Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাধবকুন্ড হতে পারে পর্যটনের এক আকর্ষণীয় স্পট

| প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মানব মনের খোরাক চলে আসছে পাশাপাশি। মানুষ তার পরিশ্রান্ত জীবনে যখনই ক্লান্ত হয়ে ওঠে তখন ক্ষণিক ক্লান্তি নিরসনের জন্য খোঁজে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমÐিত ও মনোমুগ্ধকর কোন স্থান। মানুষের এই ক্লান্তি নিরসন ও মানসিক তৃপ্তি যে আদি কাল থেকে চলে আসছে, আদিম মানুষের ঘুরে বেড়ানোর ইতিহাসই এর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
সৃষ্টিকর্তা মানব মনের তৃপ্তি ও প্রশান্তির দিক লক্ষ রেখে পৃথিবীর বুকে কিছু কিছু স্থান তৈরি করেছেন যা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এরূপ কিছু কিছু স্থান পরিলক্ষিত হয়, যা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ও এলাকা হিসাবে। তেমনি একটি স্থান আমাদের ‘মাধবকুন্ড’। বৃহত্তম সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার উত্তর পূর্বাংশে বড়লেখা থানাধীন বাংলাদেশের পাথারিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই ‘মাধবকুন্ড’। ভারতের ত্রিপুরা থেকে পাথারিয়া পাহাড়টি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
মাধবকুন্ড টার শিয়ারীকালের পাহাড়। ভূতত্ত¡-ভূমিরূপ, গাছপালা জীবজন্তু, খাশিয়া-পল্লী, কমলালেবু ও পানের বাগান, পাহাড়ী ¯্রােতে গড়িয়ে আসা বিভিন্ন সাইজের পাথর এবং এর ভৌতিক কাঠামো সবকিছু মিলে তৈরি হয়েছে একটি আদর্শ পর্যটন এলাকা। এখানে যাওয়ার জন্য রয়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বড়লেখা থানা থেকে একটি ইট বিছানো রাস্তা। কিছু অংশ কাঁচা। দক্ষিণ ভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার।
মাধবকুন্ড যাওয়ার পর এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য একজন স্বপ্নবিলাসী বা হৃদয়গ্রাহীর মন কেড়ে নিতে পারে সহজেই। সেই সাথে এমন সব দৃশ্য ক্লান্তি নিরসন করে মধুময় আমেজে ভরে দিতে পারে মানুষের মন। মাধবকুন্ডের ভূমিরূপ বন্ধুর, এখানকার সুবিস্তৃত পাহাড় ভারতের ত্রিপুরা পাহাড়ের সমগোত্রীয়া পাহাড়ের ভাঁজগুলো সমান কোণে একই দিকে নতজানু। মাঝে মধ্যে চ্যুতি লক্ষ করা যায়। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উপরে ওঠার জন্য রয়েছে একটি খাপকাটা রাস্তা যা দিয়ে উপরে উঠলে দেখা যায় সেখানকার পাহাড়ী নদী, লাফিয়ে চলা ঝর্ণাধারা, প্রাকৃতিক লেক ও গহিন অরণ্য। পাহাড়ের এসব দৃশ্য যেন পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
মাধবকুন্ডের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত। এর উৎস ৪ কিলোমিটার দূরে উঁচু পাহাড় শৃঙ্গ থেকে। উচ্চতা প্রায় ১৮০-২০০ শত ফুট। উঁচু থেকে অবিরাম পানিধারা পাহাড়ের পাথরী প্রলেপযুক্ত গা বেয়ে অতি দ্রæত গতিতে পতনের ফলে সৃষ্ট হয়েছে প্রবাহমান পানি ধারা যা একজন পর্যটককে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে। এই জলপ্রপাতের পানি পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে খাল বেয়ে ১৫ মাইল দূরে নিকলী নদীতে প্রবাহিত হয়। আর এই পানি রাশির সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে চলা বৃহৎ আকৃতির বোন্ডার পর্যটকদের কাছে অকল্পনীয় বস্তুর মতো। মাধবকুন্ডের এই স্থানে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা বিভিন্ন গাছপালার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে চিরহরিৎ অরণ্য। ঝোপঝাড়ের ছায়ায় কালো পানিতে পাতার ফাঁকে ফাঁকে রৌদ্রচ্ছটা পড়ে সৃষ্টি করে এক অপূর্ব আলোচ্ছায়া।
এখানকার বনে রয়েছে বিভিন্ন ফলমূল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় গাছ-গাছড়া। এই সমস্ত গাছপালা এবং ফলমূল অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে পর্যটকদের কাক্সিক্ষত গাছপালা ও বিভিন্ন উপাদানের সন্ধান দিতে পারে। এখানকার উঁচুনিচু তরঙ্গায়িত ভূমিতে চা ও কমলা লেবুর বাগান এবং সারিবদ্ধভাবে সাজানো পান সত্যিই আকর্ষণীয়।
এখানে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলার আর একটি বৈচিত্র্য উপাদান খাশিয়া উপজাতি। এদের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার পাহাড় পর্বত ও অরণ্যের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলীর মত খাশিয়াদের জীবনধারা, পরিচ্ছদ, ভাষা, তাদের তৈরি বিভিন্ন কুটির শিল্প পর্যটকদের হৃদয় কেড়ে নেবার মত আকর্ষণীয়। খাশিয়া মেয়েরা জলপ্রপাতের ঝোরা থেকে মল বাজিয়ে পানি নিয়ে নৃত্যের তালে তালে ঘরে ফিরে। খাশিয়ারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সাধারণত কম বয়সের ছেলে বেশি বয়সের মেয়েকে বিবাহ করে এবং ছেলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শ্বশুর বাড়িতে থাকে। তাদের ছেলেমেয়েদের লালনপালন, মাঠে কাজ করার সাথে সাথে সন্তানদের বহন করা পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে।
গৃহপালিত কিছু কিছু পশু পাখি ছাড়া বাকী প্রায় সমস্ত প্রাণিই মানুষের নাগালের বাইরে। আর এ সমস্ত প্রাণিকে যখন প্রাকৃতিক অরণ্যে অনায়াসে চলাচল করতে দেখা যায় তখন মন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠে এসব প্রাণিকূলকে দেখার জন্য। মাধবকুন্ডের গহিন অরণ্যে বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণি ও রঙ-বেরঙের পাখি দেখা যায়। এখানকার হাতিগুলো সাধারণত শীতের প্রকোপ কমে গেলে মাঝে মধ্যে ফাঁকা জায়গায় বিচরণের জন্য আসে। তাছাড়া শুকনো মৌসুমে অন্যান্য প্রাণিরা বেরিয়ে আসে।
সৌন্দর্যের স্বপ্নপুরী হিসাবে চিহ্নিত মাধবকুন্ডের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আলোকে ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠেছে পর্যটন স্পট, চিত্র তারকাদের জন্য শ্যুটিং ও পিকনিক স্পট। এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন উপলক্ষে ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে পিকনিক স্পটের জন্য নির্দিষ্ট স্থান, বসার বেঞ্চ, কৃত্রিম ছাতা, গোসল ঘর, সেই সাথে পার্শ্বে রাখা হয়েছে বন থেকে ধরে আনা হাতি। কিন্তু এখানে সমস্যাও রয়েছে প্রচুর, যার জন্য আদর্শ এবং পূর্ণাঙ্গ পর্যটন স্পট হিসাবে গড়ে উঠতে পারছে না।
সমস্যার-মূল স্পটে যাওয়ার জন্য নেই কোন ভালো রাস্তা, সেই সাথে পর্যটনের ভৌতিক অবকাঠামো যেমন রাস্তা, থাকা, উন্নত যোগাযোগ। শীতকালে সেখানে যেতে পারলেও পর্যটকদের গাড়ি নিয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মত কোন রাস্তা এখনও গড়ে ওঠেনি। সিলেট-মৌলভীবাজার সড়কের বড়লেখা রাস্তা থেকে ইট বিছানো কিছু পথ থাকলেও বাকী ৪/৫ মাইল রাস্তা সরু এবং কাঁচা। দক্ষিণ ভাগ রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে যে রাস্তা রয়েছে তার দূরত্ব কম হলেও সেখানে সব ট্রেনের বিরতি নেই, অপরদিকে সেখান থেকে রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। আকর্ষণীয় স্পট হিসাবে পরগণিত হলেও সেখানে ভাসমান দু’একটি দোকানপাট ছাড়া থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা নেই। পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত একটি মোটেল আছে যেখানে থাকা, খাওয়াসহ সব কিছুর দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সেবার মান মোটেই সন্তোষজনক নয়।
নেই কোন চিত্ত বিনোদন ঘর ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী যাতে একজন পর্যটক চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে তার সময় অতিবাহিত করতে পারেন। খেলাধুলার জন্য কোন মাঠ, বসার জন্য প্রকৃতি প্রদত্ত কোন জিনিষ ছাড়া বিশ্রাম বা আরাম আয়েশের কোন ব্যবস্থা এখনও গড়ে উঠেনি। এ পর্যটন কেন্দ্রে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এ পর্যন্ত তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এই অতি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটটিকে আদর্শ পর্যটন স্পট হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
মাধবকুন্ডের এই স্থানটি অনায়াসে গড়ে উঠতে পারে একটি উৎকৃষ্ট পর্যটনকেন্দ্রে। সরকার অথবা কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এখানে সুদৃষ্টি দিলে দেশ-বিদেশের অন্যান্য উৎকৃষ্ট ও আদর্শ পর্যটন স্পট অপেক্ষা মাধবকুন্ড যে কোন অংশেই কম হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এখান থেকে আয় হতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
মাধবকুন্ডের পর্যটন স্পটকে একটি পরিপূর্ণ তথা আদর্শ পর্যটন স্পট হিসাবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও কড়া নিরাপত্তা। প্রথমেই নির্মাণ করা প্রয়োজন উন্নত পাকা রাস্তা। থাকা খাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত বা কোন সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হোটেল এবং রেস্ট হাউস নির্মাণ। পিকনিক স্পটের নির্ধারিত স্থান, পর্যটকদের অবসর সময় কাটানোর জন্য চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, খেলার মাঠের ব্যবস্থা, মৎস্য শিকারের ব্যবস্থা, সেই সাথে পাশের নিকলী নদী এবং আশেপাশের লেকে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা হতে পারে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ করে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলা যেতে পারে।
মাধবকুন্ডে বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও স্থানটি যে সত্যি সত্যিই উৎকৃষ্ট এবং আকর্ষণীয় তা বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন থেকে স্পষ্ট ধারণা মেলে। ভবিষ্যতে আরো উন্নত উপাদানের সমন্বয়ে মাধবকুন্ডের সৌন্দর্য মনের তৃষ্ণা মেটাবে। এই আমাদের কামনা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন