হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : পশ্চিমা পুঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদ পুরো বিশ্বের সাড়ে ৬শ কোটি মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ধ্যান ধারনা এবং জীবনাচারের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করতে সারাবিশ্বের মূলধারার গণমাধ্যমের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। বিগত শতকের নব্বই দশক শুরুর আগেই সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে দ্বিমেরুকেন্দ্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থা কায়েম হলেও মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশের মধ্য দিয়ে গণচীন ক্রমাগত একটি অপ্রতিদ্বন্দি অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিনত হওয়ায় বিশেষত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পায়ণ ও বানিজ্যিক সক্ষমতা চরমভাবে মার খেয়েছে। যেখানে পুঁজির আধিপত্যই হচ্ছে পুঁজিবাদি সা¤্রাজ্যবাদের মেরুদন্ড, সেখানে প্রতিদ্বন্দি চীনা পুঁজি ও বাণিজ্যিক সমক্ষমতার কাছে হেরে যাওয়া ঠেকাতে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের সামরিক-কর্পোরেট কুশীলবরা একটি অন্তহীন যুদ্ধের পরিকাঠামো তৈরী করে যুদ্ধের অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত আড়াই দশক ধরে যুদ্ধ, রাজনীতি ও অর্থনীতির যে ইঁদুর-বিড়াল খেলা পশ্চিমারা শুরু করেছে তার প্রধান প্লে-গ্রাউন্ড করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ মুসলমান রাষ্ট্রগুলোকে। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্টোলিয়াম ও ফসিল জ্বালানীর উপর নির্ভর করেই পশ্চিমা শিল্পায়ণ ও বিলাসী গতিময় জীবনের চাকা সচল রয়েছে। তেল বিক্রির টাকায় মধ্যপ্রাচ্যের উষর মরুময় দেশগুলো যখন বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশে পরিনত হয়েছে। একই সাথে এসব ধনাঢ্য আরব দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক লাঠিয়াল হিসেবে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম দিয়ে তাকে অজেয় সামরিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নয়া বিশ্বব্যবস্থার অধীনে ইসরাইলের প্রতিবেশী সব আরব দেশকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। প্রথমত: পশ্চিমা সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি, কৌশলগত সমরাস্ত্রের ভান্ডার ইসরাইলের জন্য উজার ও অবারিত করে রাখা হয়েছে। বহিরাগত ইহুদিদের নিয়ে গড়ে তোলা ক্ষুদ্র ইসরাইল রাষ্ট্রটি গত সত্তর বছরে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে যতবার যুদ্ধ করেছে, অন্যদেশের ভ’মি দখল ও আগ্রাসন চালিয়েছে বিশ্বের অন্য কোন সামরিক পরাশক্তি রাষ্ট্র তার প্রতিবেশীদের সাথে এমন আচরণের কোন নজির নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা, কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ও সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংস্তুপে পরিনত হওয়ার অবিমৃশ্যকারিতার পুনরাবৃত্তি রোধে বিশ্ব সম্প্রদায় জাতিসংঘের মত সংস্থা গড়ে তোললেও ইসরাইল এবং মার্কিনীদের কাছে শান্তিকামী বিশ্বের প্রত্যাশা যেন শুরু থেকেই জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিশেষত: মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য,স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির যে কোন সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করাই যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের মূল লক্ষ্য। পশ্চিমা পঁজিবাদি সা¤্রাজ্যবাদের এই নীলনকশা বাস্তবায়নে ইউরোপ-আমেরিকার জায়নবাদি ইহুদি লবি এবং তাদের মালিকানাধীন কর্পোরেট মিডিয়াগুলো শতবর্ষ ব্যাপী একটি মনস্তাত্বিক যুদ্ধ ও মগজধোলাই কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।একচ্ছত্র বাণিজ্যিক স্বার্থের অন্তরালে বিজ্ঞাপণী সাংস্কৃতিক মনস্তত্ব, মেইনস্ট্রীম প্রিন্ট মিডিয়া, অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেল এবং হলিউড, ডিজনীল্যান্ডের মত প্রচার, প্রকাশনা ও বিনোদনের কেন্দ্রগুলোতে শত শত কোটি ডলারের যে কর্পোরেট বিনিয়োগ তার নেপথ্যে রয়েছে ইহুদি জায়নবাদি প্রোপাগান্ডা মেকানিজম।
জর্জ বুশ-টনি বেøয়াররা হাতে হাত রেখে আফগানিস্তান ও ইরাক দখলের আগে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে নিউ ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রে বিমান হামলার মত ঘটনা(নাইন-ইলেভেন) ইসলামোফোবিক মিথ’র সৃষ্টি করার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এ বিষয়ে পশ্চিমা মুক্তবুদ্ধির লেখক-বিশ্লেষকরা শুরু থেকেই যে সব কথা বলে আসছেন পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যম ডেলিবারেটলি তা অগ্রাহ্য করেছে। ন্যাটো বাহিনী তার সর্বশক্তি নিয়ে যখন মধ্যপ্রাচ্যে একটি অন্যায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, পাশাপাশি এইু যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে এবং পশ্চিমা জনগনের সমর্থন অব্যাহত রাখতে সিএনএন, বিবিসিসহ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো অবিশ্রান্ত ভ’মিকা পালন করে এসেছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই ন্যাটো বাহিনী গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে এম্বেডেড জার্নালিজমের আশ্রয় নিয়েছিল। অর্থাৎ মার্কিন সামরিক বাহিনী যেটা যেভাবে পসন্দ করত তা’র বাইরে ভিন্ন কোন কিছু প্রচারের সুযোগ নেই বললেই চলে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান বাস্তবতা, সেখানকার মানবিক বিপর্যয়, সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক এজেন্ডা চরমভাবে মার খেয়ে যখন পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করেছে, তখন তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল প্লাটফর্ম হিসেবে নাইন-ইলেভেন ঘটনার নতুন নির্মোহ মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবাদি শাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য যখন ভ’লুণ্ঠিত হতে শুরু করেছে তখন কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এসব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতেও যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন গবেষনা সংস্থা পিও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক জরিপে মার্কিন মুসলমানদের দুদর্শার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি সংবাদ মাধ্যমকে(প্রেস টিভি) সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক কেভিন ব্যারেট বলেছেন, ৯/১১ ঘটনা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জনগনের মধ্যে একটি স্থায়ী ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষ সৃষ্টি করার বৃহত্তর প্রকল্পের একটি অংশ। কেভিন ব্যারেটের বিশ্লেষনে এ কথাও পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে যে, সোভিয়েত কমিউনিজমের পতনের পর কমিউনিস্টদের স্থানে পশ্চিমা সমাজের জন্য আরেকটি ভয়ানক হুমকি হিসেবে তথাকথিত ইসলামিক টেররিজম ও মুসলমানদের প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল এবং তাদের মিত্ররা একযোগে নাইন-ইলেভেনের মত ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। ব্যারেট বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন, ইসলামোফোবিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যকে ডি-স্ট্যাবিলাইজ করার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি সবচে বড় বেনিফিশিয়ারি হয়েছে ইসরাইল। ষড়যন্ত্রমূলক ইসলামোফোবিক এজেন্ডা পশ্চিমা সমাজ মানসে এতটাই প্রবলভাবে স্থান করে নিয়েছে যে, ট্রাম্পের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনেও এই প্রোপাগান্ডা বেশ ভালভাবেই কাজে লেগেছে। সব জনমত জরিপ ভ্রান্ত প্রমান করে ডোনাল্ড ট্রাম্প অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ৭টি মুসলিম জনসংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের বিরুদ্ধে ভ্রমন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেয়া নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি নজিরবিহিন ঘটনা। পশ্চিমা মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মার্কিন সংবিধানের মৌলিক ভিত্তির পরিপন্থি এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প (মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) আমেরিকাকে আবারো মহান করে তুলতে চান! ক্ষমতা গ্রহনের এক সপ্তাহের মধ্যে টিটিপি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেয়া, মুসলমানদের ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ট্রাম্প মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই বিশ্বের নেতৃত্বের স্থান থেকেই বিচ্চুত করে ফেলতে শুরু করেছেন বলে পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
পশ্চিমা সমাজকে নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের অনুকুলে নিয়ন্ত্রণ করতে পশ্চিমা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রকরা যে বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে শুরু করেছিল শুরু থেকে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান ছিল পশ্চিমা লেখক-সাহিত্যিকরা। বিংশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকেই পশ্চিমা সাহিত্যিকরা গল্প ও উপন্যাসের আকারে এ বিষয়ে সম্ভাব্য ভবিষ্যতের একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। পশ্চিমা রাজনীতি ও অর্থনীতির কুশীলবদের সামাজিক মনোজাগতিক নিয়ন্ত্রনের প্রয়াস কখনো বন্ধ হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর বিহেভিওরাল রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজির সাবেক সিনিয়র সাইকোলজিস্ট, গবেষক রবার্ট এপেস্টেইন এ যাবৎ প্রায় ১৫টি বই লিখেছেন। তার লেখা সর্বশেষ ও প্রকাশিতব্য একটি গ্রন্থের নাম ‘দ্য নিউ মাইন্ড কন্ট্রোল’। গত বছর মার্চে ‘দ্য নিউ মাইন্ড কন্ট্রোল’ শিরোনামে রবার্ট এপিস্টেইনের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় আইসিএইচ অনলাইনে। সেখানে তিনি গত শত বছরে প্রকাশিত পশ্চিমা মাইন্ড কন্ট্রোল বিষয়ক সাহিত্যের একটি ধারাবাহিক নির্ঘন্ট তুলে ধরেন। সেখানে তিনি প্রথমেই মার্কিন লেখক জ্যাক লন্ডনের লেখা ১৯০৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আয়রণ হিল’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে কর্পোরেট টাইটান বা টাইকুনরা সবকিছুই নিয়ন্ত্রন করছে, কিছুসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিভাবান মানুষ অতি উচ্চ বেতনে তাদের স্বার্থে কাজ করছে,তারা আরাম আয়েশে বিলাসি জীবন যাপন করলেও নিজেদের জীবনের উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ বা স্বাধীনতা নেই। কর্পোরেট টাইটানদের বাইরে সমগ্র মানব সভ্যতাই এক ধরনের ভার্চুয়াল দাসত্বের জালে বন্দি হয়ে পড়ার বাস্তবতা শত বছর আগে জ্যাক লন্ডনের লেখায়ই যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এরপর দ্বিতীয় দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বলশেভিক বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন আরোপের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল রাশান লেখক ইয়েভগেনি জমিয়াতিনের লেখা ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘উই’ উপন্যাসে। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত অলডাক্স হাক্সলি’র লেখা ‘ব্রেভ নিউ ওর্য়াল্ড’ এবং ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত জর্জ অরওয়েলের লেখা উপন্যাস ‘১৯৮৪’(নাইনটিন এইটিফোর) উপন্যাসে রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে আধুনিক মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে মানবেতরভাবে নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশল ও পদ্ধতির উপর রসঘন উপস্থাপন রয়েছে। যেখানে একেকটি শিশুর বেড়ে ওঠা, ভাষা, শিক্ষা ও চিন্তন প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের প্রণালী বিবৃত হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সমাজের বহত্তর জনগোষ্ঠির মনস্তাত্বিক নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশলের ভিত্তি সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যেই নিহিত ছিল। তবে পরবর্তিতে এ ক্ষেত্রে অধিক গবেষনালব্ধ জটিল মনস্তাত্বিক সমীকরণের আশ্রয় গ্রহন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এপিস্টেইন মার্কিন সাংবাদিক ভেন্স প্যাকার্ডের লেখা ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত ননফিকশন গ্রন্থ ‘দ্য হিডেন পারসোয়েডার্স’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। স্যটেলাইট টেলিভশন চ্যানেল এবং ইন্টারনেটের প্রসারের মধ্য দিয়ে গণমানুষের যাপিত জীবন ও চিন্তাধারার বিজ্ঞান ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণের সেই কৌশল ক্রমশ আরো সর্বপরিব্যাপ্ত হয়েছে। সিআইএ, মোসাদের মত গোয়েন্দা সংস্থা, বিবিসি, সিএনএন, ফক্স নিউজ, স্টার চ্যানেল থেকে শুরু করে ডিজনীল্যান্ড, হলিউড,সাবলিমিনাল স্টিমুলেশন মেথড, ইয়াহু, গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, ফেইসবুক, ইউটিইব, টুইটার, ক্লাশ অব ক্লানস, গেম অব থ্রোনস, স্টার ওয়ার্স, হ্যাট্টেট ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন ও ভিডিও গেমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে বিশ্বের কোন প্রান্তের কোন মানুষই মুক্ত নয়। তারা সম্মিলিতভাবে পশ্চিমা পুঁজিবাদি সা¤্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকুলে বিশ্বের সব মানুষের চিন্তাধারা ও রাষ্ট্রীয় আইনকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এর বাইরের কোন স্বাধীণ চিন্তাধারাকে তারা যে কোন উপায়ে দমিত করার পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ক্ষুদ্র দেশ কাতার মাথাপিছু গড় আয় এবং জীবনমানের কিছু উপাত্তের দিক থেকে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র , ইসরাইল বা সউদি আরব থেকেও উন্নত। জিডিপি পার ক্যাপিটার হিসাবে দেশটি বিশ্বের একনম্বর ধনী রাষ্ট্র। দৃশ্যত: পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রগুলোর জন্য এটা তেমন মাথাব্যথার কারণ না হলেও এই কাতারের দোহায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিছুটা স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সাহসী আন্তর্জাতিক নিউজ টিভি চ্যানেল আল জাজিরা। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক মেনিফেস্টোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে বলে তারা দাবী করে। যদিও তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, সামরিক প্রশাসন এবং কর্পোরেট মিডিয়া সা¤্রাজ্যবাদি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেনা। যুদ্ধের দুইটি পক্ষ থাকলেও গণমাধ্যমগুলো মূলত একপাক্ষিক, এরপরও তারা এম্বেডেড জার্নালিজমের ন্যাক্কারজনক ইতিহাস তৈরী করেছে। এ ছাড়া বিশ্বে এমন কোন গণমাধ্যম গড়ে উঠেনি, যারা নিজস্ব শক্তিতে পশ্চিমা যুদ্ধবাজ ও আগ্রাসী অপতৎরতার বিরুদ্ধে প্রকৃত সত্য তুলে ধরবে। সেই অর্থে আল জাজিরা টিভি চ্যানেলকে যথার্থ স্বাধীন ও সক্ষম গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা না গেলেও কিছুটা ব্যতিক্রম ও ভিন্নমতের সহাবস্থান থাকায় আল জাজিরা পশ্চিমাদের জন্য কিছুটা হলেও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরব বষন্ত, সিরিয়া যুদ্ধ, আইসিল, ইয়েমেন যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনে ইসরাইলী আগ্রাসনের উপর আল জাজিরার বস্তুনিষ্ট সাংবাদিকতার প্রভাব বেশ স্পষ্টভাবেই ধরা পড়েছে। এ কারণে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে আল জাজিরা সম্পর্কে তেমন কোন জোরালো অভিযোগ না উঠলেও গত জুনমাসে যে ৫টি আরব দেশ কাতারের সাথে ক’টনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পাশাপাশি অবরোধ আরোপ করেছে, তারা তাদের ১৩ দফা শর্তের অন্যতম প্রস্তাব হিসেবে আল জাজিরা টিভি চ্যানেল বন্ধের দাবী জানিয়েছে। তারা আল জাজিরার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে উস্কানী ও মদতদানের অভিযোগ এনেছে। যদিও তাদের অভিযোগের সপক্ষে কোন তথ্যপ্রমান হাজির করতে পারেনি। রমজান মাস থেকে কাতারে অবরোধ আরোপের পর কাতার তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক প্রস্তাবগুলোতে আরব প্রতিবেশীদের সাথে কোন আপস করবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল।সমাস্যা সমাধানে মধ্যস্থতাকারিদের কাছে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছিল কাতার। ইতিমধ্যে আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও কাতারের জীবন যাত্রায় অবরোধে তেমন কোন বিরূপ প্রভাব পড়েনি। উপরন্তু এ অবরোধে কাতার অনেক ক্ষেত্রেই আত্মনির্ভরতা অর্জনের পথে ইগিয়ে চলেছে বলে তারা এখন দাবী করছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নী বিরোধকে ম্যাগনিফাই করে প্রচার ও বিরোধ বাড়িয়ে চিরশত্রু ইরানের সাথে অবশিষ্ট আরবদের একটি সংঘাতে ঠেলে দেয়ার পশ্চিমা দূরভিসন্ধি বেশ দীর্ঘদিনের। কিন্তু গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসিভুক্ত ৬টি সুন্নী রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র দেশ কাতারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও অবরোধের কোন বস্তুনিষ্ঠ বা বিশ্বাসযোগ্য কারণ এখনো দৃশ্যমান নয়। মধ্যপ্রাচ্যের সবচে প্রভাবশালী রাষ্ট্র সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা মিশরের সাথে আঞ্চলিক-রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে কাতার সমকক্ষ না হলেও কাতারের ব্যতিক্রমী প্রভাবক হতে পারে শুধুমাত্র আল জাজিরা টিভি চ্যানেল।
জিসিসিভুক্ত দেশগুলো কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘটনাকে সৌদি আরব সফরে তার ক’টনৈতিক সাফল্য বলে দাবী করেছিলেন। সে অর্থে মার্কিন বশংবদ শাসকদের পক্ষ থেকে আল-জাজিরা বন্ধের দাবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাবিত বলে আঙুল তোলার সুযোগ হয়তো আছে। তবে আল জাজিরা টিভি চ্যানেলটি যে ইসরাইলী ও মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী এজেন্ডার জন্য প্রতিবন্ধক বলে বিবেচনা করছে সাম্প্রতিক ইসরাইলী সিদ্ধান্তে তা কিছুটা পরিস্কার হয়েছে। কাতারে অবরোধ আরোপের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন সঙ্কট সৃষ্টির পর ইসরাইল প্রথম বারের মত আল আকসা মসজিদে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। তারা নিরাপত্তার নামে আল আকসার প্রবেশ পথে মেটাল ডিটেক্টর এবং সিসি ক্যামেরা বসায়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের পাশাপাশি বিশ্বের মুসলমানরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ইসরাইলী পুলিশের রক্তাক্ত আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনিদের সাহসী প্রতিবাদের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে আল জাজিরা। অবশেষে মেটাল ডিটেক্টর এবং ক্যামেরাগুলো সরিয়ে নিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয় ইসরাইলীরা। গত এক দশকে গাজায় হামাস ও হেজবুল্লাহ্র সাথে একাধিকবার যুদ্ধে পরাজয়ের পর এবার ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র মানুষের প্রতিবাদের কাছে একটি কৌশলগত যুদ্ধে হেরে গেল ইসরাইল। আর এ জন্য আল জাজিরাকেই দায়ী করছে ইসরাইল। এ জন্যই ইসরাইলে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরাইল। জায়নবাদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিবাদি সংগ্রাম এবং ইসরাইলের নৈতিক পরাজয়কে যথার্থভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আল জাজিরা অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেছে। মধ্যপ্রাচ্য বা ফিলিস্তিনের স্বার্থে জিসিসি, ওআইসি, আরবলীগ, ওপেক বা পিএলও যা পরেনি প্রচারযুদ্ধে আল জাজিরা তা’ পেরেছে। এমনকি চীন বা রাশিয়াও মধ্যপ্রাচ্যে বিবিসি বা সিএনএন-এর প্যারালাল কোন গণমাধ্যম সৃষ্টি করতে পারেনি। ইসরাইলের টার্গেট হওয়ার মধ্য দিয়েই আল জাজিরা তার সাফল্যের প্রমাণ রেখেছে। তবে পশ্চিমাদের মাইন্ড কন্ট্রোল মেকানিজমের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আল জাজিরারও নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।