Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলা ছবি করবো এটাই আমার লক্ষ্য ছিল -রাজ্জাক

স্মরণ

বিনোদন ডেস্ক : | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম


অমর নায়করাজ রাজ্জাক জীবনে অসংখ্য সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বলেছেন, বাংলা চলচ্চিত্রের ভাল-মন্দ এবং অগ্রগামিতার কথা। যতদিন বেঁচে ছিলেন বলে গেছেন। পাশাপাশি চলচ্চিত্রে তার ভূমিকা এবং ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও কথা বলেছেন। বেশ কয়েক বছর আগে গণমাধ্যমে তার দেয়া একটি
বিশেষ সাক্ষাৎকারের বিশেষ অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।


আপনি প্রথম কিভাবে সিনেমায় এলেন?
আমি তো প্রথমে স্টেজে কাজ করতাম। আমি তো রেগুলার স্টেজ আর্টিস্ট ছিলাম এবং তিন চারটে গ্রুপের সাথে কাজ করতাম।
আপনি মূলত মঞ্চ থেকে এসেছেন?
অব্যশই মঞ্চ। তারপর চলচ্চিত্রে। কোলকাতার দুএকটি ছবিতে কাজ করেছি। একটি মঙ্গল চক্রবর্তীর পঙ্কতিলক। অভীক চ্যাটার্জীর এতটুকু আশা। তারপর আমি ঢাকায় চলে আসি।
কত সালে ঢাকায় আসেন?
১৯৬৪ সালে। এসে এখানে বহু নাটক-টাটক করি। মঞ্চনাটক করি। অনেক নাটক করেছি। আলী ইমাম সাহেবের করেছি, জহিরুল হক সাহেবের নাটক করেছি। পরবর্তী পর্যায়ে চলচ্চিত্রের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠায় কিছুদিন সহকারী হিসেবে কাজ করলাম। টেলিভিশনেও কিছুদিন কাজ করলাম। তারপর জহির রায়হানের সাথে যোগাযোগ হলো। উনি আমাকে প্রথম সুযোগ দিলো বেহুলা চলচ্চিত্রে। তারপরতো একটার পর একটা ছবি করতে থাকি।
জহির রায়হান স¤পর্কে আপনার কি কি মনে পড়ে?
জহির রায়হান স¤পর্কে বলতে গেলে তো অনেক কিছু বলতে হয়। তাঁর স্নেহ, ভালোবাসা ছাড়া আমার এখানে আসা সম্ভব ছিলো না। আমার জীবনে জহির রায়হানের যে অবদান, যে স্নেহ, ভালোবাসা ছিলো তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমি শ্রদ্ধার সাথেই তা স্মরণ করি। একজন শিল্পীকে দাঁড় করানোর জন্যে, তাকে গাইড করার জন্যে যা যা করা দরকার তার সবই তিনি করেছেন আমার বেলায়। এরকম ব্যক্তিত্ব আর আসেনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। জহির রায়হানের অবদান বিশেষ করে আমার জীবনে বিরাট। এর পর আমার স্ত্রী।
আপনি ছবি শুরু করার আগেই বিয়ে করেছিলেন?
আমি খুব আর্লি বিয়ে করি।
কত বছর বয়সে?
২০ বছর বয়সে।
এতো কম বয়সে বিয়ে করলেন কেন?
আমি খুব কনজারবেটিভ ফ্যামিলির ছেলে। আমাদের ফ্যামিলির কেউ এই লাইনে ছিলো না। আমি যখন কোলকাতায় প্রচুর নাটক করছি, বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি বাড়ির লোক চিন্তায় ছিল, কখন কোন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলি। এই জন্যে তারা বললো যে বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করলাম।
আপনার পছন্দেই করলেন?
না, পারিবারিক পছন্দ। প্রথম যে মেয়েকে দেখাতে নিযে গেছে তাকে আমার পছন্দ হয়নি। দ্বিতীয় মেয়ে যে আমার স্ত্রী, তাকে দেখলাম, মত দিলাম বিয়ে হবে। ওর আসল নাম খায়রুননেসা। আমি আদর করে ওকে ল²ী ডাকি।
আপনি ভাবীকে আদর করে ল²ী ডাকেন, ভাবী আপনাকে এরকম আদর করে অন্য কোনো নামে ডাকে কিনা?
ও আমাকে আদর করে সব সময় হিরো বলে ডাকে। আগে থেকেই। যখন নাটক করতাম তখন থেকেই।
এখনো হিরো বলে ডাকে?
এখনো হিরো ডাকে। ওর ডাকার কারণে আমার নাতনীরাও হিরো বলে।
এখন ফিল্মে যে পলিটিক্স তাতে করে অনেকেই ভালো ছবি করতে চাইলেও করতে পারে না। বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। এটা কি সত্যি?
ষড়যন্ত্র বলবো না। এখন ফাইনান্স যারা করছে, তারা পুরোপুরি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিস¤পন্ন।
আপনি ছবির কাহিনী বাছাই করেন কিভাবে?
আমার নিজের ছবিগুলোতে কাহিনীকারকে ডাকি, তাকে মোটামুটি একটা আইডিয়া দেই। আর যেগুলো উপন্যাস দিয়ে চাঁপাডাঙ্গার বউ করেছি, বৈকুন্ঠের উইল অবলম্বনে সৎ ভাই করেছি। উপন্যাস থেকেই করেছি। কিন্তু তার মধ্যে এডিশন হয়েছে, কিছু চেঞ্জ হয়েছে, তবে উপন্যাস থেকেই হয়েছে নরমালি। যখনই একটা ছবি আমরা বানাই একটা সাবজেক্ট মাথায় থাকে। আইডিয়া থাকে গল্পটা এরকম হওয়া উচিত।
কোন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে আপনি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন?
যাদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি আমার সময়ে সবার একটা ঘরানা ছিলো, একটা স্কুল ছিলো, প্রত্যেকের সঙ্গে আমার অ্যাডজাস্টমেন্ট ছিলো। এদের মধ্যে সুভাষ দত্ত ভালো, কাজী জহির সাহেব আনডাউটলি সোশ্যাল ছবির ব্যাপারে হি ওয়াজ এ নাইস ম্যান। মুস্তাফিজ সাহেবের সঙ্গে কাজ করেছি। তারও একটা স্কুল ছিলো। কামাল আহমেদ সাহেব ছিলেন। এর মধ্যে আমি কাজ করে আরাম পেয়েছি জহির রায়হান সাহেব এবং কাজী জহীর সাহেবের সঙ্গে। এরপর আছেন কামাল আহমেদ, গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
আপনি তো কমেডি ছবিতে খুব কম অভিনয় করেছেন?
কমেডি মানে আমার যে কমেডি, সিরিও কমেডি। আমার ঐ সময়ের সব ছবিতে ফার্স্ট হাফে প্রচন্ড কমেডি থাকতো। সেকেন্ড হাফে গিয়ে সিরিয়াস হয়ে যেতো। একটা ইয়াং তরতাজা ছেলের যা হয় আর কি। সে সময় তো আর মারামারি ছিলো না। তখনকার অ্যাকশনটা ছিলো আপনার কমেডি করা, টিজ করা গান গাওয়া।
তেরো নং ফেকুওস্তাগার লেন-এ তো ছিলেন?
আমি এক্সটা আর্টিস্ট ছিলাম। যাই হোক, কমেডি ছবি বা সাসপেন্স মুভি এগুলো কিন্তু একবার দেখার পর আপনি আবার হলে যাবেন না। ইন্টারেস্ট শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু রোমান্টিক ছবি একবার দেখে ভালো লাগলে আবার ৭ দিন পর মনে হবে ছবিটা আবার দেখি। যেই রিপিট হয় তখনই ছবি হিট হয়। সব দেশেই ছবি রিপিট না হলে কিন্তু সুপারহিট হয় না। আমাদের দেশে কমেডি ছবি একবার দেখার পর আর কেউ দেখতে চায় না। আর সাসপেন্স মুভিও তাই, হরর মুভিও তাই। যার কারণে এই ছবিগুলো আমাদের এখানে হয় না।
কমেডি নাটক তো আমাদের এখানে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে...
নাটক আর মুভি তো আলাদা জিনিস। মিডিয়াই আলাদা। ওখানে যাচ্ছেন আপনি অন্য নজর নিয়ে। টিভি দেখছেন আপনি অন্য নজর দিয়ে। কিন্তু যখন আপনি ছবি দেখতে যাচ্ছেন, তখন আপনি অনেক কিছু চাচ্ছেন। অনেক কিছু আশা করে যাচ্ছেন। এই হবে, এই হবে, টেকনিক্যাল এই হবে।
সুস্থ্য চলচ্চিত্রের একটি বিকল্প ধারা হিসেবে শর্ট ফিল্ম আন্দোলন হচ্ছে এদেশে। এ ধারাকে কতটা সুস্থ্য মনে করেন?
এটা ভালো। যদি ব্যাপকভাবে করতে পারে তাহলে ইন্ডাস্ট্রির উপকার হবে।
কিন্তু তারাতো আপনাদের ইন্ডাস্ট্রির বাইরে থেকে কাজ করছেন, তারা তো প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভ‚মিকায় রয়েছেন?
প্রতিষ্ঠানবিরোধী হলে তো হবে না। এর মধ্যে থেকেই কাজ করতে হবে। এছাড়া বেশি দূর এগুতে পারবে না। একঘরে হয়ে থাকবে। নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ ভাবলে তো হবে না। আলাদা হয়ে কোনো কিছু করা সম্ভব না। এটা হলো ঢেঁড়স বাগানে লাল শাক চাষ করার মত ব্যাপার। কিন্তু বাগানটাকে আপনি ঢেঁড়স বাগানই বলবেন।
চিত্রালীর স¤পাদক আহমেদ জামান চৌধুরীকে আপনি একবার ঘুষি মেরে রক্ত বের করে দিয়েছিলেন। এমন কেন করেছিলেন?
না, না, এটা আসলে বলার মত কোনো ব্যাপার নয়। তিনি আমার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এটা বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে ঘটেছে। ওনার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক।
বিয়ে করার পর অন্য কোন মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন?
না, ঠিক প্রেম নয়। তবে বন্ধুত্ব হয়েছে অনেকের সাথেই।
শোনা যায়, কবরীর সাথে আপনার প্রেমের স¤পর্ক ছিলো। তার ঘরও নাকি ভাঙালো এই জন্যে।
না না, এটা ঠিক নয়। তার সাথে আমার খুব ভালো স¤পর্ক ছিলো। আমরা যেহেতু খুব জনপ্রিয় জুটি ছিলাম, তাই লোকজন মনে করতো আমাদের মধ্যে প্রেমের স¤পর্ক রয়েছে। এটা আসলে একটা গুজব।
সিনেমার সঙ্গে রাজনীতির স¤পর্ক কতখানি?
সিনেমার সঙ্গে রাজনীতির স¤পর্ক তো অবশ্যই আছে। বাংলা সিনেমায় তো গণতন্ত্রের শুরু হয়েছে পাগলা রাজা সিনেমার মাধ্যমে। পাগলা রাজায় রাজা বেশ অন্যরকম। সে চায় ডেমোক্রেসি। প্রজাদের সঙ্গে বসে খেতে চায় সে। এজন্যেই শেষ পর্যন্ত সে বিপদে পড়লো।
আমাদের তো ছোট একটি দেশ। ছবিও বোধহয় ভারতের তুলনায় একটু পরে শুরু হয়েছে। তারপরেও এত ছবি তৈরি হলো কিভাবে?
আমাদের দেশে বাইরের ছবির প্রোটেকশনটা ছিল। পাকিস্তান আমলে চলতো পাকিস্তানি ছবি আর বাংলাদেশী ছবি। আমি আসার আগে এখানে কিন্তু উর্দু ছবিই বেশি ছিলো। লোকাল প্রডিউসারও উর্দু ছবি করতো। বাংলা ছবি তখন একটা দুটা হতো। তখন একটা গ্রæপ ছিলো; ফতেহ লোহানী সাহেব ছিলেন, জহির রায়হান সাহেব ছিলেন। এরা বাংলা ছবি করতেন। ম্যাক্সিমাম যারা প্রতিষ্ঠিত প্রডিউসার ছিলো তারা উর্দু ছবিই বেশি করতেন। আমি আসার পর বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা,আনোয়ারা এসব সিনেমা নির্মিত হওয়া শুরু করে। এভাবে বাংলা ছবি চলতে শুরু করলো। তার আগে রূপবান হয়েছে। কিছু ফোক ছবি হয়েছে, মাইথোলজি হয়েছে। কিন্তু বাংলা ছবির জোয়ারটা আমার দ্বারা হয়েছে। তারপরে আস্তে আস্তে উর্দু ছবি কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
আপনারা কি উর্দু ছবির বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন হিসেবে নিলেন?
না, আমি বাংলা ছবি করবো এটাই আমার লক্ষ্য ছিল। তখনো আমার সুপারহিট ছবি হয়েছে। এখানকার বাঙালি আর্টিস্ট যারা হিট হয়েছিলো তারা লাহোর, করাচির ছবি করেছে, আমি করিনি। এখানে ডাবল ভার্সন দুটো ছবি করেছিরাম। যেহেতু বাংলা হয়েছে। তারা বললো ডাবল ভার্সন করেন, যদি বেশি পয়সা পেতে চান। ময়নামতি আর মধুমিলন করলাম। তবে আমি উর্দু একটাই করেছিলাম, সেটা এখানকার লোকের করা পায়েল ছবিটা। তবে বাংলা ছবির জোয়ার যখন শুরু হলো তখন উর্দু ছবি একরকম বন্ধ হয়ে গেলো। তখন প্রেসারটা এলো আমার উপরে। যদিও তখন আমার আগের নায়করাও ছিলো। কিন্তু রোমান্টিক ছবির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমাকে ডে-নাইট কাজ করতে হলো। ভারতীয় বাংলা ছবিও বন্ধ হলো। বাংলা ছবির প্রোডাকশন বেড়ে গেছে।
মধ্যবিত্ত দর্শকরা এখন বাংলা ছবি দেখে না বললেই চলে। ছেড়ে গেছে বলা যায়...
না, তার বাংলা ছবি তো ছাড়েনি। ঘটনা হলো, মিডিয়া চেঞ্জ হচ্ছে, হলের পরিবেশ ভাল নয়। মানুষের টেস্ট চেঞ্জ হয়েছে। আফটার লিবারেশন আমরা অনেক ফার্স্ট হয়ে গেছি। আমাদের জীবন ফার্স্ট হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র ফার্স্ট হয়ে গেছে। যারা এডজাস্ট করতে পারছে না তারা দেখছে না। আর এখন তো হাই এন্টারটেইনমেন্ট বেড়ে গেছে। আগে ভিসিপি ছিলো ভিসিআর ছিলো, সাথে এখন ক্যাবল লাইন যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে যারা ভালো লোক তারা ভাবে ঠিক আছে ঘরে বসে দেখি। তবে ভালো ছবি হলে দর্শক হলে গিয়ে দেখছে।
আপনার দর্শকরা কিন্তু এখন আর ছবি দেখছে না।
তারা এখন রিটায়ার্ড।


রাজ্জাকের সিনেমার জনপ্রিয় কিছু গান
১. তুমি যে আমার কবিতা (দর্পচ‚র্ণ)
২. আমাকে পোড়াতে যদি এতো লাগে ভালো (মনের মতো বউ)
৩. তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে (শুভদা)
৪. আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন (নাচের পুতুল)
৫. নীল আকাশের নীচে (নীল আকাশের নীচে)
৬. হয় যদি বদনাম (বদনাম)
৭. আমি কার জন্যে পথ চেয়ে রবো (অমর প্রেম)
৮. ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি (অনন্ত প্রেম)
৯. এমনও তো প্রেম হয় (দুই পয়সা আলতা)
১০. গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে (স্বরলিপি)

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ