Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুদের আগুনে পুড়ছে গ্রামীণ জনপদ

| প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবাধে চলছে এনজিও ক্রেডিট প্রোগ্রাম। অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ক্রেডিট প্রোগ্রামের সিংহভাগ অর্থ। ঋণের জালে আটকে পড়ছে বিশাল জনগোষ্ঠী। চক্রবৃদ্ধিহারে আদায় করা হচ্ছে সুদ। যার জন্য স্বনির্ভরতার বদলে মানুষ হচ্ছে সর্বস্বান্ত। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর আত্মনির্ভরশীলতা সৃষ্টির নামে একশ্রেণীর এনজিও কার্যত সুদের কারবার করছে। এনজিও’র ক্রেডিট প্রোগ্রামে সরকারী কোন তদারকি নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাইক্রেডিট অথরিটি থেকে লাইসেন্স নিয়ে ক্রেডিট প্রোগ্রাম করে থাকে এনজিওগুলো। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) থেকে ৩/৪ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে ক্রেডিট প্রোগ্রামের অর্থ সংগ্রহ করে এলাকাভিত্তিক ঋণ দেয় তারা। কিন্তু আদায় করে সর্বোচ্চ ৩০%।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলায় এনজিও’র সংখ্যা ৮হাজার ৩শ’ ৩৬টি। যার সিংহভাগই সুদের কারবার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ। যেসব এনজিও’র ক্রেডিট প্রোগ্রাম নেই, তাদের অধীনস্থ ভিন্ন সমিতি কিংবা সংস্থার নামে গোপনে সুদের কারবার চালায়। তবে কিছু এনজিও আছে তারা ক্রেডিট প্রোগ্রামের বাইরে। সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর এনজিওদের রেজিস্ট্রেশন দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। কোন তদারকি করে না। বিশেষ করে ক্রেডিট প্রোগ্রামের মোটেও খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না। কারণ ক্রেডিট প্রোগ্রামের এনজি’র কর্মকর্তারা সিংহভাগই প্রভাবশালী। যারা প্রভাবশালী নয় তারা মাসোহারা দিয়ে ম্যানেজ করে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়নের নামে যেসব এনজিও সুদের ব্যবসা করে তাদের বেশীরভাগই গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোকে ক্রমাগতভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। আত্মনির্ভরশীলতার বদলে বাড়ছে পরনির্ভরশীলতা। সুত্র জানায়, সমাজসেবা অধিদপ্তর এনজিও ঋণের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারী নির্দেশনার জন্য স¤প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠায়।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা এমনকি গ্রামপর্যায়ে ক্রেডিট প্রোগ্রামের এনজিও কর্মীদের ব্যাপক তৎপরতা রয়েছে। তারা দারিদ্র্য বিমোচনের দোহাই দিয়ে উচ্চহারে সুদের কারবার করছে অবাধে। সেই সাথে চলছে গ্রামে গ্রামে মহাজনী সুদের ব্যবসা। একজন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী চাষাবাদের আগে মহাজনদের কাছে সুদে টাকা নেয়। দেখা যায়, সুদাসলে টাকা দিতে গিয়ে তার জমির ফসলাদি মাঠ থেকে তুলে নিজ ঘরে তোলার বদলে দিতে হয় মহাজনদের ঘরে। সুদের কারবার ছাড়াও গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন এনজিও’র সাইনবোর্ডের আড়ালে সাধারণ মানুষকে স্বনির্ভর করার প্রলোভন দেখিয়ে নানা কৌশলে তাদের সঞ্চিত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা একের পর এক ঘটলেও সরকারীভাবে কোন খোজ খবর নেয়া হয় না কখনোই। অসহায় দরিদ্র ও সহজ সরল অনেকেই মহাজনী ঋণের জালে আটকা পড়ে ভিটা-বাড়ী পর্যন্ত লিখে দিতে বাধ্য হচ্ছে। গোটা অঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামে চলছে গ্রামের দাপটধারী অর্থবিত্তশালী মহাজনদের সুদের কারবার। এনজিওগুলোর মধ্যে আরআরএফ, জাগরণী চক্র, শাপলা, লাইফ, সমাধান, বাঁচতে শেখা, বন্ধু কল্যাণ ফাউনেশন, সুশীলন, প্রত্যাশা ও সৃজনীসহ শতাধিক এনজিও’র মাইক্রেডিট অথরিটির লাইসেন্সধারী। এর বাইরেও প্রায় সব এনজিও কমবেশী নিজেদের অর্থে, ব্যাংকের থেকে টাকা নিয়ে ও বিভিন্নপন্থায় সুদের কারবার করে থাকে। জনুনি প্রয়োজনে লোকজন হাতের কাছে যখন তখন টাকা নিয়ে ফাঁদে আটকা পড়ছে। এমন কোন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এই ধরণের এনজিও সুদের কারবার চালাচ্ছে না। ঋনের টাকা শোধ করতে না পেরে অনেকে পালিয়ে গেছেন।
জানা যায়, ঝিনাইদহের বারোবাজারের মশিয়াহাটি ঋষি পল্লীতে বিভিন্ন এনজিও’র ঋণ কার্যক্রম চলছে টানা প্রায ২০বছর। ঋষিপল্লীর লোকজন বুট পালিশ, ঝুড়ি ও কুলা তৈরী এবং কমবেশী আবাদী জমি চাষাবাদ করে সংসার নির্র্বাহ করতো। ঋণের জালে আটকে তারা সর্বস্বান্ত হয়েছে। অনেকে ভিটাছাড়া হয়েছে। দীর্ঘদিনেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বরং গরীব আরো গরীব হয়েছে। ক্রেডিট প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত যশোরের একটি বড় এনজিও জাগরণী চক্রের কর্মকর্তা আব্দুল হাসিবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ দিয়ে আসলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচন করা কঠিন হচ্ছে। ঋণ নেয়ার পরই ভোগ-বিলাসে কিংবা অতীতের ঋণ পরিশোধের ব্যয় করে থাকে। কিস্তির টাকা পরিশোধ কিংবা মূল ঋণ পরিশোধে উৎপাদনশীল খাতে ঋণের অর্থ হচ্ছে খুবই কম।
অর্থনীতিবিদ, সচেতন ও পর্যবেক্ষক মহলের মতে, গ্রামীণ দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বদলের দোহাই দিয়ে যেসব এনজিও সুদের কারবার চালাচ্ছে তাদের লাগাম টেনে ধরা জরুরী। তা না হলে দারিদ্র্য বিমোচন, পল­ী উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির নামে যাচ্ছেতাই অবস্থার সৃষ্টি হবে। শুধু পাকা ঘরবাড়ী, ভোগ বিলাস আর চকচকে অবস্থা আর্থ-সামাজিক অবস্থা শক্তিশালী প্রমাণ করে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ