়াবহ স্মৃতি, ভয়ানক আর মর্মান্তিক ট্রাজেডী। দিনটি ছিলো শনিবার। মনোরম ভোরের আকাশ কেটে সূর্য্যরে রোদ্রোজ্জল আলোয় পৃথিবী জেগে উঠলো। চমৎকার আকাশ। এই আকাশ আর বাতাস দেখে কোন কিছু বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় ছিলো না যে, আজকের দিনটিই হবে পৃথিবীর অন্যতম ট্রাজেডীর দিন, ভয়াবহ অন্ধকারের দিন।
প্রতিদিনের মতো ঐদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি সকালের নাস্তা খেয়ে সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকা অফিসে যাচ্ছি। আমি তখন সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’র বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। আর জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউস্থ আমার বাসা থেকে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ অফিসের দূরত্ব ৮/১০ বøক হওয়ায় সাধারণত হেটে হেটেই অফিসে যাতায়াত করি। অন্যান্য দিনের মতো বাসা থেকে বের হয়ে এক বøক যেতে না যেতেই বাসা থেকে মনিরা ভাবীর ফোন:
-আপনি কোথায়?
--আমি অফিসে যাচ্ছি।
-সকালে টিভি দেখেছেন, খবর শুনেছেন?
--না তো? কেনো, কি হয়েছে?
-ম্যানহাটানে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলা হয়েছে, আগুন জ্বলছে, টিভিতে লাইভ দেখাচ্ছে।
--ঠিক আছে, আমি অফিসে গিয়ে দেখছি।
মনিরা ভাবী, আমার অগ্রজ সাংবাদিক (মরহুম) মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান হাফিজ ভাই’র স্ত্রী। ভাবীর সাথে ফোনে কথা শেষ করে দ্রæত সাপ্তাহিক বাংলাদেশ অফিসে পৌঁছলাম। অফিসে গিয়ে দেখি শ্রদ্ধেয় সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান ও সাংবাদিক আনিসুল কবীর জাসীর ভাই টিভিতে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলার খবরটি লাইভ দেখছেন। সেই সাথে তারা বেশ উদ্বিগ্ন এবং উৎকুন্ঠিত মনে হলো। আমিও তাদের সাথে শরীক হলাম এবং কিছুক্ষণ খবরটি টিভিতে লাইভ দেখার পর ঢাকায় খবরটি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’র বার্তা সম্পাদকের পাশাপাশি আমি তখন দৈনিক ইনকিলাব-এর নিউইয়র্ক প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছি। যতদূর মনে পড়ে তখন ঐদিন নিউইয়র্ক সময় সকাল ১১টা আর বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা। ঢাকায় দৈনিক ইনকিলাব-এ ফোন করেই শ্রদ্ধেয় বার্তা সম্পাদক সুলতান আহমেদ (মরহুম) সাথে কথা বললাম এবং তাকে বিষয়টি জানালে, ওপার থেকে সুলতান ভাই বললেন, আমরাও খবরটি শুনেছি, বিভিন্ন বার্তা সংস্থার খবর আসছে, আপনার কাছে কি খবর আছে পাঠান। সেই সাথে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের খবরাখবরও জানতে চাইলেন। আমি সুলতান ভাইকে বললাম, আমি আবার ফোন করছি।
যাই হোক পরবর্তীতে যতদ্রæত সম্ভব খোঁজখবর নিয়ে আবার দৈনিক ইনকিলাব-এ ফোন করে নিউজটা পাঠালাম। কিন্তু তখনো বুঝে উঠতে পারিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলার ভয়াবহতা! সত্যি বলতে কি আমি ধারণাই করতে পারিনি যে, পর পর বিমান হামলায় কি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে পুরো ম্যানহাটান জুড়ে। জ্যামাইকার ১৬৮ স্ট্রীটস্থ সাপ্তাহিক বাংলাদেশ অফিসে বসে টিভিতে শুধু দেখছিলাম আগুনের লেলিহান শিখা আর আকাশ ছোঁয়া কালো ধোয়া। সেই সাথে সকালে কাজে যোগ দেয়া মানুষ, পথচারী আর ট্যুরিস্টদের মরণপণ ছোটাছুটি। সাবাই ছুঁটছে প্রাণ বাঁচাতে। কালো ধোঁয়ায় অনেকের চেহারই বোঝা যাচ্ছিলো না। রাস্তা-ঘাটগুলো অচেনা হয়ে উঠলো। আর মনে মনে ভাবতে থাকলাম-
১১০ তলা বিশিষ্ট ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার পরিদর্শনের কথা। সেন্টারটির অতি দ্রæত গতি সম্পন্ন লিফট যোগে ১১০ তলার চুড়ায় উঠে পুরো নিউইয়র্ক শহর দেখার স্মৃতি মনের মনি কোঠায় ভেসে উঠলো। এতো উপর থেকে নিউইয়র্কের ঘর-বাড়ী-ভবন আর বৃক্ষগুলো খুবই ক্ষুদ্রকার লাগছিলো। অতি পরিচিত আর বিখ্যাত হার্ডসন রিভার মনে হচ্ছিলো ক্ষুদ্রকারের নালা। নয়ানাভিরাম সেন্ট্রাল পার্ক যেনো সবুজ ঘাসে মোড়ানো। আরো কত কি!
হ্যাঁ, বলছিলাম- ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলার স্মৃতি কথা। দাউ দাউ করে জ্বলছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। সিটি প্রশাসন তথা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ সকল দপ্তরই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আটকাপড়া মানুষদের উদ্বার করতে আর বাঁচাতে। এরই মধ্যে খবর এলো নিউইয়র্কের পার্শ্ববর্তী নিউজার্সীতে আর পেন্টাগনেও বিমান হামলা হয়েছে। ভয়ানক খবর, ভায়বহ অবস্থা। আর এই খবরে পুরো যুক্তরাষ্ট্রবাসী চরম উদ্বিগ, উৎকন্ঠিত হলো। ভীত কেঁপে উঠলো তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডবিøউ বুশ (জুনিয়র) প্রশাসন তথা হোয়াইট হাউজ। খবর পাওয়া গেলো ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলা শুধু হামলা নয়, রীতিমত সন্ত্রাসী হামলা। যে হামলার শিকারে প্রাণ হারিয়েছে ১১জন বাংলাদেশীসহ প্রায় তিন সহ¯্র নর-নারী। যার ভায়াহতা আজো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্ববাসীকে।
ঘটনার পরদিন সন্ধ্যার দিকে আমার প্রতিবেশী শ্রদ্ধেয় কমল ভাই’র সহযোগিতায় তার সাথে গেলাম ব্রæকলীনস্থ সালাউদ্দিন আহমেদের বাসায়। প্রাথমিকভাবে খবর ছিলো এই সালাউদ্দিন আহমেদ ১/১১’র ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন। সিলেটের সন্তান সালাউদ্দিন আহমেদের বাসায় গিয়ে দেখা গেলো ভিন্ন পরিবেশ। লক্ষ্য করলাম, ঐ বাসার লোকজন সবাই আছে, কিন্তু বাসাটি যেনো প্রাণহীন। নেই কোন কোলাহল, থমথমে পরিবেশ, বাসার চারিপাশ নিরব-নিস্তব্ধ। এরই মধ্যে নিখোঁজ সালাউদ্দিনের আতœীয়-স্বজনদের আসা-যাওয়া দেখতে পেলাম। এক ফাঁকে কথা হলো সালাউদ্দিন আহমেদের বড় ভাই’র সাথে। কথার সময় তিনি স্মৃতি আওড়াতে থাকলেন। তারই মাঝে সালাউদ্দিন সম্পর্কে তথ্যাদি জানতে চেষ্টা করলাম। পরবর্তীতে নিশ্চিত খবর এলো ১/১১’র ঘটনায় সালাউদ্দিন শুধু নিখোঁজ নন, তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। অন্যান্য নিহতের সাথে তারও নাম তালিকায় উঠলো।
১/১১’র ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও মজার ঘটনা হলো ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ওদূরে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় দৈনিক ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড স্ট্রীট জার্ণাল’ অফিস ভবন মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পরও বিকল্প পদ্ধতিতে নিউইয়র্কের প্রতিবেশী নিউজার্সী অঙ্গরাজ্য থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত থাকা। একজন মিডিয়া কর্মী হিসেবে বিষয়টি আমার কাছে অভাবনীয় লেগেছে। কেননা, এতো বড় একটি বিপর্যয়ের পরও দায়িত্বশীল দৈনিক পত্রিকা হিসেবে দ্যা ওয়ার্ল্ড স্ট্রীট জার্ণাল-এর প্রকাশ চাট্টিখানী কথা নয়। আর এই বিরল দায়িত্বশীল কাজের জন্য পরবর্তীতে ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড স্ট্রীট জার্ণাল’ আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও লাভ করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ