হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক : বৃহস্পতিবার ২০ জুলাই ২০১৭ তারিখে ইনকিলাবের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আমার লেখা কলামটির শিরোনাম ছিল: ‘নির্বাচনী হাওয়া, নির্বাচনী চিন্তা-১’। ওই কলামের মোটামুটিভাবে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছি। আলোচনার একটি পর্যায়ে, ১৯৯০-৯১ সালের পরিস্থিতি ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনার কথা স্মৃতিচারণ করেছি। নিরাপত্তা প্রদান করবে নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট বাহিনীসমূহ। ঐরূপ বাহিনীসমূহের তালিকা নির্বাচন কমিশনে রক্ষিত থাকে তথা সরকার কর্তৃক আইনগতভাবে তালিকা করা থাকে। ঐরূপ তালিকায় পুলিশ, বিজিবি, আনসার ইত্যাদির সঙ্গে সামরিক বাহিনীসমূহের নামও ছিল। কিন্তু কয়েক বছর আগে, আওয়ামী লীগ সরকার, অতি নিরবে, সংশোধনীর মাধ্যমে, ওই তালিকা থেকে সামরিক বাহিনীর নাম বাদ দিয়েছে। কিন্তু আমি এবং আমার মতো কোটি কোটি মানুষ মনে করে, বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে ‘ভোলাটাইল’ একটি দেশে, নির্বাচনকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মোতায়েন করা বা সেনাবাহিনীর সহায়তা গ্রহণ করা অপরিহার্য এবং আবশ্যক। এই প্রসঙ্গে আজকে এবং আগামীতে আরো কলামে আলোচনা করবো। আমরা মনে রাখতে চাই, নির্বাচনকালীন যে কোনো সরকারের সাফল্য নির্ভর করবে, একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান করানোর ওপর। নির্বাচনের সংজ্ঞা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিকশনারিতে বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্য বইয়ে যত বিস্তারিত ও স্পষ্টভাবে দেওয়া আছে, অনুরূপ বিস্তারিত ব্যাখ্যামূলক আলোচনা আছে সুন্দর নির্বাচন প্রসঙ্গে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রসঙ্গে। ইংরেজি পরিভাষায় শব্দগুলো হলো ক্রেডিবল ইলেকশন, একসেপ্টেবল ইলেকশন। কোনো একটি নির্বাচনকে যদি সুন্দর হতে হয়, ক্রেডিবল হতে হয়, গ্রহণযোগ্য হতে হয়, বিশ্বাসযোগ্য হতে হয়, তাহলে সেখানে অনেকগুলো উপাত্ত কাজ করবে। আমার বিবেচনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত হলো নিরাপত্তা; ইংরেজি পরিভাষায় যাকে বলা যায় সিকিউরিটি। যেমন বললাম একটু আগেই, ওই নিরাপত্তা প্রদানের প্রক্রিয়ায়, আমাদের মূল্যায়নে, সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেনাবাহিনী নিয়ে এবং আওয়ামী লীগের দলীয় (অতীত) চিন্তা নিয়ে আলোচনা করছি। কিছুদিন পরে, বর্তমান নিয়ে আলোচনা করবো।
নির্বাচনকালে নিরাপত্তার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ভূমিকা জড়িত। ২০০০ সালের প্রথমাংশে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, একটি ধারণা বা কথা রাজনৈতিক বাজারে ছেড়ে দেয়। ধারণা বা কথাটি ছিল: নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো প্রয়োজন নেই। তৎকালীন বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সচেতন অংশ, সরকারের ওই ধারণা বা মনোভাবকে সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছিল। আমি তখনও একজন রাজনৈতিক কর্মী হইনি। সচেতন নাগরিক সমাজের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম। অতএব, এই বিষয়টি আমার বা আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যাঁরা তাঁদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। আমি তখন যেমন মনে করতাম, এখনও মনে করি যে, বাংলাদেশের পার্লামেন্ট নির্বাচনকালে, জনমনে শান্তি, স্বস্তি ও আস্থা প্রদানের জন্য তথা সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর তথা সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিহার্য। ২০০০ সালের বাংলাদেশ সরকার যেমন আওয়ামী লীগ দলীয় ছিল, ২০১৩-১৪ সালের এবং ২০১৭ সালের বাংলাদেশ সরকারও আওয়ামী লীগ দলীয়। ২০০০ সালে বা ২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ যেই ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে ওঠেনি, তাঁরা সেই ধারণাটিকে ২০১৩-১৪ সালে প্রায়ই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তারা নির্বাচন থেকে অনেক দূরে রাখবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কম্বোডিয়া বা লাইবেরিয়া বা বসনিয়া বা কঙ্গো নামক দেশগুলোতে নির্বাচনে ওতোপ্রোতো সহায়তা করুক, এতে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলের বা আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনৈতিক সরকারের কোনো আপত্তি নেই; কিন্তুবাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করানোর কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো ভূমিকা রাখুক এতে তাদের যথেষ্ট আপত্তি। বিষয়টি বিদঘুটে। বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। সেই আলোচনা, আমি গত সপ্তাহের কলামের মাধ্যমে শুরু করেছি। আগ্রহী পাঠকগণ নিশ্চিতভাবেই গত সপ্তাহের কলামটিকে নিজের সংগ্রহে রাখবেন। আজকের কলামটিকেও নিজের সংরক্ষণে রাখবেন। নিজে রাখবেন, বন্ধু-বান্ধবকে রাখায় সাহায্য করবেন। পুরো পেপার রাখতে না পারলেও, কলামটি পত্রিকা থেকে কাটিং করে অথবা কাটিংয়ের ফটোকপি করে, সুন্দর করে ফাইলে রেখে সংরক্ষণ করতে পারলে ভালো। আজকের আলোচনাটি অসমাপ্ত আলোচনা। অর্থাৎ আগামী সপ্তাহেও চলবে।
বাংলাদেশে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০১৪-এর নির্বাচনের পূর্বে প্রচন্ড রাজনৈতিক আন্দোলন বিরাজমান ছিল। ওই রকম প্রচন্ড রাজনৈতিক আন্দোলন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে না থাকলেও কোনো না কোনো কারণে সেটি যে আবার দানা বেঁধে উঠবে না, সে সম্পর্কে হ্যাঁ বা না কোনোটিই বলা যায় না। ’৯১, ’৯৬ এবং ২০০৮ এইসকল ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনই দেশের শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক শাসনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে। ঐ প্রেক্ষাপটে, আমার মূল্যায়নে, ভবিষ্যতেও শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য। সুষ্ঠু নির্বাচনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। যথা, নির্বাচনের পূর্বে কম বিশৃঙ্খলা, নির্বাচনের দিন ভোটারগণের নির্ভয়ে ভোট প্রদান করা, নির্বাচন পরিচালনা বা নির্বাচন কেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কর্মকান্ডগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা এবং সকল পক্ষ কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফলকে গ্রহণ করা বা তা মেনে নেওয়া। এগুলোর সঙ্গে অনেক আইন জড়িত এবং বিগত ৩০-৪০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর সুষ্ঠুতা অধিকহারে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। আমার মতে, নির্বাচনের অব্যাবহিত পূর্বে এবং নির্বাচন চলাকালে সমাজে ও জনপদে শান্তি-শৃঙ্খলা বহাল রাখতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যই লংঘিত হয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন ছিল একটি বিপুল উদ্দীপনাময় নির্বাচন। নতুন আঙ্গিকে ১৯৯১ সালের নির্বাচন একটি নব দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ছিল ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচন। আমরা বলবো উভয়টিই ভালো ছিল। অনুরূপ ধারাবাহিকতায় ২০০১ এবং ২০০৮ এর নির্বাচনটিও গ্রহণযোগ্য ছিল। সুতরাং আমাদের এই মুহুর্তে প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য। আগামী নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তথা আগামী নির্বাচনে যদি ভোটারগণ ভোট দিতে না পারে, তাহলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সাংঘাতিকভাবে, মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে অতি শীঘ্রই রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার আশঙ্কা আছে। অপরপক্ষে, যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয় তাহলে যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা আছে যে, সকল মহল ঐ নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নেবে। ঐ ক্ষেত্রে দেশে শান্তিপূর্ণ প্রশাসন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও চলতে পারবে।
নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা উন্নয়নে অনেকগুলো চালিকা শক্তি আছে, তার মধ্যে নিরাপত্তার ভূমিকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। নিরাপত্তার অনেক আঙ্গিক আছে, তবে নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্যতা উন্নয়নে নিরাপত্তার কার্যকর আঙ্গিকসমূহ বিবেচ্য বিষয়। এমনকি বিশ্বাসযোগ্যতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে মানুষের সামগ্রিক নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারটি প্রণিধানযোগ্য। ‘নিরাপত্তার সামগ্রিক ভূমিকাই’ নির্বাচনী বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারে। সঠিক নিরাপত্তা প্রদানের মধ্যেই বিশ্বাসযোগ্যতা নিহিত আছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবো যে, নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নেওয়ার মনমানসিকতা আমাদের মধ্যে আংশিকভাবে অবর্তমান।
নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণ তথা মনিষীগণ অবিরাম সন্ধানী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে আলোচনা আমরা অতীতেও অল্প করেছি, ভবিষ্যতেও হয়তো করবো। তবে আজ নিরাপত্তা নিয়েই বেশি কথা বলবো। শুধু এইটুকু বলে রাখি যে, নিরপেক্ষতা বলতে যা বোঝায় সেটি মনমানসিকতা ও সাহসের সঙ্গে সম্পর্কিত। নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে গেলে সেই কাজের ফলাফল কারো না কারো পক্ষে বা বিপক্ষে যাবে, কিন্তু যেটিই হয় সেটি যুক্তিসঙ্গতভাবে হবে। নিরপেক্ষতা না থাকার পেছনে অন্যতম কারণ ভীতি। ভীতি দূর করতে হলে নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। নিরাপদ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনরত যে কোনো ব্যক্তি নিরপেক্ষ থাকার সাহস পায়।
নির্বাচনকালে নিরাপত্তার ব্যাখ্যা করতে গেলে কয়েকটি আঙ্গিক আলোচনা করতে হবে।
প্রথম আঙ্গিক: নির্বাচনী প্রচার, মিছিল ইত্যাদির সময়ে নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে যে, নির্বাচনের আগে প্রচারাভিযানকালীন অনেক সংঘর্ষ, হাতাহাতি, এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে। সুতরাং এরূপ পরিস্থিতি কোনো সময়ের জন্য কাক্সিক্ষত নয়। নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে হলে এই সময়ের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় আঙ্গিক: এক্ষেত্রে অনেকটা সামগ্রিক নিরাপত্তার বিষয়টি চলে আসে। কেননা, ভোটের অধিকার মানুষের একটি বড় অধিকার যা মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে। কাজেই মানুষ কাকে নির্বাচিত করবে এবং এতদসংক্রান্ত খোলা আলোচনার জন্য সেই ধরণের সময়োপযোগী পরিবেশ তৈরি করা জরুরী। এক্ষেত্রে সুষ্ঠু নিরাপত্তা ব্যবস্থা সমুন্নত থাকলে মানুষ তার মত বিনিময়ের সুযোগ পাবে এবং তার সুচিন্তিত মতামত প্রদান করতে পারবে। ফলে, গুন্ডামী, চাপ প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন প্রভৃতি অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সাজাতে হবে।
তৃতীয় আঙ্গিক: নির্বাচনকালীন নির্বাচনী জনসভা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনসভাতেই প্রার্থী তার প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি রাখে। এই নির্বাচনী জনসভার সময়ও অনেক ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে, যা জনমানসে অনেক ভীতির সঞ্চার করে। জনসভাগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাহীনতাই এর জন্য দায়ী। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে এই ধরনের জনসভা মানুষকে সর্বক্ষণই ভীতি সৃষ্টি করাবে। অনেক সময় নির্বাচনী জনসভায় বোমাবাজি, হুড়োহুড়ি ইত্যাদির জন্য অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বজায় রাখা খুবই জরুরি।
চতুর্থ আঙ্গিক: মানুষের মধ্যে তার নিজস্ব মতামত সৃষ্টি করার পরিবেশ তৈরি বেশ মূল্যবান বিষয়। এক্ষেত্রে, কোনো একটি মানুষের মধ্যে তার সুষ্ঠু মানসিকতা সৃষ্টি তখনই সম্ভব, যখন তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকবে। উন্নত পরিবেশই তার উন্নত মানসিকতা সৃষ্টিতে সহায়ক। কে ভালো, কে মন্দ বিচার করার মানসিকতা তখনই হবে যখন তার সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। বল প্রয়োগে ভীতি, বাড়ি ছাড়া করার ভীতি প্রদর্শন চলতে থাকলে এই পরিবেশ আনয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং এই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার গুরুত্ব মোটেই কম নয়।
পঞ্চম আঙ্গিক: ভোটের দিন গ্রামবাসী ও শহরবাসী উভয় এলাকার জনগণের জন্য ভোট কেন্দ্রে যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে আসতে পারে এবং ঘরে ফিরতে পারে তার জন্য নিরাপত্তার ভূমিকা অত্যন্ত মুখ্য ব্যাপার। মানুষ যদি আতঙ্কে থাকে যে, রাস্তায় গেলেই বিপদ, সেক্ষেত্রে মানুষের ভোট দেওয়ার ইচ্ছাটা উবে যায় এবং অনেক ভোটারকে ভোটদান থেকে বিরত থাকতে হয়। কাজেই ভোটের দিন যাতায়াতের জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, ভোট কেন্দ্রে যেতে না পারার জন্য জনমানসে অনেক ক্ষোভ ও অতৃপ্তির ছায়া ফুটে ওঠে। জনগণকে তাদের সঠিক নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে যাতে কেউ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।
ষষ্ঠ আঙ্গিক: আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই যে ঘটনা ঘটে সেটি হচ্ছে, ভোট কেন্দ্র পর্যন্ত শারীরিকভাবে আসা সত্তে¡ও একজন ভোটারকে ভোট দিতে না দেওয়া, বরং তার নামের ব্যালট পেপারটি অন্যকে দিয়ে বাক্সে পুরিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় যে ঘটনাটি ঘটে সেটি হচ্ছে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা এবং বাক্সের ভিতরের বৈধ কাগজগুলোকে ফেলে দিয়ে অবৈধ কাগজ ঢুকিয়ে দেওয়া। এটি সম্ভব হয় তখনই যখন সরকার প্রদত্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল থাকে। দুর্বলতার সুযোগে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে অথবা রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নির্বাচনী কর্মকর্তা যথা প্রিসাইডিং অফিসার, অ্যাসিসটেন্ট প্রিসাইডিং অফিসার ইত্যাদিগণ, অবৈধ কাজ করেন বা করতে বাধ্য হন।
নির্বাচনের ঠিক তিন-চারদিন আগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নির্ধারণের উপরই নির্বাচন সুষ্ঠুতার বৃহদাংশ নির্ভর করে। কেননা, ঐ ধরনের পরিস্থিতিতে ভোট কেনা-বেচা থেকে শুরু করে অনেক ধরনের অসদুপায় অবলম্বন চলতে থাকে। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ এবং তার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই এই দূরাবস্থা, যা উপরে উল্লিখিত, তা নির্মূল করা সম্ভব। তাছাড়া, নির্বাচন পূর্ব নিরাপত্তার উপরই পূর্ণ পরিবেশের চিত্র ফুটে ওঠে এবং তা অনেকাংশে আঁচ করা সম্ভব হয় যে, কী ধরনের নির্বাচন হবে।
নির্বাচনের দিন নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা অন্যান্য দিন থেকে ভিন্নতর এবং নিবিড় আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, ভোট প্রদান ও ভোট গ্রহণ নিশ্চিত করতে গেলে নির্বাচনের দিনই অধিকতর নিরাপত্তা প্রয়োজন। প্রয়োজনের একটি ক্ষেত্র হলো, ভোটারগণ যেন নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিরাপদে ভোট কেন্দ্র পর্যন্ত আসতে পারে, পথে যেন তাৎক্ষণিক কোনো বাধা না পায় বা ভবিষ্যতের জন্য হুমকি না পায়। ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় কেউ যেন ভোটারগণকে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রার্থীর অনুকূলে ভোট আদায়ের লক্ষ্যে, ভয় দেখাতে না পারে। আরেকটি ক্ষেত্র হলো, নির্বাচন কেন্দ্রের ভিতরে যেখানে পোলিং এজেন্টরা বসে এবং যেখানে ব্যালট পেপার হাতে দেওয়া হয়, সেখানে যেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, যে ভোটারগণ ভোট দিতে আসলেন কিন্তু নিজের ভোট নিজে দিতে পারলেন না, অন্যরা তার ভোট দিয়ে দিল এবং ভোটার কারো কাছে নালিশও করতে পারবে না। বিগত নির্বাচনগুলোর ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নিরাপত্তার অভাবজনিত সমস্যার জন্যই অনেক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এছাড়া সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ ও প্রদান সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
যেমনটি আগে বলে রেখেছি, আজকের কলামের আলোচনাটি গত সপ্তাহের আলোচনা থেকে ধারাবাহিক; আগামী সপ্তাহেরটিও আজকের আলোচনা থেকে ধারাবাহিক হবে। আশাকরি, বাংলাদেশে প্রচলিত নিরাপত্তা প্রদানের রেওয়াজ, গতানুগতিক চিন্তা ও আচরণের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা; সেনাবাহিনী মোতায়েনের দর্শন বা তত্ত¡ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করবো।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।