Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আল আকসায় নিরাপত্তা ক্যামেরা এবং ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ

| প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : প্রথম মহাযুদ্ধে উসমানীয় খিলাফতের পতন প্রায় নিশ্চিত হওয়ার পর ১৯১৭ সালে বালফোর ডিক্লারেশনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের ভূমিতে একটি ইহুতি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। উল্লেখ্য, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি যখন একটি শান্তিপূর্ণ, সমঝোতামূলক যুদ্ধবিরতির দিকে এগুচ্ছিল ঠিক তখনি জায়নবাদি ইহুদিরা যুদ্ধটিকে বৃটিশ ও মিত্রশক্তির বিজয়ী হওয়ার বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার গোপন এজেন্ডা সামনে নিয়ে আসে। ফলে যুদ্ধে এগিয়ে থাকার পরও সমঝোতামূলক অবস্থান থেকে জার্মানীকে চরম পরাজয় বরণ করতে হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজয় এবং ভার্সাই চুক্তির মত অপমানজনক ও দমিয়ে রাখার মত শর্তের কারণেই ত্রিশের দশকে জার্মানীতে চরম জাতীয়তাবাদি শক্তির উদ্ভব ঘটে। জনগনের সেই পাল্স অনুধাবন করেই হিটলারের মত যুদ্ধবাজ জাতীয়তাবাদি নেতা আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা লাভ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পারমানবিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং কোটি মানুষের প্রানের বিনিময়ে যুদ্ধের ফলাফল নিশ্চিত করার মধ্যেও জায়নবাদি ইহুদিদের ভূমিকাই ছিল মূখ্য। যুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালেই হিটলারের মন্ত্রী পরিষদ ইউরোপীয় ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির পরিকল্পনা হিসেবে প্রায় ৫ লাখ ইহুদি পরিবারকে মাদাগাগাস্কারে স্থানান্তরে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। অবশ্য হিটলারের অনেক আগে ঊনবিংশ শতকের অরিয়েন্টালিস্ট দার্শনিক পল লার্গাদে ১৮৭৮ সালে ইউরোপের ইহুদিদেরকে মাদাগাস্কারে পূনর্বাসিত করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। পল লাগার্দের এই প্রস্তাবকে বৃটিশ রাজনীতিক হেনরি হেমিলটন, আর্নল্ড লিসিসহ আরো অনেক ইউরোপীয় রাজনীতিক সমর্থন করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩৭ সালে ফরাসী সরকারের সহযোগিতায় পোলিশ সরকার পোল্যান্ডে অবস্থানরত ইহুদিদের মাদাগাস্কারে স্থানান্তর করতে মাইসেজল লেপেস্কির নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মাদাগাস্কার দ্বীপ বৃটিশ নৌবাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে মাদাগাস্কারে ইহুদি বসতি স্থাপন পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এরপর ১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ফিলিস্তিনি আরবদের বাড়িঘর বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সবারই জানা। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে হাঘানা নামে পরিচিত ইহুদি সন্ত্রাসী মিলিশিয়াদের নৃসংশতার ইতিহাস উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনীরা বংশ পরম্পরায় দগদগে ক্ষতচিহ্নের মত বয়ে চলেছে।
অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র অস্ত্রের বলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে আরব মুসলমানরা কখনো এই রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পারেনি। এমনকি শান্তিপ্রিয় ধর্মপ্রান ইহুদিরাও জবরদস্তিমূলক ইহুদি রাষ্ট্রের অবস্থান মেনে নিতে রাজি নয়। এ কারণেই ২০০৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ৬০তম বার্ষিকী পালনে অস্বীকৃতি জানিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের শতাধিক ইহুদি-খৃষ্টান বুদ্ধিজীবী ও লেখক-দার্শনিক একটি খোলা চিঠিতে সই করেছিলেন। এদের মধ্যে সাহিত্যিক হ্যারল্ড পিন্টারসহ অন্তত কয়েকজন নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্বও ছিলেন। সেই খোলা চিঠিতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়কার বর্বরতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিল। চিঠির শেষ লাইনে বলা হয়েছিল- ‘উই উইল সেলিব্রেট হোয়েন আরব অ্যান্ড জু লিভ অ্যাজ ইকুয়ালস ইন অ্যা পিসফুল মিডলইস্ট,’ অর্থাৎ, আমরা তখনি ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করব যখন দেখব একটি শান্তিপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যে আরব এবং ইহুদিরা সমমর্যাদার সাথে বসবাস করছে। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর প্রায় ৭০ বছরেও ইসরাইলীরা তার প্রতিবেশিদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কোন চেষ্টাই করেনি। বিশ্বসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠন বা আরব-ইসরাইল রিকনসিলিয়েশনের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। একের পর এক যুদ্ধ, অস্থিতিশীলতা ও আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে টিকে থাকার এক অন্তহীন রোডম্যাপ সামনে রেখেই ইসরাইল সত্তুর বছর পেরিয়ে এসেছে। তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ যুদ্ধের নির্মমতা ছড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি মুসলমানকে হত্যা অথবা উদ্বাস্তু করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের উপর আধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে গ্রেটার ইসরাইল গঠনের স্বপ্ন দেখছে। আরব মুসলমানরা তো নয়ই, পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি শক্তির অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে বিশ্বের সাধারণ মানুষ তাদের আগ্রাসী ভূমিকা মেনে নেয়নি বলেই গ্রেটার ইসরাইল গঠনের স্বপ্ন তারা সফল করতে পারছেনা। এই স্বপ্ন পুরনের লক্ষ্যে তারা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি শক্তিগুলোকে উস্কে দিয়ে এবং ইসলামোফোবিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের নামে রিজিম চেঞ্জসহ প্রয়োজনে আরেকটি পারমানবিক বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করছে।
যে আরব মুসলমানরা ইউরোপ জয় করে সেখানে শত শত বছর ধরে শান্তিপূর্ণ শাসন ও সহাবস্থানের সংস্কৃতি চালু করেছিল। সেখানে ইহুদিরা হাজার বছরের মধ্যে সবচে নিরাপদ স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিল স্পেনের আইবেরিয়ায়। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের চালচিত্রই আমূল পাল্টে যায়। গত সত্তুর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য একটি উত্তপ্ত কড়াইয়ে পরিনত হয়েছে। মাত্র কয়েক মিলিয়ন মাইগ্রেটেড ইহুদির নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদিরা শতকোটি মুসলমানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার ও নিরাপত্তার দাবীকে মারনাস্ত্র দিয়ে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যখনই আরবরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরাইলের আগ্রাসন রুখে দেয়ার চেষ্টা করেছে, তখনি একদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে মুসলমানদের সম্ভাব্য বিজয় রুখে দিতে অথবা শতকোটি ডলারের সামরিক প্রযুক্তি, সরঞ্জামসহ সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি শক্তিগুলো সরসরি নির্লজ্জ দানবীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরদ্ধে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবী দাবিয়ে রাখতে পশ্চিমারা (বিশেষত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) অসংখ্যবার তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিশ্বসম্প্রদায় ও আরবদের প্রত্যাশা বার বার ভন্ডুল করে দিয়েছে। এরপরও বিশ্বের দেড়শতাধিক রাষ্ট্র একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে তাদের সমর্থন দিয়েছে। জাতিসংঘের সামনে স্বাধীণ ফিলিস্তিনের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। ইতিমধ্যে ইউনেস্কো ও আন্তর্জাতিক আদালত বায়তুল মোকাদ্দাস তথা পূর্ব জেরুজালেমের উপর ইহুদি ইসরাইলের অধিকারের দাবীকে নাকচ করেছে। স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবী যখনই অব্যর্থ ও অনিবার্য হয়ে উঠেছে তখনি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কৃত্রিম সংকটের জন্ম দেয়া হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ অধ্যায়ে ছিল ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব, আরব বষন্তের নামে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের মসনদে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে তাদের সাথে নতুন গাঁটছড়া বাঁধা। এই গাঁটছড়ার বাইরে থাকা লিবিয়া, মিশর ও সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ’র পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা, যাতে করে ইসরাইলের পাশে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবী আরো শত বছরের জন্য ঝুলিয়ে রাখা যায়। উল্লেখ্য, উসমানীয় খিলাফত ভেঙ্গে দিয়ে আরব বিশ্বকে খন্ড-বিখন্ড ও দুর্বল করতে প্রথম আরব রেভ্যূলেশনের জন্ম দিয়েছিল বৃটিশ সামরিক গোয়েন্দারা ১৯১৭ সালে। শতবছর পেরিয়ে এসে সেই খন্ডিত আরব রাষ্ট্রগুলোকে আরো দুর্বল ও বশংবদ করতে আবারো আরব বিদ্রোহ, দায়েশ, আইএস’র মত সন্ত্রাসী গ্রæপ সৃষ্টি করা হয়েছে। কোন আরব দেশ এসব সন্ত্রাসী গ্রæপের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাহায্য ও সমর্থনেই যে এসব গ্রæপের উদ্ভব ও বিস্তৃতি ঘটেছে তা এখন অনেকটাই প্রমানীত। ইরান, রাশিয়া ও তুরস্কের সহায়তায় ইরাকি সেনাবাহিনী আইএস’র প্রধান ও সর্বশেষ ঘাঁটি মসুল দখলের পর মার্কিন সেনাবাহিনীও বিজয়ের কৃতিত্ব দাবী করেছে। এ প্রেক্ষাপটে ইরাকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট নূরি আল মালিকি বলেছেন, সিআইএ আইএস সৃষ্টি করেছে এখন আইএস পতনের কৃতিত্বও দাবী করছে। মার্কিন সমরাস্ত্রে সজ্জিত আইএস’র হাত থেকে মসুল পুনরুদ্ধারে ৯ মাসের যুদ্ধে ইরাকি সেনাবাহিনীর ২০ হাজার সদস্য হতাহত হয়েছে বলে নূরি আল মালিকি দাবী করেছেন।
গত ৬ বছরে অন্তত ৫লাখ মানুষকে হত্যা এবং ৫০ লাখের বেশী মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিনত করার পর রাশিয়া, ইরানের হস্তক্ষেপে সিরীয় যুদ্ধে নতুন মোড় নেয়ার প্রেক্ষাপটে অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ বন্ধের ঘোষনা দিয়ে প্রকারান্তরে পরাজয় মেনে নিয়েছেন। এরই মধ্যে আড়াই হাজার বছরের সভ্যতার ধারক দামাস্কাস, আলেপ্পো, রাক্কার মত শহর ও জনপদের উপর হাজার হাজার টন বোমা ফেলে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করা হয়েছে। পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী এবং আইএস যোদ্ধাদের অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ফ্রান্স ৬ বছর ধরে বাশার আল আসাদকে উৎখাতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। রাশিয়া ও ইরানের যোৗথ হস্তক্ষেপে বিদ্রোহীরা তাদের অধিকৃত স্থানগুলো ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হওয়ায় এখন পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকরা বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ দেয়া বন্ধ করে দেয়ায় কার্যত সিরিয় সেনাবাহিনীর জন্য বড় ধরনের বিজয় সুনিশ্চিত করেছে। যদিও মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকার ক্ষেত্রে ট্রাম্প ইতিমধ্যেই তিনি পশ্চিমাদের আইকনে পরিনত হয়েছেন, বারাক ওবামার নির্দেশে সিআইএ সিরীয় বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ দিয়ে সিরিয়ায় যে রিজিম চেঞ্জের স্বপ্ন দেখেছিল ইসরাইলিরা সেখানে রাশিয়ান হস্তক্ষেপ সব পন্ড হয়ে যাওয়ার কারণেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোন রাখ ঢাক না রেখে এক্ষুনি সিরিয় যুদ্ধে মার্কিনীদের সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষনা দিয়েছেন। বাধ্য হয়েই তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ইউরোপের বিখ্যাত সাংবাদিক ফিনিয়ান কানিংহামের মতে, হোয়াইট হাউজ সিরিয়ায় তাদের পরাজয় মেনে নিয়েছে। আমেরিকার বশ্যতা স্বীকারে রাজি না হওয়া এবং ইরানের সাথে কৌশলগত ঐক্যই ছিল বাশার আল আসাদের অপরাধ। সিরিয়ায় ব্যর্থতার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে ট্রাম্প কাতারের বিরুদ্ধে সউদি আরবসহ মার্কিন বশংবদ ৪টি আরব দেশকে অবরোধ আরোপের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এখানেও বেগতিক অবস্থা দেখে ট্রাম্প প্রশাসন এখন সমঝোতার কথা বলতে শুরু করেছে। আরব দেশগুলোর অভিযোগ কাতার সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তবে এ সম্পর্কিত কোন প্রমান তাদের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। কাতারের সাথে আলোচনার শর্ত হিসেবে যে সব দাবী পেশ করা হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখা এবং আল জাজিরার মত টেলিভিশন চ্যানেল থাকাই কাতারের বিরুদ্ধে সউদি আরবসহ আরব দেশগুলোর বৈরীতার মূল কারণ। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদি যুদ্ধের প্রকৃত তথ্যসহ যৌক্তিক বিশ্লেষন তুলে এনে আল জাজিরা ইসরাইলসহ পশ্চিমা কুশীলবদের রাজনৈতিক এজেন্ডা সম্পর্কে আরবদের সচেতন করে তুলছে। প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পারলেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের বশংবদ শক্তিগুলোর চোখে আল জাজিরার মত গণমাধ্যম গড়ে তোলা এবং টিকিয়ে রাখা কাতারের অনেক বড় অপরাধ। কাতার সংকটের দেড়মাস পর গত বুধবার কাতারের আমীর শেখ তামিমের দেয়া বক্তৃতায় কাতারের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে সংকট সমাধানে আরব দেশগুলোর প্রতি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। সংকট নিরসনে ইতিমধ্যে প্রথমে কুয়েতের আমীর এবং সর্বশেষ তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোগানের সাটল ডিপ্লোম্যাসিও দেখা গেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে কাতারের উপর চাপ সৃষ্টি করে আল জাজিরা টিভি চ্যানেল বন্ধ করার অপপ্রয়াসও ব্যর্থ হতে চলেছে।
সউদি আরবসহ প্রধান আরব দেশগুলো যখন কাতারের সাথে ক’টনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পাশাপাশি স্থল, নৌ ও আকাশপথে অবরোধ আরোপ করে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে তখন ইসরাইল প্রথমবারের মত আল আকসা মসজিদে মুসলমানদের প্রবেশ ও নামাজের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনের আরবরা যখন আল আকসা মসজিদের সামনে নামাজ পড়তে গিয়ে ইসরাইলী বাহিনীর গুলি ও টিয়ারগ্যাসের সম্মুখীন হচ্ছে, তখন মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও খাদেমুল হারামাইনের দাবীদার সউদি শাসকদের পক্ষ থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। আরবদের তেল বিক্রির হাজার হাজার কোটি ডলারে কেনা পশ্চিমা অস্ত্রগুলো শুধুমাত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হচ্ছে। মুসলমানদের অন্যতম পবিত্র স্থান তৃতীয় কেবলা মুসজিদুল আকসায় মুসলমানের রক্ত ঝরানোর অপরাধ, মসজিদুল আকসায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঔদ্ধত্ব, মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে মসজিদের মুসল্লিদের উপর নজরদারি ও টার্গেটেড কিলিং এর শিকারে পরিনত করার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা যখন জীবনপণ লড়াইয়ে নেমে পড়েছে তখনো মসজিদুল হারামাইনের খাদেমদের নিরবতা বিষ্ময়কর। পূর্ব জেরুজালেমে কথিত সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে কয়েকজন ইসরাইলী পুলিশ হতাহত হওয়ার অজুহাতে ১৪ জুলাই শুক্রবার আল আকসা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতে দেয়নি ইসরাইল। ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ বিক্ষোভের পাশাপাশি বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপের মুখে সীমিত আকারে মসজিদ খুলে দেয়া হলেও ৫০ বছরের কম বয়েসীদের জন্য মসজিদে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং নিরাপত্তার নামে নতুন মেটাল ডিটেক্টর ও সিসি ক্যামেরা বসানোর প্রতিবাদ বিক্ষোভে হাজার হাজার ফিলিস্তিনী অংশগ্রহন করে। ২১ জুলাই শুক্রবারের জুম্মা নামাজের জন্য আগত হাজার হাজার মুসল্লি মেটাল ডিটেক্টর ডিঙ্গিয়ে মসজিদে প্রবেশের ইহুদি ষড়যন্ত্র প্রত্যাখ্যান করে রাস্তায় নামাজ আদায় করেন। সেখানে ইসরাইলী পুলিশের গুলিতে তিন ফিলিস্তিনী যুবক নিহত এবং আল আকসা মসজিদের ইমামসহ শত শত মানুষ আহত হন। আহতদের হত্যা করতে একটি হাসপাতালেও রেইড দেয় ইসরাইলী পুৃলিশ। বিশ্ব সম্প্রদায়ের মতামত ও বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে ইসরাইল ১৯৬৭ সালে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের পাশাপাশি এথনিক ক্লিনজিংয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মুসলমান শুন্য করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে। ইতিপূর্বে ১৯৯০ সালে আল আকসা মসজিদের স্থানে একটি ইহুদি টেম্পল নির্মানের চেষ্টা আরবদের প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে যায়। সে প্রতিবাদ বিক্ষোভে অন্তত ২০ জন আরব ফিলিস্তিনী শহীদ হন এবং শত শত মানুষ আহত হন। ফিলিস্তিনী আইনজীবী লেখক ডায়ানা বাট’র মতে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধের সব পথ রুদ্ধ করে দেয়ার লক্ষেই ইসরাইলিরা এখন পূর্ব জেরুজালেমে নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নজরদারির পরিকল্পনা গ্রহন করছে। ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের এই ষড়যন্ত্র রুখে দিতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত রয়েছে। ইসরাইলী পুলিশের গুলি ও টিয়ারগ্যাসের সামনেও অবিচল, আল আকসা মসজিদের সামনে রাস্তায় দাড়িয়ে নামাজরত ফিলিস্তিনিরা আরেকটি ইনতিফাদার জানান দিচ্ছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনীদের কাছে এখন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিশ্চিত করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নাই।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ