Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

দেশে শিশু ও নারী ধর্ষণের তুফান

| প্রকাশের সময় : ৮ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন এবং নীতি নৈতিকতার অভাবে বিপথগামী হচ্ছে যুবসমাজ : ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্নো ছবির ছড়াছড়ি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, পরিবার ও সমাজের অস্থিরতা দায়ী : রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়, প্রচুর অবৈধ অর্থের দাম্ভিকতা এবং প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ক্ষমতার দাপটই বেপরোয়া ধর্ষণকারীরা


উমর ফারুক আলহাদী : দেশে শিশু ও নারী ধর্ষণ মহামারীর আকার ধারণ করছে। প্রতি দিনই কোথাও না কোথাও তারা নির্যাতন ও বর্বর ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মস্থলেও পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করছে দুর্বৃত্তরা। ধর্ষণের পর মাথা ন্যাড়া করে ছেড়ে দেয়ার তুফানীয় ঘটনাও বগুড়ায় সদ্য ঘটেছে। অনেক স্থানে ফিল্মি কায়দায় অস্ত্রের মুখে বা-মা ও ভাই বোনকে কিংবা স্বামীকে জিম্মি করে তুলে নিয়ে শিশু এবং নারীকে ধর্ষণের ঘটনাও অনেক ঘটছে গত কয়েক মাসে। বলা যায় ধর্ষণের তুফান চলছে। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন এবং নীতি-নৈতিকতার অভাবে বিপথগামী হচ্ছে যুবসমাজ। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্নো ছবির ছড়াছড়ি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, পরিবার ও সমাজের অস্থিরতা, মাদক এবং পরিবারের সদস্যদের সচেতনতার অভাবও এ জন্য দায়ী। এছাড়া রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়, অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি না হওয়া, অবৈধ অর্থের দাম্ভিকতা এবং প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ক্ষমতার দাপটই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ধর্ষণকারীরা।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত চার বছরে ১২ হাজার ৮৫টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল ২১ হাজার ২২০টি, যা আগের বছরের তুলনায়ও বেশি। এটা নিঃসন্দেহে আতঙ্কজনক। সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে দেশের কোমলমতি শিশুরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিয়া রহমান বলেন, ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বড় কারণ হলো অবাধে পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি। বিদেশে কিন্তু এটা নেই। আমাদের দেশে তথ্য প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের অবাধ ও সহজলভ্য ব্যবহারের কারণে ছোট ছোট শিশু ও কিশোরদের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীল ছবি, যা সমাজের জন্য, পরিবারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এ জন্য দায়ী।
ড. জিয়া বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ অর্থবিত্ত, মাদক এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে দিন দিন ধর্ষণ ও খুনখারাবি বাড়ছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ও দায়ী। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সমাজ সচেতনতা, পরিবারের সচেতনতা এবং নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন।
আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, আলোচিত সব কয়টি ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করা হযেছে। পুলিশ এ ব্যাপারে সর্তক অবস্থানে আছে। তিনি বলেন, শিশু ধর্ষণ ও নারীর প্রতি পাশবিক নির্যাতন প্রতিরোধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।
মানবাধিকার সংগঠনের নেতা নূর খান বলেছেন, দেশজুড়ে নারীর প্রতি পাশবিক নির্যাতন, সহিংসতা ও নৃশংসতা বেড়েই চলছে। পাশবিক নির্যাতনের পর অনেক শিশু ও নারীকে হত্যাও করা হচ্ছে। অনেক সময় পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ গুম করারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে নারীরা প্রতিনিয়তই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীদের সুরক্ষায় দেশে নানা আইন থাকলেও সেসব আইন কোনো কাজে আসছে না। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, তারা নিজ ঘরেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। প্রেমের প্রস্তাবে বা বিয়েতে রাজি না হলে নারীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ছুড়ে মারা হচ্ছে এসিড। ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছোট শিশুরাও। মুঠোফোনে ধর্ষণের ছবি তোলা বা ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে। অনেক সময় ধর্ষণের পর হত্যাও করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও অনেক সময় বিচার হয় না। তিনি বলেন, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি এ ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মাহফুজা খানম বলেন, পরিস্থিতি দিন দিন আরো অবনতি ঘটায় সচেতন মানুষ ও অভিভাবকেরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শুধু আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রয়োজন সমাজ সচেতনতা, সামাজিক প্রতিরোধ, ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসনের রীতিনীতির শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বাস্তবতার আলোকে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুশিক্ষার। তিনি আরো বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি দেশের যুবসমাজকে নীতি নৈতিকতাবোধেরও যথাযথ শিক্ষা প্রদান করতে হবে। মাদক, অবাধ তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ভয়ঙ্কর নেশার হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হবে। ধর্ষণ এবং জোর করে তুলে নিয়ে নারী ও শিশুকে পাশবিক নির্যাতন করা শুধু সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নয় ধর্মীয় বিধিবিধান লংঘন এবং এটি একটি জঘন্য অপরাধ ও পাপ। আমাদের সন্তানদের এ শিক্ষাও দিতে হবে। এই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের সাত মাসে ৩২৭ জন নারী ধর্ষিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। কয়েকদিন আগে রাজধানীর বাড্ডায় সাড়ে তিন বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। গাজীপুর থেকে ছেলের গলা কাটা ও বাবার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বগুড়ায় এক তরুণীকে ধর্ষণের পর ওই ধর্ষিতা ও তার মায়ের মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে ধর্ষণকারীরা। এর আগে চট্টগ্রামে এক শিশুকে দুইজনে মিলে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। দেশে শিশু ধর্ষণসহ অন্যান্য যৌন সহিংসতার সংখ্যা বাড়ছে। গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার সংখ্যাও বেড়েছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে সরকারি সেবাকেন্দ্রে আসা নারী ও শিশুর সংখ্যা ২২ হাজারের বেশি। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শিশু। তাদের ৮০ শতাংশই ধর্ষণের শিকার। বাকি শিশুরা গৃহকর্মী হিসেবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে জুলাই মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে। এই আটটি কেন্দ্রে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) নামে পরিচিত। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের এখানে আইনি সুবিধাসহ সমন্বিত সেবা দেয়া হচ্ছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের কার্যক্রমের অধীনে ওসিসি পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৬ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ২৮৬। বছরটিতে ধর্ষণের চেষ্টাসহ মোট ৯১ জন এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮৭। ২০১৩ সালে ধর্ষণের পর হত্যাসহ সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ১৮৩। ২০১৪ সালে শুধু গণধর্ষণেরই শিকার হয় ২২টি শিশু। সব মিলে সংখ্যাটি ছিল ২২৭।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, শুধু ১৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ১ হাজার ৩৫৬টি শিশু। আর জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সাত মাসে ধর্ষণ, উত্ত্যক্তসহ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ৩৪৭টি শিশু। এর মধ্যে শুধু গণধর্ষণের শিকার ছিল ৬১টি শিশু। ৩৪৭টি শিশুর মধ্যে চারটি ছেলেশিশুও এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ৬ মাসে ৩৭১ জন ধর্ষিতার মধ্যে মেয়ে শিশু রয়েছে ২৬৩ জন, ১০৫ জন নারী এবং বাকি তিনজনের বয়স জানা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর নাসরীন খানম বলেন, শুধু ধর্ষণকারীরা নয়, খুনীরাও দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আর এ জন্য দায়ী বিচারহীনতার সংস্কৃতি। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায় দেশবাসীকে হতাশ করছে আর খুনীদের উৎসাহিত করছে। তিনি বলেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হযেছে। এজন্য ধর্ষণের মতো পাশবিক কর্মকান্ড বাড়ছে। বগুড়ার ছাত্রীকে যারা ধর্ষণ করেছে এবং তাকে ও তার মাকে যারা নির্যাতন করেছে, যারা শিশু ধর্ষণ করছে এবং ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ গুমের চেষ্টা করছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনকে আরো কঠোর হতে হবে। আইনি ও বিচার ব্যবস্থা কঠোর হতে হবে। এ ধরনের ক্রিমিনালদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকর করতে হবে। যাতে করে কঠোর বিচারব্যবস্থার কারণে অপরাধীদের মধ্যে ভয়ভীতি কাজ করে। প্রফেসর নাসরীন বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং এ ধরনের পাশবিক ও জঘন্য অপরাধের সাথে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতে দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।



 

Show all comments
  • সোলায়মান ৮ আগস্ট, ২০১৭, ২:৪৯ এএম says : 0
    ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন এবং নীতি নৈতিকতার অভাবে আজ যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে
    Total Reply(0) Reply
  • আশিক ৮ আগস্ট, ২০১৭, ২:৫০ এএম says : 0
    প্রফেসর নাসরীন একদম ঠিক কথা বলেছেন যে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং এ ধরনের পাশবিক ও জঘন্য অপরাধের সাথে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতে দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাহলে এই ধরনের অপরাধ আস্তে আস্তে কমে আসবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্ষণ

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ