হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মুনশী আবদুল মাননান : হিমালয়ের প্রত্যন্ত এলাকা ডোকলাম মালভূমিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে চীন ও ভারতের সৈন্যরা। দু’মাস হলো এই অবস্থা অব্যাহত রয়েছে। দু’দেশের মধ্যে বাকযুদ্ধ তুঙ্গে উঠলেও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দু’দেশের সৈন্যরা অপরিসীম ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। ডোকলামে চীনের সড়ক নির্মাণের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি। ব্রিটিশ ও চীনা রাজশক্তির মধ্যে ১৮৯০ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ৮৯ বর্গ কিলোমিটার মালভূমিটি চীনের অচ্ছেদ্য অংশ বলে চীন দাবি করে। সেই দাবিতে সেখানে সড়ক নির্মাণের এখতিয়ার তার আছে। এতে আপত্তি জানানো বা বাঁধা দানের সুযোগ কারো নেই। ভারতের তো নেই-ই। কারণ, সেটি চীন-ভারতের কোনো সীমান্ত নয়। ডোকলাম চীন-ভূটান সীমান্তে অবস্থিত। ভুটান অবশ্য এলাকাটি তার বলে দাবি করে। বিরোধ যদি বলা হয়, তাহলে চীন-ভুটান বিরোধই বলতে হবে। তাতে আগ বাড়িয়ে যুক্ত হয়েছে ভারত। ভুটানের হয়ে ভারত সড়ক নির্মাণ ও চীনা সৈন্যদের উপস্থিতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৈন্য-অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে চলমান পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ভারতের পক্ষে যুক্তি হলো, ভুটানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি মতে, ভারত ভুটানের নিরাপত্তায় এমন পদক্ষেপ নিতে পারে। ভুটান মনে করে, ডোকলামে সড়ক নির্মাণ চীনের সঙ্গে তার ১৯৮৮ ও ১৯৮৭ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির খেলাপ। চীনের কথা, এতে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতার কোনো হুমকি সৃষ্টি হয়নি বা হচ্ছে না। ভারতের সৈন্য অনুপ্রবেশের ঘটনায় ভুটান বড় ধরনের বিপাকে পড়ে গেছে। তার অবস্থান এখন অনেকটাই নিরপেক্ষ। সে চীন ও ভারতের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে উদ্ভুত পরিস্থিতির অবসান কামনা করছে।
ভারতও দেখছে, ডোকলামে সৈন্য পাঠানো ঠিক হয়নি। বুঝতে পারছে, সৈন্য ফিরিয়ে আনাই সমাধানের একমাত্র পথ। এখন আর সে চীনের সড়ক নির্মাণের বিষয়ে কিছু বলছে না। বলছে, এক সঙ্গে দু’দেশের সৈন্য অপসারণ করার কথা। চীন তাতে রাজি নয়। চীন বলছে, আগে ভারতকে তার সৈন্য ফেরৎ নিতে হবে। ভারত এ নিয়ে আলোচনার যে-প্রস্তাব দিয়েছে, চীন তার জবাবে বলেছে, ভারত তার সৈন্য সরিয়ে নিলেই কেবল আলোচনা হতে পারে। ভারত তার নিজের ‘নির্বুদ্ধিতা’ কিংবা ‘বাহাদুরি’ দেখানোর কারণেই আটকে পড়েছে। না পারছে সৈন্য রাখতে, না পারছে ফিরিয়ে আনতে। ওদিকে চীন বারবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করছে এই বলে যে, প্রয়োজনে সে সামরিক ব্যবস্থা নেবে। ভারত যদি শান্তি চায় তবে যেন সৈন্য সরিয়ে নেয়।
পর্যবেক্ষকদের মতে, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ভুটানকে সহায়তার করার জন্য ভারত ডোকলামে সৈন্য পাঠিয়েছে বলে মনে হলেও কিংবা ভারত দাবি করলেও এর পেছনে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এলাকাটি স্ট্র্যোটিজিক্যালি স্পর্শকাতর। ভারত মনে করেছে, ডোকলামে সড়ক নির্মিত হলে এবং সেখানে চীনা সৈন্যদের উপস্থিতি বাড়লে ভারতের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য তা হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ডোকলাম থেকে সামান্য দূরেই তার ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ শিলিগুঁড়ি করিডোরের অবস্থান। এই করিডোরটিই ভারতের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সংযুক্ত রেখেছে। ডোকলামে সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন ও চীনা সৈন্যদের উপস্থিতিকে ভারত তাই সহজভাবে নিতে পারেনি বা পারছে না। দ্বিতীয় কারণটির সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়াশয় জড়িত। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের চীন-নীতিতে কিছুটা উগ্রতা প্রশ্রয় লাভ করেছে। রাজনীতির ময়দান বিজেপির জন্য মসৃণ করার জন্য চীনের ব্যাপারে উগ্র নীতি ও আচরণ প্রদর্শনের প্রবণতা স্পষ্টই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রকাশের জন্য মোদি সরকারের নানবিধ উদ্যোগ-পদক্ষেপের মধ্যে চীন বিরোধিতাও অন্যতম। কথা নেই, বার্তা নেই হুট করে চীনের ভেতরে সৈন্য ঢুকিয়ে দেয়া উগ্র চীন বিরোধিতারই নজির। কিন্তু বাস্তবে ডোকলামে সৈন্য পাঠানো হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদির ডাকে যে সর্বদলীয় বৈঠকটি হয়েছে, তাতে স্পষ্টতই প্রতিভাত হয়েছে, মোদি সরকার ডোকলামে সৈন্য পাঠিয়ে সামরিক উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ সম্পর্কে কূটনৈতিক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে চীন-ভারত দ্ব›েদ্ব ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্রদের সমর্থন পাওয়া যাবে কিনা তাতে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায়, সর্বদলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকার সম্মানজনকভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নেবে। সেই সম্মানজনক সৈন্য প্রত্যাহার হতে পারে যদি চীনও একইসঙ্গে সৈন্য প্রত্যাহার করে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এব্যাপারে চীনের অবস্থান ভিন্ন। চীন বিনা শর্তে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার চায়। সেটা সম্মানজনক না হওয়াই ভারতও সৈন্য প্রত্যাহার করছে না। ফলে উত্তেজনা সেখানে ক্রমাগত বাড়ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দু’পক্ষের সৈন্যদের কোনো একটি পক্ষ যদি ধৈর্য হারায়, তাহলে তুলকালাম কান্ড বেঁধে যেতে পারে। ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার একটি পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি যখন বিশ্বকে শংকিত করে তুলেছে ঠিক সে সময় হিমালয়ের একটি প্রত্যন্ত এলাকাকে ঘিরে চীন ও ভারতের মধ্যে একটি নিরব সংঘাত দানা বাঁধছে এবং উদ্ভূত উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। বিশ্লেষকদের বরাতে আরো বলা হয়েছে, এই বিবাদটি অতি উদ্বেগজনক। কারণ, চীন ডোকলাম ইস্যুকে তার ভৌগলিক অখন্ডতার প্রতি সরাসরি হুমকি হিসাবে দেখছে। ভারতও এ ব্যাপারে অনড়। এ কারণে পরমাণু শক্তিধর দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক দ্রুতই খারাপের দিকে যাচ্ছে। লন্ডনের রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের শশাংক জোসি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, উত্তেজনা বাড়বে না এমনটি মনে করলে আত্মতুষ্টিই হয়তো পাওয়া যাবে। গত ৩০ বছরের মধ্যে এটি চীন ও ভারতের মধ্যকার সবচেয়ে মারাত্মক সংকট।
ডোকলামে চীন ও ভারতের সৈন্যরা ঠাঁই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকলেও লাদাখ সীমান্তে কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছে। গত ১৫ আগস্ট লাদাখে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর দু’দেশের সৈন্যদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। কোনো পক্ষই অবশ্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি। ওইদিন পূর্ব লাদাখের প্যাংগং লেকের উত্তর পাড়ে চীন ও ভারতের সৈন্যরা মারামারিতে লিপ্ত হয়। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি ও পাথর ছোঁড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। উল্লেখ্য, লেকের পাড়ের দুই তৃতীয়াংশ চীনের এবং এক তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে রয়েছে। কী কারণে দু’দেশের সৈন্যদের মধ্যে এই হাতাহাতি লড়াই ও পাথর ছোঁড়াছুড়ির ঘটনা ঘটেছে, জানা যায়নি। একটি সূত্র টাইম’স অব ইন্ডিয়াকে বলেছে, ভোর বেলায় ফিঙ্গার ৪-ও ফিঙ্গার-৫ দিয়ে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সৈন্যরা দু’বার ভারতীয় ভূখন্ডে ঢোকার চেষ্টা করে। এ সময় দু’পক্ষের মধ্যে পাথর ছোঁড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে এবং উভয় পক্ষে কিছু সৈন্য আহত হয়। অত:পর উত্তেজনা প্রশামনে ব্যানার ড্রিল হয় এবং সৈন্যরা যার যার অবস্থানে ফিরে যায়। পত্রিকাটির তরফে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে মুখ খুলতে তারা অস্বীকার করেছে। ওদিকে চীন ওই সংঘর্ষ সম্পর্কে কিছু জানেনা বলে উল্লেখ করেছে। এইসঙ্গে বলেছে, সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সে অঙ্গীকারাবদ্ধ। চীন নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং এ সংক্রান্ত চুক্তি মেনে চলার জন্যও ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
ডোকলামে ভারতীয় সৈন্যদের অনুপ্রবেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা চীন-ভারত সীমান্তে উচ্চ সর্তকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে উত্তেজনার ভাবও দেখা যাচ্ছে। চীন ও ভারতের মধ্যে ভূমি ও সীমানা বিরোধ রয়েছে। চীন ভারতের অরুনাচল প্রদেশের একাংশকে তার বলে দাবি করে। লাদাখ এলাকাতেও সীমান্ত বিরোধ বিদ্যমান। ২০১৫ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদির বেইজিং উপস্থিতিকালে চীনের সরকারী টিভিতে ভারতের যে মানচিত্র প্রদর্শন করা হয়, তাতে অরুণাচল ও কাশ্মীরকে তার অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়নি। ডোকলাম সংকট সৃষ্টি হওয়ায় পর চীনের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, তারা পাকিস্তানের পক্ষে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে পারে যেমনটি ভুটানের পক্ষে ডোকলামে ভারত করেছে। চীনের কাশ্মীরে প্রবেশের আশংকাও তাই এড়িয়ে যাবার মতো নয়। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরের মধ্যদিয়ে চীন একটি মহাসড়ক নির্মাণ করছে। ভারত এই সড়ককে তার জন্য হুমকি হিসাবে দেখছে। ভারত আপত্তি জানালেও চীন তাতে পাত্তা দেয়নি; সড়ক নির্মাণ থেকে বিরত হয়নি।
দেখা যাচ্ছে, ডোকলামে সৈন্য পাঠিয়ে নানাদিক দিয়ে ফেঁসে গেছে ভারত। ওখানে সংঘাত-সংঘর্ষ বা যুদ্ধের একটা ঝুঁকি যেমন রয়েছে তেমনি অন্যান্য সীমান্তেও উত্তেজনা ও বিপদ বাড়ার আশংকা রয়েছে। বিরোধ ও উত্তেজনা প্রশমনই হোক, কিংবা হোক সংঘাত-সংঘর্ষ ও যুদ্ধের ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসা, ভারতের জন্য একটি মাত্র পথই খোলা আছে এবং তাহলো, যত দ্রæত সম্ভব ডোকলাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা। যেহেতু মামলাটি ভারতের বিপক্ষেই যায়; কারণ সে-ই ডোকলামে সৈন্য-অনুপ্রবেশ করিয়েছে, সুতরাং তাকে স্বেচ্ছায় সৈন্য সরিয়ে আনতে হবে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে পরবর্তীতে সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য তাকেই দায়ী হতে হবে।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরাখবর থেকে মনে হতে পারে, চীন-ভারত যুদ্ধ বুঝি আসন্ন। প্রশ্ন হলো, যুদ্ধের কি আদৌ কোনো আশংকা আছে? আপাতত নেই। তবে যে কোনো মুহূর্তে আশংকা জোরদার এবং এমনকি সত্য হয়েও উঠতে পারে। দু’দেশই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। তাদের মধ্যে যুুদ্ধ শুরু হলে সেটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার দেখা গেছে, চীন যুদ্ধ বা ভূমি দখলে অথবা রাজনৈতিক প্রভাবলয় বিস্তারে আগ্রহী নয়। তার আগ্রহ বা লক্ষ্য বিশ্বময় বাণিজ্য বিকাশ। সেই লক্ষ্য নিয়েই সে কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে একটি যুদ্ধংদেহি ভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। ভূমিদখল কিংবা রাজনৈতিক প্রভাববলয় বিস্তারের খায়েশও তার মধ্যে দেখা যায়। দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের অনুপংখ বিশ্লেষণ করলেই এর পরিচয় পাওয়া যায়। ভারতীয় তথ্যভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞজনেরাই বলেছেন, চীনের সঙ্গে বিরোধ-বিসংবাদ ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ভারতের জন্য মোটেই সমীচীন হবে না। কারণ, সামরিক, অর্থনৈতিক ও বন্ধুবলয়ের বিচারে ভারত চীনের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তাই তার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া বা কাজ করা উচিৎ নয় যা তাকেই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতে এখন যারা ক্ষমতায় তারা এই বাস্তবতাটা অনুকরণ করলে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলে বা আচরণ প্রদর্শন করলে ভারতেরই লাভ।
চীনের সঙ্গে সাম্প্রতিকালে ভারতের সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছে এবং ক্রমাগত ঘটছে, তাতে সন্দেহ নেই। চীন যে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে ভারত তাতে নেই। অথচ দক্ষিণ পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার অন্তত ৬১ দেশকে চীন সড়ক, রেল ও সমুদ্র পথে সংযুক্ত করার জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে কাজ করে যাচ্ছে। চীন ভারতকেও এর সঙ্গে যুক্ত করতে চায়। ভারত কী কারণে যেন নিজেকে এ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। ভারত এই উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত হলে তারও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিকাশ তরান্বিত হতে পারে। ভারত চীনকে সবদিক দিয়েই প্রতিপক্ষ হিসাবে মনে করছে। অথচ তার সক্ষমতাকে বিবেচনায় আনছে না। ডোকলামে সৈন্য পাঠিয়ে ভারত ফাঁটাবাঁশে আটকে পড়েছে। বিফলে, ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে আসা তার জন্য মান-সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদিক এই প্রেক্ষাপটেই সম্ভবত আরেকটি ভুল সে করে বসেছে। সে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা করেছে যাতে তার লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল। কদিন আগে চীনের ৯৩টি পণ্যের ওপর সে এন্টি ড্যাম্পিং ডিউটি আরোপ করেছে। এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, ভারতের বাজারে বিক্রী বাড়ানোর জন্য চীন উৎপাদন খরচের চাইতে কম দামে পণ্য বিক্রী করছে। এতে চীনা পণ্যের বিক্রী বাড়ছে। তবে ভারতীয় পণ্যের বিক্রী কমছে। এমন কি এ কারণে শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক-কর্মীরা বেকার হয়ে পড়ছে। সত্য বটে, এ সিদ্ধান্তের ফলে চীনের পণ্য রফতানি কমবে, আয় কমবে কিন্তু তাতে ভারতের কতটা লাভ হবে, নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।
চীন একে ‘দুর্বল সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করে বলেছে, এতে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভারতকে এর দীর্ঘ মেয়াদী ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে প্রস্তুত থাকতে হবে। চীন ইতিমধ্যে তার কোম্পানীগুলোকে ভারতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আগে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি শিকার করার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বার্তা খুবই পরিষ্কার। এর পর চীনের বিনিয়োগ ভারতে কমে যাবে। সেখানে চীনা কোম্পানীগুলোর প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানা উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়বে, এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-কর্মী বেকার হয়ে পড়বে। বিকল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থান না হলে এতে বরং ভারতই বিপাকে পড়বে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিকল্প বিনিয়োগ, শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যথেষ্ট সামর্থ কি ভারতে আছে? এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক নয়।
পারমানবিক শক্তির অধিকারী চীন ও ভারতের মধ্যে কোনো প্রকার বিরোধ-বৈরিতা ও যুদ্ধ শান্তিকামী, সৌর্হাদ্যপ্রত্যাশী মানুষ কামনা করে না। তাদের মধ্যে সম্ভাব থাক, সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাক, এটাই সকলের প্রত্যশা। বিবাদ বা যুদ্ধ দু’দেশের ৩০০ কোটি মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সেই সঙ্গে গোটা বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ যুদ্ধমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক বিশ্বই দেখতে চায়। চীনা ও ভারতীয় নেতাদের বিষয়টি আমলে নিতে হবে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে উদ্ভূত সংকট নিরসনে সবুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।