Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ওসমানীনগর-বালাগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার জনপ্রিয় বাতি ‘হারিকেন’

| প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আবুল কালাম আজাদ, বালাগঞ্জ (সিলেট) থেকে : বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর থেকে হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় বাতি ‘হারিকেন’। রাতের অন্ধকার দূর করতে গ্রাম-বাংলার অন্যতম ভরসা ছিল হারিকেন তথা কেরোসিন বাতি। পরিচালনার দায়িত্বে উচ্চ পর্যায়ে থেকে নিয়ে মফস্বলের অনেকেই পড়ালেখা করেছেন হারিকেনের মৃদু আলোয়। গৃহস্থালী এবং ব্যবসার কাজেও হারিকেন ছিল একমাত্র অবলম্বন। সিলেটের স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলে ‘লেমটন’।
চলচ্চিত্রের প্রথম আমলের ছবিগুলোতে দেখা যায় সিনেমার নায়িকা তার ভালোবাসার মানুষটিকে অন্ধকার রাতে খুজে পেতে হারিকেন নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। আবার বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ‘ডাক হরকরা’ গল্পের নায়ক তার এক হাতে হারিকেন আর অন্য হাতে বল্লম নিয়ে রাতের আধারে ছুটে চলে তার কর্ম পালনে। এইতো কিছু দিন আগের কথা, বাহারি ধরনের কুপি ও হারিকেন ছিল মানুষের অন্ধকার নিবারণের অবলম্বন। কালের বিবর্তনে কুপি বাতি ও হারিকেনের স্থান দখল করে নিয়েছে বৈদ্যুতিক বাল্ব, সৌরবিদ্যুৎ, চার্জার লাইটসহ মোমবাতি আরও অনেক কিছুই। ফলে ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় এই নিদর্শটিও।
জানা যায়, সন্ধ্যা হলেই গ্রামীণ জনপদে প্রতিটি বড়িতেই এক বা একাধিক সংখ্যক হারিকেন থাকতো। সন্ধ্যা এলেই সবার আগে মনে পড়তো হারিকেনের কথা। গৃহস্থলির সকল কাজ সেরে বাড়ির বৌ-ঝিরা সন্ধ্যার আগেই হারিকেনের কাঁচ মুছে তাতে কেরোসিন ভরে জ্বালিয়ে দিতো প্রতি ঘরে ঘরে। অন্ধকার হওয়ার পূর্বেই সবার বাড়িতে শোভা পেতো হারিকেনের আলো। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে রাতের যাবতীয় কাজকর্ম চলতো হারিকেনের আলোয়। বিয়ের উপহারের তালিকায় হারিকেন ছিল অন্যতম। হারিকেনের জনপ্রিয়তার কারণে নির্বাচনের প্রতিকের তালিকায় হারিকেন ছিল প্রথম। খেলাধুলাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামুলক অনুষ্ঠানেও উপহার হিসাবে হারিকেনের বেশ কদর ছিলো। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবিতে হারিকেন হাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ মানববন্ধন করতো। এখন হারিকেন হারিয়ে যাওয়ার কারণে হারিকেন দিয়ে প্রতিবাদও করা হয় না। রিকশা গুলোর নিচে রাতের আধারে হারিকেনের ব্যাপক ব্যবহার ছিল।
হারিকেন আজ প্রযুক্তির যাতাকলে নিষ্পেষিত। হারিকেন এখন অনাধরে মাটি চাপা পড়ে গেছে। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ঘরের বিভিন্ন অকেজো জিনিসের সাথে। বিদ্যুতায়নের ফলে এবং চায়না চার্জার লাইটের কারণে হারিকেনের কদর চলে গেছে। এখন শহরের সাথে পাল্ল­া দিয়ে বেশিরভাগ গ্রামের সব খানেই সন্ধ্যা হলেই জ্বলতে থাকে রঙ-বেরঙের বৈদ্যুতিক বাতি। এছাড়াও রয়েছে দেশি-বিদেশি ছোটবড় নামিদামি নানান ডিজাইনের চার্জার লাইট। তাছাড়া গ্রামের যে সব অঞ্চলে বিদ্যুৎ যায়নি সেখানে চলে গেছে সৌরবিদ্যুৎ।
হারিকেনের কদর থাকায় তখন তৈরি হতো নানা ডিজাইনের। এই কুপি ও হারিকেনগুলো ছিল বাহারি রঙ। এর মধ্যে মাটি, লোহা, কাচের বোতল আবার পিতলের তৈরী কুপিও ছিল। নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী লোকজন কুপি ও হারিকেন কিনে সেগুলো ব্যবহার করতো। নষ্ট হলে মেরামত করে দিত কারিগড়। তার একটি নামও ছিল ‘টাটারু’। হারিকেন বিলুপ্তের সাথে সাথে সেই কারিগড়দেরও আর দেখা যায় না। হারিকেন অনেকটা এখন ফটোফ্রেমে বন্দী। দু’একটি বাড়িতে হারিকেন দেখা মিললেও সেটি আর জ্বলে না। এখন গৃহ বধুদের হারিকেনের কাঁচ মুছে হাতে কালি লাগাতে হয়না। লাইটের সুইচ টেপা মাত্রই ঘর ভরে যায় আলোয়। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের অনেকেই হারিকেন নামও জানে না। হারিকেন দেখে পরবর্তী প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বড়দের কাছে জিজ্ঞেস করবে এটা আবার কি? কি কাজে লাগে ইত্যাদি
আলহাজ মিনা বেগম মহিলা মাদরাসার দশম শ্রেণির ছাত্র ইশফাক আহমদ ও মিজানুর রহমান জানায়, হারিকেন তথা লেমটন ব্যবহার করবো তো দূরের কথা এটা চিনি না। মুরব্বিদের মূখে শুনেছি এটা দিয়ে ঘরের আলোর জন্য ব্যবহার করা হতো। ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুর ইউনিয়নের হস্তিদুর গ্রামের পঞ্চাশউর্ধ্ব প্রবিন গৃহ বধু রোকেয়া বেগম বলেন, হারিকেন ছাড়া রাতে চলা কল্পনাও করতাম না। হারিকেন ছাড়া জীবন ছিল অচল। ঘরের দৈনিক প্রধান কাজের মধ্যে হারিকেন ছিল একটি। এখন তো একটি হারিকেনও দেখি না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ