Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জনগনের আপদে-বিপদে সেনাবাহিনী কতটুকু পাশে আছে?

উ প স ম্পা দ কী য়

পারভেজ হায়দার | প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ছোটবেলা থেকেই আর্মির প্রতি ছিল দূর্নিবার আকর্ষণ। আর্মির পোশাক, ঢা-ঢা গুলির আওয়াজ আমাকে আকর্ষণ করতো। সেই সময়ে টুকটাক ইতিহাসের বিভিন্ন বই যখন পড়তাম, বিশ্বের নামকরা নেতাদের সাথে কোন না কোনভাবে আর্মির যোগসূত্র খুঁজে পেতাম। মনে হতো, একজন নেতা হতে হলে আমাকে আর্মি হতে হবে । কিন্তু আমার এই স্বপ্ন দুদু’বার হোঁচট খেয়েছে। শুনেছিলাম ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলে নাকি সহজে আর্মি হওয়া যায়। ক্যাডেট কলেজের ক্লাশ সেভেন থেকে ইউনিফর্ম পরা সুশৃঙ্খল জীবনের শুরু হয়, যা পরবর্তীতে একজন সফল আর্মি হতে অনেক কাজে লাগে।
কিন্তু ক্লাশ সেভেনে ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় কেন যেন উতরে যেতে পারলাম না। স্বপ্ন যাত্রার এই ক্ষণে হোঁচট খেয়ে অনেকটা দুঃখ নিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে গেলাম, আর এক সময়ে কলেজের গন্ডি পার হলাম। রেজাল্টও নেহায়েত খারাপ করলাম না। আমার সহপাঠী বন্ধুরা যখন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আশায় মেডিকেল কলেজ আর বুয়েটে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমার ছোটবেলার সেই স্বপ্ন পূরণে দ্বিতীয়বারের মত চেষ্টা করলাম । আমি মেডিকেল কলেজ বা বুয়েটে ভর্তির চেষ্টা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করলাম, কিন্তু এবারও আমাকে হোঁচট খেতে হলো। ওরা যে কি চায়, তা আমি আজও বুঝিনা। আমার মনে হয়েছিল, আমার পরীক্ষা যথেষ্ট ভালো হয়েছে, আমার শারিরীক গঠনও ভালো, আর আমি ভালো দৌঁড়াতেও পারি। তারপরও কেন যেন ওদের পাশ নম্বরের মাপকাঠিতে আমি পৌঁছাতে পারলাম না ।
ছেলেবেলা থেকেই আর্মি হওয়ার স্বপ্ন এভাবে ভেঙ্গে যাওয়ার পর, ওদের উপর আমার একপ্রকার ঘৃণা কাজ করতো । এরপর একটু দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পছন্দের সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে জীবনটাকে নতুন করে গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমাদের শিক্ষক, ছাত্রনেতা এমনকি সাধারণ ছাত্রদের মাঝে সেনাবাহিনীর প্রতি এক প্রকার অপছন্দ, বিরক্তি আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ঘৃণা আমার চোখে পড়েছে । আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম তখন একটা শ্লোগান প্রায় ছাত্রনেতাদের মুখে শুনেছি, ‘সামরিক খাতে ব্যয় কমাও, শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াও’।
আর্মি হবার স্বপ্ন ধুলিস্মাত হবার পর ওদের (আর্মিদের) প্রতি আমার পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, তৎকালীন আমার শিক্ষক, ছাত্রনেতা আর বন্ধুদের মনোভাব আর মন্তব্যের সাথে মনের অজান্তেই একমত পোষণ করতে অনুপ্রাণিত হতাম । ওদের মতো আমিও ভাবতাম সেনাবাহিনীর লোকজন খুব আরাম-আয়েশে দিন কাটায়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখে না, এদেশে কখনো যুদ্ধ হবে নাকি ! এত বড় সেনাবাহিনী পুষে লাভ কি, বাজেটের বড় অংশই সেনাবাহিনীর পিছনে খরচ হয়, একটা গরিব দেশের জন্য এই সেনাবাহিনী কি আদৌ দরকার আছে ! সেনাবাহিনীর লোকজন সবাই ফ্রি খায়, দেশের গরীব লোকজন খেতে পায় না ! ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট শহরের অর্ধেক জায়গা দখল করে আছে, ক্যান্টনমেন্টগুলোতে ঢুকতে হলে প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হয়, ঢাকা শহরে যানজট ক্যান্টনমেন্টের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে এমনি আরও অনেক মন্তব্য ও বক্তব্যের সাথে আমি সহমত প্রকাশ করতাম ।
ছাত্র জীবনের সে সময়গুলোতে আমার পড়াশুনার বিষয়ভিত্তিক বই ছাড়া, গবেষণামূলক কোন বিষয়ে সময় নিয়ে পড়াশুনা করার সময় পেতাম না, তাই সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের শিক্ষকদের মনোভাব, ছাত্রনেতাদের বক্তব্য, টেলিভিশন আর পত্র পত্রিকায় নাগরিক সমাজের কর্তা ব্যক্তিদের লেখনী এবং সর্বোপরী সেনাবাহিনীর প্রতি আমার দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ সব মিলিয়ে সেনাবাহিনীকে আমার কাছে এক প্রকার প্রতিপক্ষ হিসেবে মতো হতো ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে যখন কর্মজীবনে এলাম, তখন আমার কর্মস্থলের কর্তা ব্যক্তিদের দেশের স্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ড, আমাকে সার্বিক বিষয় নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখার জন্য প্ররোচিত করলো । সবচেয়ে আমাকে হতাশ করেছিল স্বার্থান্বেষী নাগরিক সমাজের কর্তা ব্যক্তিদের ভূমিকা । এছাড়া দেশের স্বার্থ পরিপন্থি বিষয়গুলোতে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আশানুরূপ গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা দেখে আমি ব্যথিত হতে শুরু করলাম । কোন কোন ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থে সরকার সুচিন্তিত কোন সিদ্ধান্ত নিলে তথাকথিত নাগরিক সমাজের বিপক্ষে অবস্থানগ্রহণ আমাকে আশ্চার্যাণ্বিত করে তুলতো ।
সরকার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেশের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীদের তাদের ২০০৭ সাল থেকে নতুন দাবী অনুযায়ী ‘আদিবাসী’ না বলে ‘ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী’ বলে ডাকার জন্য সার্কুলার জারী করেছে । যদি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আসলেই তারা আদিবাসী হতো তাহলে কোন আপত্তি ছিল না । কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা ‘আদিবাসী’ নয়, বিষয়টি ধ্রুব সত্য। তারা ২০০৭ সাল থেকে হঠাৎ করেই “আদিবাসী” হতে চাইছেন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে না তা নয়, তারা তাদের ব্যক্তিগত মুনাফা বিবেচনায় দেশের স্বার্থ বিরোধী জেনেও উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ বলে ডাকেন। এক্ষেত্রে তারা দেশের প্রচলিত আইনের বিধি নিষেধ এর কোন তোয়াক্কা করেন না। এমনিভাবে অনেক বিষয়ে ক্রমান্বয়ে তাদের বক্তব্যের সাথে যখন বাস্তবের অমিল খুঁজে পেলাম তখন আমাকে একটু নড়েচড়ে বসতেই হলো। এরই মধ্যে অবসর সময়ে বিভিন্ন প্রকার বই, প্রবন্ধ, দেশ বিদেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের লিখিত ইতিহাস ইত্যাদি অধ্যয়নের পর আস্তে আস্তে আমার উপলব্ধির পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হলো।
এখন কোন বিষয় সামনে আসলে, বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত তথ্যের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশুনা করে সত্য জানার জন্য অভ্যাস গড়ে তুললাম । ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক শিক্ষা আমাকে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে সব সময়ে উৎসাহিত করতো । ছাত্র জীবন আর দীর্ঘ কর্ম জীবনের এই পর্যায়ে আমার ছোট্ট উপলব্ধি হচ্ছে, কোন প্রতিষ্ঠানের শক্ত মেরুদন্ডের ভিত্তি হচ্ছে ‘সততা’। আমার মনে হয়েছে, কাজের ক্ষেত্রে সংস্থার কেউ কেউ ভুল ভ্রান্তি করতেই পারে, তবে ঐকান্তিক ইচ্ছা আর সততার সাথে যদি দেশপ্রেম থাকে তাহলে সেই সংস্থার সাফল্য মোটামুটি সুনিশ্চিত ।
লেখার মত অনেক বিষয়ই আছে, তবে আজ আমি আমার ছোটবেলার পছন্দের সেনাবাহিনী যাদের পরবর্তীতে আমি ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম তাদের কিছু কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সেনাবহিনী নিয়ে আমার বর্তমান এই ভাবান্তর গত ১১ জুন ২০১৭ তারিখে রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের পর দুইজন সেনা অফিসার আর দুইজন সৈনিক পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাতবরণের খবরটি শুনবার পর থেকে।
সেনাবাহিনীতে আমি কাজ করার সুযোগ না পেলেও আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদবীতে কাজ করছে । তাদের বিভিন্ন ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে পাহাড় ধসে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন ৪ জন (শহীদ মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, শহীদ ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম, শহীদ কর্পোরাল মো. আজিজুল হক এবং শহীদ সৈনিক মো. শাহিন আলম) এবং আহত ১০ জন সেনাসদস্য সম্পর্কে জানতে পারলাম । এদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন এবং দেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা সবকিছু আমাকে সেনাবাহিনীর প্রতি মনের ভিতর পুষে রাখা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যেন ক্রমান্বয়ে আমার পুষে রাখা পুরোনো উপলব্ধি পরিবর্তনে পুনরায় ভাবার জন্য তাগাদা দিচ্ছিল। শহীদ মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক এবং তার অধিনস্ত সৈনিকগণ সেদিন কারও অনুরোধের জন্য অপেক্ষা করেননি, তারা পাহাড় ধসে বিপদগ্রস্ত মানুষদের উদ্ধারে নিঃস্বার্থভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল । পাহাড় ধসে উদ্ধারের বিষয়ে হয়তো তাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না, কিন্তু দেশের মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে নিজেদের কর্তব্য মনে করেই তারা সেদিন এগিয়ে গিয়েছিল ।
গত ১ জুলাই ২০১৭ তারিখে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে নৃশংস জঙ্গি আক্রমণের একবছর পূর্তি হলো । যতদূর মনে পড়ে, সেদিন হলি আর্টিজান বেকারির ভিতরে জঙ্গি নৃশংসতার বলি হয় দেশী-বিদেশী মোট ২০ জন নাগরিক। এদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপনী, ১ জন ভারতীয়, ১ জন বাংলাদেশী/আমেরিকান এবং ২ জন বাংলাদেশী নাগরিক ছিল । প্রাথমিকভাবে এই ধরনের জঙ্গি হামলা মোকাবেলায় পুলিশের আভিযানিক প্রস্তুতি ও যথেষ্ট সক্ষমতা না থাকায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলকে ঐ অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সেনাবাহিনী তাদের কমান্ডো অভিযানে দেশী-বিদেশী মোট ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন মিডিয়া ও প্রকাশনায় পুলিশের সাফল্যকে ফলাও করে প্রচার করা হলেও মূলত গত বছরের ঐ দিনে সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের প্রয়োজন ছিল বিধায় তাদেরকে অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে একটি বিষয় অনস্বীকার্য যে, পুলিশের দুইজন সদস্য তাদের অভিযানের শুরুতেই জঙ্গিদের নিক্ষেপকৃত গ্রেনেডের আঘাতে নিহত হয়েছিল। তাই পুলিশ বা সেনাবাহিনীর সাফল্যের মাপকাঠিতে কার ভূমিকা কত বেশি সেই বিতর্কে না গিয়ে, যার যার অবস্থান থেকে তাদের ভূমিকার জন্য যথাযথ স্বীকৃতি অবশ্যই দিতে হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকশ কমান্ডো দল নিজেদের কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অতি অল্প সময়ে জঙ্গিদের নির্মূল করতে যে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে, সারা বিশ্বের কাছে তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে । আমরা যারা নিয়মিত একটু খোঁজ খবর রাখি তারা নিশ্চয়ই সহজে অনুধাবন করতে পারবো যে, উন্নত বিশ্বে অর্থাৎ ইউরোপ বা আমেরিকায় এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলা মোকাবেলার সাফল্যের তুলনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের মত এমন ঈর্ষণীয় সাফল্য খুব কম ক্ষেত্রেই হয়েছে ।
গত মার্চ ২০১৭’তে সিলেটের শিববাড়ী এলাকার আতিয়া মহলে জঙ্গি হামলা দমনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ এ সাফল্যজনকভাবে অংশগ্রহণ করে নিজস্ব কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই জঙ্গিদের সমূলে নির্মূলসহ আতিয়া মহলে অবস্থানরত ৭৮ জন নিরীহ পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয় । আতিয়া মহলের মত বিশাল আকারের ভবনের মধ্যে থেকে জঙ্গিদের নির্মূল শেষে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে উদ্ধারের বিষয়টি নিঃসন্দেহে তাদের উন্নত পেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করে ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। খাগড়াছড়ি জেলার দূর্গম সাজেক এলাকায়, বান্দরবানের দূর্গম থানচি এলাকায় ক্ষুধার্ত, খাদ্যাভাব পীড়িত সাধারণ উপজাতিদের কাছে হেলিকপ্টারে করে অথবা নিজেরা পায়ে হেটে দূর্গম পাহাড় ডিঙ্গিয়ে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার ঘটনা তো প্রায় প্রতি বছরই ঘটছে । গত বছর কোন একটি পত্রিকায় পড়েছিলাম সাজেকের দূর্গম এলাকায় মহামারি আকারে ডায়রিয়া আর অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে । ঐ সময়ে ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতি দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে দূর্গম পাহাড়ের মধ্যে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করে সেখানে ৩৫০-৪০০ মহামারী আক্রান্ত রোগীদের পরম যত্মের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলে । যত দূর মনে পড়ে, দূর্গম ঐ এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের আহার বিশ্রামের বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে, ১০ দিন যাবৎ বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা সেবা এবং জনস্বার্থমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল ।
গত মাসে রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য শহীদ হবার পর থেকে আমার যখন বোধদ্বয় শুরু হলো, আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের বিষয়ে জানার চেষ্টা করলাম । মুক্তযুদ্ধকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত সবসময়ে বাংলাদেশের মানুষ যখন কোন আপদে/বিপদে পড়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে কোন না কোনভাবে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে, এমন ঘটনা অসংখ্যবার ঘটেছে। যেসকল ঘটনা আর ইতিহাস এই সীমিত পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না।
তবে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, বিগত ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালের বহুল আলোচিত ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর যে মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রায় ২৫০০ আহত নারী-পুরুষকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল । পরবর্তীতে রানা প্লাজার ধসে যাওয়া ভবনের ধ্বংসস্তুপ অপসারণের কাজটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরাই করেছিল । বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ যেকোনো প্রকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বড় ধরণের দূর্যোগে সেনাবাহিনীকে সবার আগে ডাক পড়ে। অথবা অগতির গতি হিসাবেও সেনাবাহিনীর ডাক পড়ে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে সেনাবাহিনী সম্পর্কে যে সকল নেতিবাচক বক্তব্য শুনেছি তার মধ্যে বহুল আলোচিত একটি হলো সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বাজেটের বড় একটি অংশ খেয়ে ফেলছে । কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি নিজে সেই বিশ্বাস ধারন করে ছিলাম । কিন্তু পরবর্তীতে সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবর করতে গিয়ে জানতে পারলাম সেনাবাহিনীর জন্য বাজেট, দেশের বাজেটের সব খাতগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে তো নয়ই বরং অনেক পিছনে অবস্থান করছে । আর বরাদ্দকৃত এই বাজেটের বড় অংশই চলে যায় সেনাবাহিনী সদস্যদের বেতন ও ভাতা সংকুলানে।
তবে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন জাগতে পারে সেনানিবাসগুলো এত পরিপাটি আর সুন্দর থাকে কি করে? অনেকের মধ্যেই এমন মনে হতে পারে ক্যান্টনমেন্টগুলো সেনাবাহিনীর বিপুল অংকের বরাদ্দ ব্যবহার করে সৌন্দর্য রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় । আসলে বিষয়টি তা’ নয়, সেনাবাহিনীর মধ্যে চমৎকার শৃঙ্খলা এবং সততা এখনো টিকে আছে বিধায় স্বল্প বরাদ্দকৃত অর্থের মাধ্যমেই সেনাবাহিনী নিজেদের সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে । উন্নত বিশ্বের সেনাবাহিনীর মত অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে না থাকলেও, সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহারের কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমান্বয়ে আধুনিকরণ সম্ভব হচ্ছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আর ইন্টারনেট সূত্রের মাধ্যমে জেনেছি, সেনাবাহিনীর প্রতিটি বিভাগেই আধুনিকায়নের জন্য জোর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের বড় অংশের বিশ্বাস চিন্তাধারা আর তাদের পথ প্রদর্শনকারী শিক্ষক সমাজের মনস্তাত্তি¡ক ভাবনা সব কিছুতেই সেনাবাহিনী সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মনোভাব আর প্রচারণা দৃশ্যমান । বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের সমাজ থেকেই যোগদান করে। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীও আমাদের সমাজেরই অংশ। দেশের মানুষের আপদে বিপদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেভাবে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যায়, তাতে মনে হয় ওরা তাদের সামাজিক এই দায়বদ্ধতা ভালোভাবেই পালন করছে।
কালের পরিক্রমায় অনেক কাজের ভিড়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়, হয়তো তাদের কিছু কিছু কার্যক্রম সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়েছে, হয়তো তাদের কিছু বিপথগামী সদস্য কিছু ভুলভ্রান্তি করেছে, তবে সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে নেতিবাচক ঐ বিষয়গুলোকে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখতে চাই ।
সেনাবাহিনীর মত বড় এই সংগঠন, যারা শৃঙ্খলা আর সততার সাথে কাজ করছে, জাতিসংঘ মিশনসহ বিভিন্ন বৈদেশিক দায়িত্ব পালনে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উঁচু মানের পেশাদারিত্বের পরিচয় দিচ্ছে, সেই সেনাবাহিনীর প্রতি অসন্তুষ্টি নয় বরং মনস্তাত্তি¡কভাবে তাদের উৎসাহ দিয়ে সাধারণ মানুষের বিপদে এবং দেশ মাতৃকার বিভিন্ন উন্নয়নে তাদের অধিক সম্পৃক্ত করতে পারাই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল।
স্বপ্নের এই সেনাবাহিনীতে আমি যোগদান করার সুযোগ না পেলেও আমার সমাজের ভাইয়েরাই তো ওখানে আছেন । তাদের ভালো কাজে অর্জিত গর্বে আমরাও অংশীদার হতে পারি । বর্হিঃবিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেট, এ দেশের গার্মেন্টস ছাড়া আর যে বিষয়টি এ দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে তা হচ্ছে, জাতিসংঘে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সংখ্যক অংশগ্রহণ । এই দেশ আমাদের সকলের। গর্বের যতসামান্য বিষয়গুলো নিয়ে অহেতুক বির্তকে না জড়িয়ে, ইতিবাচক গ্রহণযোগ্যতার মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের আপন করে নিয়ে একসাথে কাজ করাই শ্রেয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ