হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
সংখ্যালঘু নিরিহ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সরকারের নৃশংস গণহত্যা ও পাশব অত্যাচার, এক কথায় বিশ্ব-মানবতার চরম অপমান। মিয়ানমার সরকার তার সেনাবাহিনীসহ সকল শক্তি নিয়োগ করে এই নিরিহ জনগোষ্ঠীর উপর যে নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, যে গণহত্যা সংঘটিত করছে তেমনটি নৃশংস পশু হিসেবে চিহ্নিত হায়েনার মধ্যেও দেখা যায় না। শুধু এখন নয়, বার বার এবং বহু বার মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর এমন নিপীড়ন চালিয়েছে। তাহলে মিয়ানমার সরকার কি পশুর চেয়ে নৃশংস হয়ে গেল? তাদের এমন ঘৃণ্য কর্মকান্ডের ধিক্কার জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
পিতা-মাতা যেমন সন্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ধারক, তেমনি রাষ্ট্র ও সরকার তার নাগরিকদের সামগ্রিক নিরাপত্তার অন্যতম ধারক। রাষ্ট্র কারো উপর নির্যাতন চালালে তার টিকে থাকা অনেকটা অসম্ভব হয়ে যায়। একাধিক সন্তান থাকলে নিরিহ হিসেবে শিশু-সন্তানের প্রতি আদর্শ পিতা-মাতাকে অধিক যত্মবান হতে দেখা যায়। সে হিসেবে মিয়ানমার সরকারের উচিত ছিল, নিরিহ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এমন নিরাপত্তা প্রদান করা যাতে, তাদের উপর কেউ নির্যাতন চালাতে না পারে। মিয়ানমার সরকার চিরন্তন মানবতার এই নীতি ভূলুণ্ঠিত করে নিরিহ রোহিঙ্গাদের উপর যে পাশব অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে মনে হয় ওই দেশে মানুষের চেয়ে পশুর সংখ্যা বেশি। মিয়ানমারের একজন লোকও রোহিঙ্গাদের উপর এমন গণহত্যার জন্য সামান্য সমালোচনাও করেনি। তাহলে সে দেশে কী একজন মানবতাবাদীও নেই? এরূপ নির্বিচার গণহত্যা ও অত্যাচারের ঘটনা বিশ্ব-ইতিহাসে বিরল। মিয়ানমার সরকারের এমন নৃশংসতা হিটলারের নৃশংসতাকেও হার মানিয়ে দিয়েছে।
বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জাড়িত। কেউ যদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার সরকারের থাকে। কিন্তু সন্ত্রাসের অজুহাতে পুরো জাতিগোষ্ঠীর উপর নির্যাতন কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না। একটি জনগোষ্ঠীর সবাই সন্ত্রাসে জড়িত থাকতে পারে না এবং কেউ এ দাবি করলে তা কোনোভাবে সত্য নয়। মিয়ানমার সরকারের দাবি মতে, সকল রোহিঙ্গা যদি সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকত, তাহলে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার তান্ডবে পুরো মিয়ানমার ছারখার হয়ে যেত। এ দিয়ে প্রমাণিত হয়, রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত নয়। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য যেসব উপাদান ও সুযোগ-সুবিধা আবশ্যক তার কোনো কিছুই রোহিঙ্গাদের আয়ত্তে নেই। যদি মিয়নামার সরকারের পক্ষ নিয়ে বলি তাহলে বলতে পারি, রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকলেও পুরো রোহিঙ্গাগোষ্ঠী সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত নয়। তবু মিয়ানমার সরকার সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মিথ্যা অজুহাতে রোহিঙ্গাদের উপর নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে। এটা পুরো মানবজাতির মানবতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিয়েছে। তাহলে বিশ্বমানবতা কী বিশ্বপাশবে পর্যবসিত হতে যাচ্ছে?
যে জাতি বা সরকার রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিক, হোক সে আশ্রিত কিংবা অন্যকোনো প্রাণি প্রভৃতির উপর নির্যাতন চালায় সে জাতি কোনোভাবে সভ্য হতে পারে না। এই হিসেবে বলা যায়, মিয়ানমার রাষ্ট্রটি এখন একটি অসভ্য রাষ্ট্র। যে দেশে নিরিহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নির্বিচার গণহত্যার শিকার হয়, সে দেশটি নিছক বর্বর রাষ্ট্র। যে জাতি একবার এমন অপকর্ম করে, যে ব্যক্তির নেতৃত্ব থাকাকালীন এমন ঘটনা ঘটে সে ব্যক্তি বিশ্ব ইতিহাসে ঘৃণিত হয়ে থাকে চিরকাল। হিটলার এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শান্তির জন্য অংসান সুচির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমরা পুলকিত হয়েছিলাম কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুচির ভূমিকা হিটলারের চেয়েও নির্মম। মিয়ানমারের ঘটনায় সুচির ভূমিকা বিশ্বকে আর একজন হিটলার গছিয়ে দিল। পার্থক্য শুধু এটাই, হিটলার পুরুষ অংসান সুচি নারী। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একজন ব্যক্তি কীভাবে এত নির্মম হতে পারে তা কোনোভাবেই বোধে আসে না। নোবেল কমিটির উচিত অং সান সুচির মতো একজন গণহত্যাকারী রমণীর নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেওয়া নতুবা হিটলার ও মুসোলিনিকে মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত করা। বলা হচ্ছে, নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহার করার নিয়ম নেই। নিয়ম করলেই তো হয়ে গেল। এ তো আর মানুষের জীবনের চেয়ে বড়ো নয়। বরং এর মাধ্যমে নোবেল শান্তি পুরস্কারের যে বদনাম তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা নিয়ে অনেকে সমালোচনা করে বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সহজ প্রবেশাধিকার দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে আলোচনাকালে প্রথমে দেখতে হবে, তাদের যদি সহজ প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় তাহলে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা বিতাড়নে আরো উৎসাহ পাবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের একার পক্ষে এত বেশি সংখ্যক শরণার্থী গ্রহণের সামর্থ্য আছে কি না।
১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা অনেক প্রকট ছিল। সে সময় আমি বালুখালি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলাম। ওই ক্যাম্পে ২০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ছিল। যাদের একজনও প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত ছিল না। তারা ছিল অনেকটা আদিম মানুষের মতো- খাওয়া, ঘুমানো ছাড়া অন্য কোনো কিছু বুঝত না। গোষ্ঠীগত উন্নয়নের চিন্তা দূরে থাক, ব্যক্তিক উন্নয়নেও কোনো ধারণা ছিল না। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুযায়ী মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদ প্রদান করা হতো। তবু, অনেক রোহিঙ্গা নানা কৌশলে ক্যাম্পের বাইরে চলে যেত।
রোহিঙ্গাদের উপর এত নির্যাতন এবং অত্যাচার-অবিচার করার পরও বিশ্ব বিবেক যতটুকু সজাগ হওয়ার কথা ততটুক হচ্ছে না। এর কারণ কী? এর কারণ খুঁজতে গেলে শুধু অন্যদের উপর দোষ দেওয়া যথার্থ হবে না। রোহিঙ্গাদের অযোগ্যতার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা আবশ্যক। আত্মসমালোচনাকে যে জাতিগোষ্ঠী অবহেলা করে, তারা কখনও মাথা তুলে দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। আত্মসমালোচনা মাথা তুলে উঠে দাঁড়ানোর যোগত্যাকে দৃশ্যমান করে সে পথে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। রোহিঙ্গারা দীর্ঘ সাতশ’ বছর আরাকান প্রদেশে বসবাস করে আসছে। কিন্তু যে কারণে হোক না কেন, রাষ্ট্রে তারা নিজেদের শিকড় গেড়ে ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবেলার করার শক্তি বা যোগ্যতা কোনোটাই অর্জন করতে পারেনি। ফলে তাদের মুলা শাকের মতো অতি সহজে নির্বিচারে উপড়ে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। অধিকন্তু রোহিঙ্গারা মেধা, যোগ্যতা ও সৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের অপরিহার্য করেও তুলতে পারেনি। এমন কোনো প্রয়াসও তাদের কর্মকান্ডে লক্ষ করা যায় না। ফলে রাষ্ট্র তাদের উপর এমন নৃশংস আচরণ করে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। তারা যদি শক্ত শিকড় প্রতিস্থাপন করতে পারত তাহলে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে এমন অত্যাচার করে রেহাই পাওয়া সম্ভব হতো না কখনো। রোহিঙ্গারা যোগ্যতা ও মেধা কিংবা কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি বলে প্রতিবন্ধী সন্তান কিংবা অক্ষম পিতামাতার মতো সরকার সহজে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে যেতে পারছে। অনেকে বলবেন, রোহিঙ্গাদের এমন যোগ্য হয়ে গড়ে উঠার জন্য কোনো সাহায্য করা হয়নি, বরং প্রতিহত করা হয়েছে। একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, সহযোগিতা কেউ কাউকে দেয় না, এটি যোগ্যতা বলে যে কোনোভাবে হোক আদায় করে নিতে হয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, God helps those, who help themselves. রোহিঙ্গারা নিজেদের সাহায্য পাওয়ার যোগ্য করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন এটি নিষ্ঠুর হলেও সত্য।
একটা জাতিগোষ্ঠীকে টিকে থাকতে হলে যে শ্রম দিতে হয়, যোগ্যতা অর্জনের জন্য যেসব কৌশল অবলম্বন করতে হয়, তার কোনো কিছুই রোহিঙ্গাদের নেই। এসব বিষয় আয়ত্তে আনার জন্য যে প্রবল উদ্যোগ, ত্যাগ এবং নিষ্ঠা প্রয়োজন সেগুলোও তাদের মধ্যে দেখা যায় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘুদের দিকে তাকালে দেখা যায়, সংখ্যালঘুরাই তুলনামূলকভাবে সংখ্যঘরিষ্ঠদের চেয়ে পরিশ্রমী, মেধাবী। দুর্বল অবস্থানেরর কথা চিন্তা করে সংখ্যালঘুরা শ্রম, মেধা আর নিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এভাবে তারা ধীরে ধীরে শক্ত শিকড় গ্রথিত করে। প্যালেস্টাইনিরা নির্যাতিত বলেই নিজেদের টিকিয়ে রাখার প্রাণন্ত চেষ্টায়রত। ফলে প্যালেস্টাইনিদের মধ্যে মাস্টার্স ডিগ্রির গড় হার তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত দেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মধ্যে শিক্ষিতের হার তুলনামূলকভাবে সংখ্যাঘরিষ্ঠদের চেয়ে বেশি। কিন্তু রোহিঙ্গারা এমন একটি জাতিগোষ্ঠী, যারা সংখ্যালঘু এবং দুর্বল জেনেও নিজেদের অবস্থানকে সবল করার সামান্য উদ্যোগও কখনও ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সমষ্টিগতভাবে নেয়নি। এর মাধ্যমে আমি এটি বলতে চাইছি না যে, অন্যের সাহায্য নিষ্প্রয়োজন। আমি বলতে চাইছি, যোগ্যতাই অন্যের সাহায্যকে প্রভাবিত করে। আর কেউ যদি সাহায্য না করে তাহলে কী বসে বসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে? রোহিঙ্গাদের উচিত শ্রম, নিষ্ঠা আর মেধার মিলন ঘটিয়ে নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা এবং বিশ্বের উচিত তাদের প্রয়াসকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। শুধু অন্যের সাহয্যের আশায় বসে থাকলে রোহিঙ্গাদের এভাবে বার বার নির্যাতিত হতে হবে। আমি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের এমন নৃশংসতার তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ জানাই এবং তা প্রতিরোধের জন্য বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।