Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পাহাড় কাটা বন্ধ না হলে থামবে না ধস

| প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন : থামছে না পাহাড় ধস। মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে পাহাড় ছাড়তে নারাজ সেখানে বসবাসরত বাঙালি ও পাহাড়িরা। নদীর মতো পাহাড়ও জীবন্ত। এরপরও পাহাড় কেটে ঘর-বাড়ি তৈরি, রাস্তা নির্মাণ এবং চাষাবাদ বন্ধ হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলো বালুময় পাহাড় এবং এসব পাহাড়ের ভেতরে অনেক ফাটল থাকায় অতিবৃষ্টির ফলে প্রাকৃতিকভাবেই পাহাড়ের ফাটলে পানি ঢুকে ধস হচ্ছে। এছাড়া অবৈধভাবে প্রচুর অপরিমিত পাহাড় কাটার ফলে পাহাড় ধস হচ্ছে এবং পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী অনেকে মারা যাচ্ছেন। জুম চাষের নামে পাহাড়ের গাছ কেটে সমতলের মতো চাষাবাদ করা হচ্ছে। এটিও পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ। প্রশাসনের সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালি ও পাহাড়িদের সচেতন করা সম্ভব না হলে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না বলে বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ ঘাস ও গাছ কাটা, পাহাড় কেটে জুম চাষ এবং পাহাড়ের মাটি কেটে ঘর তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে গাছ কাটা, জুম চাষ এবং পাহাড় কেটে ঘর তৈরিতে এগিয়ে রয়েছে পাহাড়িরা। গত ১১-১৩ জুন ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজারে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের কারণে প্রাণহানির ঘটনা একেবারে নতুন না হলেও এ বছরের পাহাড় ধসজনিত বিপর্যয় ইতিপূর্বের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েক দিনে বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশ কয়েক জায়গায় পাহাড় ধসে অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে। বাংলাদেশে পাহাড় ধসে প্রাণহানিকে আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত এবং রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমেই এর সমাধান করতে হবে। পাহাড়ের বনে গাছ কেটে বন উজাড় করার কারণে এবং পাহাড়ে প্রচলিত কৃষিব্যবস্থা জুম চাষের পরিবর্তে লাঙ্গল-কোদালের চাষ করার ফলে ধস বাড়ছে। তিনি বলেন, ২০০৭ সালের বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন এবং এর দশ বছর পর ২০১৭ সালেও পাহাড় ধসের পেছনে এসব কারণই উঠে এসেছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো থেকে মানুষকে সরানো যায় না কেন? এর উত্তরে অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, ছিন্নমূল এসব মানুষের কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় তারা কম খরচে এসব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাতেই বসবাস করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে এ ঘরগুলো তৈরি করেন।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, তারা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদের কাজ শুরু করেছেন এবং জরিপ চালিয়ে দেখেছেন এসব বসতির অধিকাংশই অবৈধ। ঝুঁকির কারণে অনেকে সাময়িকভাবে এসব জায়গা থেকে সরে গেলেও ফিরে এসে আবার সেখানেই বসতি গড়েন। সা¤প্রতিক বছরগুলোয় পাহাড় ধসজনিত এই প্রাণহানির বিষয় বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় যে, পাহাড় ধসের ভৌগোলিক বিপর্যয় শুধু পার্বত্য জেলাগুলোতে নয়, পাহাড় পরিবেষ্টিত বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিকাংশ স্থানেই ঘটছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় ভৌগোলিক দিক দিয়ে কিছুটা ভিন্ন। এখানে সমতল ভূমির পাশাপাশি উঁচু-নিচু, ছোট-বড় অনেক পাহাড় বা টিলা রয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো সাধারণত মাটি এবং বালু মিশ্রিত, এসব পাহাড়ের মাটি এঁটেল মাটির মতো আঠালো নয়। এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো সাধারণত পৃথিবীর অন্যান্য কিছু কিছু অঞ্চলের পাহাড়গুলোর মতো পাথর পরিবেষ্টিত নয়। এই পাহাড়গুলোর মাটি কোনো নির্দিষ্ট শক্ত অবলম্বনের অনুপস্থিতিতে ভারী বর্ষণের ফলে সহজে ধসে পড়ে। এখানে সহায়ক অবলম্বন বলতে ব্যাপক বনায়নই গ্রহণযোগ্য সমাধান। কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া পার্বত্য চট্টগ্রামেও পড়েছে। এখানে আরো একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে পার্বত্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। অনেক আগে দুর্গম পাহাড় এবং প্রত্যন্ত এলাকায় যখন কোনো রাস্তাঘাট ছিল না, পাহাড়িরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য পেত না । সা¤প্রতিক কয়েক দশকের ক্রম উন্নয়নের অন্যতম হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রাস্তাঘাট তৈরি। বর্তমান সময়ে প্রত্যন্ত এলাকায় উপজাতিদের উৎপাদিত পণ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের ফলে শহর এলাকায় পরিবহন সহজেই সম্ভব হয়। উপজাতিরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পান এবং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনেও ক্রমান্বয়ে আধুনিকতার সাথে মানিয়ে নিতে আগ্রহবোধ করেন। অর্থাৎ পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা ছিল সময়ের দাবি। জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে পানি সঞ্চালনের জন্য উপযুক্ত কার্যকরী ড্রেন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়টি ভালোভাবে নিশ্চিত করেছেন। এছাড়াও সময়ে সময়ে রাস্তাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা তারা ভালোভাবেই করছেন। তাই পাহাড় ধসের মূল কারণ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় আধুনিকতার অন্যতম নিয়ামক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক বাসস্থান তৈরি, পর্যটনের উন্নয়ন ইত্যাদি একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা সমীচীন নয়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২০০৭ সালের ভূমি ধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটি পাহাড় ধসের কারণ হিসেবে যেসব সমস্যা চিহ্নিত করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারী বর্ষণ, পাহাড়ের মাটিতে বালুর ভাগ বেশি থাকা, উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, পাহাড় থেকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালু এবং মাটি অপসারণের দুর্বলতা ইত্যাদি। এর সাথে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাহাড়িরা পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করেও ধসের কারণ সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ