Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নির্বাচনী হাওয়া, নির্বাচনী চিন্তা-৩

| প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক : নির্বাচনে নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেই আলোচনার ভিত্তি কীসের উপর হবে? ভিত্তি হবে আমার সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা (১৯৭০ থেকে ১৯৯৬), সচেতন নাগরিক সমাজে আমার চলাচলের অভিজ্ঞতা (১৯৯৭ থেকে ২০০৬), একজন রাজ নৈতিক কর্মী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা (২০০৭ থেকে ২০১৭), অন্যান্য দেশের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা এবং বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকগণের মূল্যায়ন বা মতামত।
আমি ব্যক্তি জীবনে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক নির্বাচনে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট র‌্যাংকধারী অফিসার ছিলাম এবং তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার শেরপুর থানায় নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছিলাম, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এর ‘সি’ কোম্পানীর একটি অংশ নিয়ে। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচনে ক্যাপ্টেন র‌্যাংকধারী অফিসার ছিলাম এবং তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমায় দায়িত্ব পালন করেছিলাম, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর পুরো ‘সি’ কোম্পানী নিয়ে। এরপর থেকে (১৯৮৬ সাল ব্যতিত) ১৯৯৬ সালের জুন পর্যন্ত সকল নির্বাচনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম বা ভূমিকা রেখেছি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা ছিল, সরকারি দায়িত্বের অংশ হিসেবে (সেই প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার ২০ জুলাই ২০১৭ তারিখের ইনকিলাবে প্রকাশিত কলামে উল্লেখ আছে)।১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচন চলাকালে যশোর অঞ্চলের জিওসি ছিলাম; অতঃপর নির্বাচনের আটদিন আগে আমি যশোর থেকে বদলী হয়ে ঢাকায় চলে আসি; কিন্তু জিওসি হিসেবে নির্বাচনকালীন সৈন্য মোতায়েন পরিকল্পনা ও দায়িত্ব বণ্টন করে আসি। আমি চলে আসার পরেও পরবর্তী জিওসি মহোদয়, ঐ পরিকল্পনার কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ আমি বাধ্যতামূলক অবসরে যাই; ১৯৯৭ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ আমার এলপিআর শেষ হয় এবং আমি সেনাবাহিনীর জনবল থেকে চূড়ান্তভাবে বিয়োগ হই। আমার অবসর জীবনে, ২০০১ সালের নির্বাচনকালে নিজেদের একটি এনজিও (যার নাম ছিল সোহাক) নিয়ে, এশিয়া ফাউন্ডেশনের সার্বিক সহযোগিতায়, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে, কয়েকটি উপজেলায় ইলেকশন মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং ১৭ নভেম্ভর ২০০৮ তারিখে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পাই। আমাদের নিবন্ধন নম্বর ০৩১ এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আমাদেরকে প্রদত্ত দলীয় মার্কা হলো ‘হাতঘড়ি’। আমাদের দলীয় পরিচয়ে এবং দলীয় মার্কা নিয়ে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিজে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী ছিলাম এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির পক্ষ থেকে ৩৬টি আসনে প্রার্থী ছিল। এই অনুচ্ছেদে প্রেক্ষাপট বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো, সম্মানিত পাঠকের সামনে তুলে ধরা যে, নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা নিয়ে আমরা অতীতেও চিন্তা করেছি এবং বর্তমানেও করছি। তার থেকেও বড় কথা, ঐরূপ চিন্তা করার জন্য আমরা যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতা পেয়েছি। কারণ, নির্বাচন নামক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই সুবাদেই বিগত দুইটি কলাম লিখেছি। নিশ্চিতভাবেই অতীতের দুইটি কলাম, আজকের কলাম এবং আগামী দু’একটি কলাম, একই সুতায় গাঁথা। সুতার নাম: নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা; নির্বাচনকালে মানুষের মনে আস্থা। এই কলামের পরবর্তী অংশটুকু, আদতেই গত দুইটি কলামের বর্ধিত অংশ।
নির্বাচনকালে নিরাপত্তার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ভূমিকা জড়িত। ২০০০ সালের প্রথমাংশে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, একটি ধারণা বা কথা, রাজ নৈতিক বাজারে ছেড়ে দেয়। ধারণা বা কথাটি ছিল: নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো প্রয়োজন নেই। তৎকালীন বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সচেতন অংশ, সরকারের ঐ ধারণা বা মনোভাবকে সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছিল। আমি তখনও একজন রাজনৈতিক কর্মী হইনি। সচেতন নাগরিক সমাজের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম। অতএব, এই বিষয়টি আমার বা আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যাঁরা তাঁদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। আমি তখন যেমন মনে করতাম, এখনও মনে করি যে, বাংলাদেশের পার্লামেন্ট নির্বাচনকালে, জনমনে শান্তি, স্বস্তি ও আস্থা প্রদানের জন্য তথা সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর তথা সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিহার্য। ২০০০ সালের বাংলাদেশ সরকার যেমন আওয়ামী লীগ দলীয় ছিল, ২০১৩-১৪ সালের এবং ২০১৭ সালের বাংলাদেশ সরকারও আওয়ামী লীগ দলীয়। ২০০০ সালে বা ২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ যেই ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে ওঠেনি, তাঁরা সেই ধারণাটিকে ২০১৩-১৪ সালে প্রায়ই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। আমাদের কামনা এই যে, আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার যেন সেই ধারণাটি বদলায়; অর্থাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তারা নির্বাচন থেকে অনেক দূরে না রাখে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কম্বোডিয়া বা লাইবেরিয়া বা বসনিয়া বা কঙ্গো নামক দেশগুলোতে নির্বাচনে ওতোপ্রোতো সহায়তা করুক, এতে আওয়ামী লীগ নামক রাজ নৈতিক দলের বা আওয়ামী লীগ দলীয় রাজ নৈতিক সরকারের কোনো আপত্তি নেই; কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করানোর কাজে কোনো ভূমিকা রাখুক এতে উনাদের যথেষ্ট আপত্তি। বিষয়টি বিদঘুটে। বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। সেই আলোচনাটিই আমরা করছি।
আমাদের দেশের নির্বাচনকালীন যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার রীতি তা খুবই গতানুগতিক। গত ৪০-৪৫ বছরেও এই ব্যবস্থায় বা রেওয়াজে বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি, বহু বিষয়ে পরিবর্তন সূচিত হলেও নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার শৈথিল্য রীতিমতো আশ্চর্য্যরে বিষয়। সুতরাং এই গতানুগতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য। সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দল (যথা বিশ-পঁচিশজনের একটি দল) পরোক্ষভাবে একটি থানার এলাকায় নিরাপত্তা প্রদান করবে, অথবা সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দল (যথা দশ-বারোজন) কোনো একটি থানার সদর দপ্তরে আসন গেড়ে বসে ঐ থানার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি কষ্টসাধ্য ও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সা¤প্রতিককালে র‌্যাব নামক একটি বাহিনী সৃষ্টি হয়েছে। তারাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়। পুলিশ বাহিনীর মধ্যেই একটি অঙ্গ আছে যাদেরকে বলা হতো আর্ম পুলিশ ব্যাটালিয়ন; এরাও কোনো কোনো জায়গায় নিরাপত্তা দেয়। তবে নির্বাচনের আগে সাধারণত নিরাপত্তার দায়িত্বটি পুলিশের হাতে থাকে; চাইলে বা মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী সেখানে ভূমিকা রাখে। নির্বাচনের আগের রাত, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনী দিনের অনুগামী রাত এই সময়টিতে এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর উপরে। এবং এই দায়িত্বটিও পালনের নিমিত্তে নির্বাচনী কেন্দ্র বা ভোট কেন্দ্র বা পেলিং সেন্টার অনুযায়ী পুলিশ আনসার মোতায়েন করা হয়। সীমান্তবর্তী থানার ব্যাপারে পরের একটি অনুচ্ছেদে বলছি। সামগ্রিকভাবে, নির্বাচনের দিনে, ভোট কেন্দ্রের বাইরে যে নিরাপত্তা প্রয়োজন, যার আলোচনা গত কলামে করেছি, সে সম্মন্ধে আমাদের সচেতনতা খুবই কম।
বর্তমানে বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী নির্বাচন একদিনে অনুষ্ঠিত হয়। একদিনে অনুষ্ঠান করার পরিবর্তে, একাধিক দিনে অনুষ্ঠান করা যায় কিনা, বা একাধিক দিনে অনুষ্ঠান করা উচিত কিন্তু সেটিও একটি সময়োপযোগী আলোচনার বিষয়। কিন্তু ওই আলোচনাটি আজকের এই কলামে নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী নির্বাচনে পোলিং স্টেশনের সংখ্যা ছাব্বিশ হাজারের বেশি। প্রত্যেক নির্বাচনী কেন্দ্রে একজন বা দ্ইুজন অস্ত্রধারী পুলিশ, একজন বা দুইজন অস্ত্রধারী অস্ত্রধারী আনসার এবং অনধিক বারোজন বিনা অস্ত্রধারী আনসার থাকে। আনসাররা আসে নির্বাচনের দুইদিন বা তিনদিন আগে। তাদেরকে এমবডিমেন্ট করা হয় এবং নির্বাচনের ১দিন বা ২দিন পরই তাদেরকে ডিস-এমবিডমেন্ট করা হয়। সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে ২০১৪ সালেল অভিজ্ঞতা বাদ দিচ্ছি। ১৯৭৩ সালের মার্চের নির্বাচন থেকে ২০০৮ এর ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত, সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে যেই রেওয়াজ ছিল সেটি এখানে আলোচনা করছি। দেশব্যাপী সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় পাঁচ থেকে নয় দিনের জন্য। এই ছবিটি দেশের শতকরা ৯০ ভাগ নির্বাচনী কেন্দ্রের জন্য প্রযোজ্য। বাকি আনুমানিক ১০ ভাগ নির্বাচনী কেন্দ্রকে আমরা বলতে পারি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মূল্যায়নপূর্বক কয়েকজন বেশি পুলিশ বা আনসার মোতায়েন করে। নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ডিউটি করে না। মহানগরীগুলোতে বিডিআর নির্বাচনী কেন্দ্রে প্রত্যক্ষ ডিউটি করলেও অন্যত্র প্রত্যক্ষ ডিউটি করে না। দেশের প্রতিটি থানায় আলাদাভাবে সেনাবাহিনী বা বিজিবি (সাবেক বিডিআর) মোতায়েন করা হয়।
এই কলামের অনেক জায়গাতেই থানা (ইংরেজিতে পুলিশ স্টেশন) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। থানা শব্দের পরিবর্তে উপজেলাও পড়া যায়। বাংলাদেশের মানচিত্র ঘাটলে আপনারা দেখবেন, ১২০টি থানা বা উপজেলা আছে যেইগুলো সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত তথা তাদের সঙ্গেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এছাড়াও সমুদ্র বেষ্টিত বা দ্বীপাঞ্চলীয় থানা আছে ৫-৬টি; যেগুলোতে নির্বাচনকালে নৌ বাহিনী পাঠানো হয়। বর্ডারিং থানাগুলোতে সাধারণত সেনাবাহিনী পাঠানো হয় না, বরং বিজিবি (সাবেক বিডিআর) পাঠানো হয়। বিজিবি পাঠানো বললে ভুল হবে, বিজিবি, সীমান্ত এলাকায় সারা বছরই ডিউটি করছে। সুতরাং বিজিবি পাঠানো মানে ঢাকা বা সংশ্লিষ্ট সেক্টর থেকে অতিরিক্ত কিছু বিজিবি সৈন্য পাঠানো যাতে করে বিওপিগুলো একদম সৈন্যবিহীন না হয় বা বর্ডার পেট্রোলিং একদম বন্ধ হয়ে না যায়। বর্ডারিং থানাগুলোতে সেনাবাহিনী পাঠানো হয় না ইচ্ছাকৃতভাবে যাতে সীমান্তবর্তী এলাকাতে সেনাবাহিনীকে চলাচল করতে না হয়। দেশের অন্যান্য সকল থানায় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। কোনো জায়গায় ৩০ জন, কোনো জায়গায় ৪০ জন ও কোনো জায়গায় ৫০ জন এরকমভাবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল ইত্যাদি নগর বা মহানগরে সেনাবাহিনী বা বিজিবি উভয়ই মোতায়েন করা হয়। বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি এই সকল বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পড়ে। দেশে আইন শৃংখলা রক্ষা তথা স্বাভাবিক সকল কর্মকান্ডের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপর। বেসামরিক প্রশাসন তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করার জন্য দেশের বিদ্যমান আইনের অধীনেই সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত, প্রচলিত বা অনুসরণ করা যে থিওরী বা তত্তে¡র ভিত্তিতে সেনাবাহিনী নির্বাচনকালে দায়িত্ব পালন করে আসছে সেটি হলো, ‘বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় কর্তব্য পালন’ তথা ইংরেজি পরিভাষায় ‘ডিউটিজ ইন এইড অফ সিভিল পাওয়ার।’ মূল লক্ষ্য হচ্ছে: শো অফ ফোর্স বা শক্তি প্রদর্শন-এর দ্বারা অশান্তি-সৃষ্টিকারী মানুষের মনে বা বিশেষত: সন্ত্রাসীগণের মনে ‘ডিটারেন্স’ বা গন্ডগোল না করার মানসিকতা সৃষ্টি করা; অপরপক্ষে শান্তিপ্রিয় জনগণের মনে আস্থার সৃষ্টি করা। সেনাদল কোনো থানা বা উপজেলায় মোতায়েন হওয়ার পর বেশিরভাগ সময় যানবাহনে করে এবং কম সময় পায়ে হেঁটে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। এটিই তাদের মূখ্য কাজ। যদি নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন কোনো ম্যাজিস্ট্রেট আনুষ্ঠানিকভাবে বলে যে, কোনো এক জায়গায় গন্ডগোল হচ্ছে যেটি দমন করার জন্য সেনাবাহিনী প্রয়োজন তাহলেই মাত্র ঐ সেনাদল কাজে লাগে, তা না হলে ঐ শো অফ ফোর্সেই তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশের অনেক থানায় বা উপজেলায়, এখন ২০১৭ সালে এসেও, যোগাযোগের ব্যবস্থা এমন যে, ঐগুলোর অভ্যন্তরে চলাচলের বিশেষ কোনো উন্নত ব্যবস্থা নেই। চলাচলের জন্য অতিরিক্ত কোনো যানবাহনও নেই; ঐসকল দুর্গম জায়গায় চান্দের গাড়ি বা ভ্যান গাড়ি বা গরুর গাড়ি বা নসিমন-ভটভটি বা ট্রাক্টর ছাড়া অন্য কোনো বাহন নেই। আরও কিছু থানা আছে যেগুলো এতটাই নদীমাতৃক যে, সেখানে কোনো সড়কই নেই এবং চলাচলের একমাত্র উপযুক্ত বাহন স্পিড বোট, শ্যালো ইঞ্জিন চালিত দেশি নৌকা বা লঞ্চ ইত্যাদি। যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে, যানবাহন চলাচলের সড়কের অভাবের কারণে এবং সৈন্য সংখ্যার স্বল্পতার কারণে একটি থানায় মোতায়েন করা সেনা দল বা বিজিবি দল-এর পক্ষে সবময়ই একটি স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়, কোনো কোনো সময় দুইটি স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় এবং কদাচিৎ তিনটি বা তার অধিক স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়। কতজন সৈনিক একটি থানায় বা উপজেলায় সাধারণত মোতায়েন হয় এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে, নিম্নে ২৫ থেকে ঊর্ধ্বে ৮০ জন পর্যন্ত যেতে পারে। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হচ্ছে, বিদ্যমান আইনে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যতিত সেনাদল কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অতএব ম্যাজিস্ট্রেট এর অপ্রতুলতা সেনাবাহিনীর কার্যক্ষমতা বিকাশে একটি সীমাবদ্ধতা।
উপরে বর্ণিত ‘শো অফ ফোর্স’ বা ডিটারেন্স তত্ত¡টি এখন কতটা বাস্তবসম্মত সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। আমার মূল্যায়নে, সেনাবাহিনীকে শুধু দেখেই ভয় পাওয়ার দিন চলে গেছে। কোনো উপজেলায় বা থানায় সেনাদল স্বশরীরে কোন্ জায়গায় অবস্থান করছে, ঐ সেনাদলের কাছে কী যানবাহন আছে, থানা বা উপজেলার অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ঐ সেনাদলের তা তাদের একটি অংশের কত সময় লাগবে ইত্যাদি কোনো গোপন জিনিস নয়। এ সকল তথ্য বা মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে, একটি সেনাদল কোনো একটি থানায় মোতায়েনরত অবস্থায় কী কী কাজ করতে পারবে বা কী কী করতে পারবে না, সেটি বুদ্ধিমান জনগণ বিশেষত রাজ নৈতিক সন্ত্রাসীরা অতি সহজেই হিসাব-নিকাশ করে ফেলতে পারে। সম্মানিত পাঠক, খেয়াল করুন আমি যেই শব্দযুগল ব্যবহার করেছি সেটি হলো রাজ নৈতিক সন্ত্রাসী। এইজন্যই বললাম যে, ‘ শো অব ফোর্স’ তত্তে¡র কার্যকারিতা এখন অতি সীমিত। বিশেষত, একদিন-দুইদিন একটি এলাকাতে ঘুরে আসলেই, রাজনৈতিক সন্ত্রাসীগণ ঐ এলাকা ছেড়ে পালাবেন, এমন নাও হতে পারে। তাহলে কী করণীয়? সেনাবাহিনীকে এমন একটি সময় হাতে রেখে মোতায়েন করতে হবে, যেন সেনাবাহিনীর দল যাদেরকে সেনাবাহিনীর পরিভাষায়, সেকশন বা প্লাটুন বা কোম্পানী বলে, ঐরূপ দলগুলো যেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা নিবিড়ভাবে চেনে এবং ঐ এলাকার আইন শৃংখলা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি নিবিড় জ্ঞান অর্জন করে। সেজন্যই ‘বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সেনা মোতায়েন’Íএর বিধি তথা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ আংশিকভাবে বদল করার সময় এসেছে। এই প্রসঙ্গে আলোচনা আগামী কলামে অব্যাহত থাকবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com



 

Show all comments
  • মোঃ মনিরুল ইসলাম সরকার ৩ আগস্ট, ২০১৭, ৬:৫১ পিএম says : 0
    স্যার আপনার মতামত অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সেনা মোতায়েন করা হলে, নির্বাচন নিরপেহ্ম হওয়ার সম্ভাবনা হয়ে যায় ৯০%। বাকী ১০% সম্ভাবনা হাতে নিয়ে যারা গোলাপানিতে মাছ শিকারে বেশী আগ্রহী তারা অত সহজে ছার দেবে না। নির্বাচন কালিন সরকার, সহায়ক সরকার সমস্ত concept নির্বাচন নিরপেহ্ম করার উদ্বেশ্যেে।নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনা মোতায়েন করতে পারলে সকল সমস্যা সমাধানের পথে চলে আসে। ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ