Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চট্টগ্রামে অবৈধ গভীর নলকপের ছড়াছড়ি কোটি কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত ওয়াসা

| প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে ব্যাপক হারে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও বেশির ভাগেরই কোন অনুমোদন নেই। এতে করে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। অভিযোগ রয়েছে ওয়াসার পরিদর্শকসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে লাইসেন্সবিহীন এসব নলকূপ পরিচালনা করা হচ্ছে। মাঠ কর্মকর্তাদের অনেকে এই বাবত ঘুষ-বকশিস খেয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। আর রাজস্ব হারাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। আবার গণহারে গভীর নলকূপ স্থাপনের ফলে নগরীর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তুরও নীচে নেমে যাচ্ছে। যার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ মহানগরীর জনসংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে জনসংখ্যা, সেইসাথে বসতবাড়িও। গড়ে উঠছে সুউচ্চ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। এ নগরীতে পানি সংকট দীর্ঘদিনের। ১২০ বর্গ কিলোমিটারের এ মহানগরীর অনেক এলাকায় ওয়াসার পানির সংযোগ নেই। আর এ কারণে পানি সংকট মেটাতে গণহারে গভীর নলকূপ স্থাপন করছে নগরীর ভবন মালিকেরা।
আবাসিক বিশেষ করে ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতে একাধিক ডিপ টিউবওয়েল রয়েছে। হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে কল-কারখানা, বাণিজ্যিক ভবনেও রয়েছে ডিপ টিউবওয়েল। ৩০ বছর পর সম্প্রতি ওয়াসার একটি বড় প্রকল্প চালু হওয়ায় নগরীতে পানি সরবরাহ বাড়লেও অনেক এলাকায় ওয়াসার এখনো সংযোগ নেই। বিশেষ করে বৃহত্তর বাকলিয়া, পতেঙ্গা, হালিশহর ও চান্দগাঁও এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ ডিপ টিউবওয়েলের উপর নির্ভরশীল। মহানগরীতে বাড়ির সংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজার হলেও ওয়াসার গ্রাহক সংখ্যা আবাসিক-অনাবাসিক মিলিয়ে মাত্র ৬৭ হাজার। ফলে নগরীর বাসিন্দাদের বিরাট একটি অংশ এখনো ডিপ টিউবওয়েলের পানির উপর নির্ভরশীল।
অথচ চট্টগ্রাম ওয়াসার খাতায় বৈধ বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত ডিপ টিউবওয়েলের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ৮৮১টি। চট্টগ্রাম মহানগরীর হোল্ডিং সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার। এর অর্ধেক ভবনেও যদি ডিপ টিউবওয়েল থাকে তাহলে এ সংখ্যা ৮০ হাজারের বেশি। ওয়াসা আবাসিক ও অনাবাসিক খাতে ৩ ধরনের মিলে ৬ ধরনের ডিপ টিউবওয়েলের লাইসেন্স দেয়। এসব লাইসেন্সের গড় ফি ৫৮ হাজার ৫৯৬ টাকা। এ হিসেবে নগরীতে অবৈধ ৮০ হাজার ডিপ টিউবওয়েল থাকলে ওয়াসা শুধুমাত্র লাইসেন্স খাতে সাড়ে ৪শ’ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহানগরীর বেশিরভাগ এলাকায় ডিপ টিউবওয়েল রয়েছে। সম্প্রতি নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ বাকলিয়ার একটি এলাকায় ওয়াসার এক কর্মকর্তা ৩৫টি বাড়িতে অনুসন্ধান করে দেখেন ৩২টিতেই ডিপ টিউবওয়েল রয়েছে। এসব ডিপ টিউবওয়েলের কোনটিরই লাইসেন্স নেই। অর্থাৎ অবৈধভাবে এসব ডিপ টিউবওয়েল পরিচালনা করছে বাড়ির মালিকরা।
ওয়াসার একজন কর্মকর্তা জানান, মহানগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বিশেষ করে যেখানে ওয়াসার পানি সরবরাহ অপ্রতুল সেখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ডিপ টিউবওয়েল রয়েছে। কোন কোন ভবনে একধিক ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। মহানগরীর বৃহত্তর বাকলিয়া, হালিশহর, আগ্রাবাদ, পতেঙ্গা, বন্দরটিলা, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, পাহাড়তলী, মনসুরাবাদ, বড়পোলসহ অনেক এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ওয়াসার পানির সংকট। এসব এলাকার প্রায় প্রতিটি ভবনে ডিপ টিউবওয়েল রয়েছে।
ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, ২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের নলকূপ বসাতে হলে ওয়াসাকে আবাসিক ক্ষেত্রে ৩০ হাজার এবং অনাবাসিক ৫০ হাজার টাকা লাইসেন্স ফি দিতে হয়। আর প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন ফি যথাক্রমে ১৫ হাজার ও ৩৩ হাজার। ৪ ইঞ্চি ব্যাসের ডিপ টিউবওয়েল হলে আবাসিকে লাইসেন্স ফি ৫০ হাজার টাকা। আর অনাবাসিকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাৎসরিক লাইসেন্স নবায়ন ফি আবাসিক ২৫ হাজার টাকা আর অনাবাসিক ৮০ হাজার টাকা। ৬ ইঞ্চি ব্যাসের ডিপ টিউবওয়েলের ক্ষেত্রে আবাসিকের লাইসেন্স ফি ৮০ হাজার টাকা আর অনাবাসিক ২ লাখ ২ হাজার ৫০০ টাকা। বার্ষিক লাইসেন্স নবায়ন ফি আবাসিকে ৭৫ হাজার টাকা এবং অনাবাসিকে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা। ওয়াসার হিসেবে, মাত্র ৩ হাজার ৮৮১টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত নলকূপ রয়েছে। বাস্তবে এ সংখ্যা অর্ধলাখেরও বেশি। সে হিসেবে ওয়াসা প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, নগরীতে অবৈধ ডিপ টিউবওয়েলের বিরুদ্ধে নিয়মিতই অভিযান চলছে। বিশেষ করে ওয়াসার পানি সরবরাহ বাড়ানোর পর অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। অনেক ডিপ টিউবওয়েল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, জরিমানাও আদায় করা হয়েছে। তবে ওয়াসার লোকবল সংকটের কারণে অভিযান আরও জোরদার করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, যারা চুরি করে ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহার করছে তাদের কৌশলের কাছেও অনেক সময় ওয়াসার টিম পরাজিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনি নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন। তবে ওয়াসার কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে যদি অবৈধ নলকূপ মালিকদের সাথে লেনদেনের অভিযোগ উঠে তা অবশ্যই তদন্ত করা হবে। যিনি অবৈধ ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে তা নিরাপদ করার জন্য কাউকে উৎকোচ দিচ্ছেন তারা উভয়ে চোর। চোরদের কোনভাবে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, একসময় ওয়াসার পানির সংকট ছিল একারণে অনেক ডিপ টিউবওয়েল বসিয়েছিল। কিন্তু এখন সংকট সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। সামনে আরও একটি প্রকল্প চালু হলে পানি সংকট থাকবে না। এ কারণে অনেকে ডিপ টিউবওয়েলের মতো ব্যয়বহুল ব্যবস্থা থেকে সরে আসছেন। অনেকে ওয়াসার কাছে লাইসেন্স জমা দিয়ে যাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প চালু হওয়ায় নগরীতে পানি সংকট কমে গেছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীতে দৈনিক প্রায় ৩০ থেকে ৩২ কোটি লিটার পানি সরবরাহ দিচ্ছে। আরও একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। এটি বাস্তবায়ন হলে দৈনিক আরও ৯ কোটি পানি যোগ হবে। চট্টগ্রাম নগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা ওয়াসার হিসেবে ৫০ কোটি লিটার। এখনও চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি থেকে গেছে ২০ কোটি লিটার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ