Inqilab Logo

রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

প্রবীণদের ভবিষ্যৎ কতটা নিশ্চিত

| প্রকাশের সময় : ২৫ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : প্রবীনদের সংখ্যাবৃদ্ধি কি সমাজস্তরে নিয়ে আসছে বিশেষ পরিবর্তন? এক সমীক্ষাসূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে গড় আয়ু ৬২ থেকে বেড়ে ৭১ হয়েছে। কমেছে শিশুদের মৃত্যুর হার। একদিকে এটা ভালো কথা, উন্নতির কথা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নতির অবদান হিসাবে এটাকে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে শুধুমাত্র উন্নতমানের ওষুধই নয়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করাও সম্ভব হচ্ছে। কসমেটিক সার্জারিরও ছড়াছড়ি। নানা অপারেশন করে শরীরের জটিল ক্ষত সারিয়ে ফেলা হচ্ছে। দু’একটি অসুখ ছাড়া প্রায় সবই আরোগ্যযোগ্য।
সুতরাং যাঁদের টাকাপয়সা আছে ও উন্নত চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা আছে তাঁদের আয়ুও বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের মতো গরিব দেশে গড় আয়ু যখন ৭১ তখন ধনী বা উন্নত দেশে তা তো অচিরেই ৮০ ছাড়াবে। গরিব দেশে জনসাধারণ যেখানে ব্যক্তিগত খরচে চিকিৎসা করতে পারে না সেখানে ভালো সরকারি ব্যবস্থায় চিকিৎসা হলে সমাজে কিছুটা সমতা আসে। সুযোগ বিস্তারিত হচ্ছে বা হবে তাই গড় আয়ু বাড়বে। ফলে প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। আমাদের দেশে এখনও প্রবীণের সংখ্যার চেয়ে যুবকের সংখ্যা বেশি কিন্তু কোনো কোনো উন্নত দেশে যুবক/প্রবীণ প্রায় সমান সমান। কোথাও প্রবীণ বেশি হবে কারণ সেসব দেশে নবজাতকের সংখ্যা প্রায় শূন্যে ঠেকে যাচ্ছে বা যাবে। সুদূর আমেরিকাতে এখন যাঁরা প্রৌঢ়, তাঁরা চিন্তা করছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁদের বহন করার উপযোগী টাকার অঙ্ক সামাজিক সুরক্ষা ফান্ডে দিতে পারবে কিনা। কারণ সেখানে শিশু জন্মহার কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো পরিবারে সন্তানও থাকছে না। মা-বাবা অর্থ উপার্জনে মশগুল, সন্তানধারণ বা পোষণ করার সময় কোথায়? অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ করায় সন্তান হচ্ছে না। তাই অনেকেই এখন দত্তক নিচ্ছেন। প্রয়োজনে সাদা-কালো দ্ব›দ্ব ভুলেও।
আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে সন্তান কম। বড়জোর দুই। এক সন্তানও বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ। কারণ, এদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, সরকারি কর্মকর্তা ইত্যাদি হচ্ছে সত্যি কিন্তু কতখানি মানুষ হচ্ছে কে জানে। যখন দেখা যায় এরাই বৃদ্ধ পিতামাতার যথাযথ যত্ম নিচ্ছে না, তখন কষ্ট হয়। পত্র-পত্রিকায় তো মাঝে-মাঝেই বৃদ্ধ পিতামাতার দুরবস্থার কথা ওঠে। বাড়ি নিজের নামে লিখিয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে বাড়ি থেকে রাস্তায় বের করে দেয়। আবার খুব গরিব ঘরে বা অশিক্ষিতরা কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে যতটুকু পারে মর্যাদা দেয় এমন খবরও আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাই। এদিকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর খবরতো হর হামেশাই আমরা পেয়ে থাকি। হয়তো ধর্মভীতি কাজ করে। তবে আস্তে আস্তে এই মানবধর্মটুকুও বিদায় নিচ্ছে। যাই হোক, পারিবারিক ক্ষেত্রেই যেখানে সন্তান মা-বাবাকে বহন করতে চাইছে না বা পারছে না সেখানে সমাজ বা রাষ্ট্র কী করছে ভাববার বিষয়।
সরকারও ছেলেমেয়েরা যাতে মা-বাবাকে দেখে তার জন্য কিছু আইন চালু করেছে। প্রচলন হয়েছে বৃদ্ধ ভাতার। সরকার চালিত ভালো বৃদ্ধাশ্রম চালু হলে ভালো হয়। যাঁরা সরকারী কোনো কাজ করতেন তাঁদের জন্য পেনশন স্কিম চালু আছে। তা ছাড়া, ইনশিওরেন্স কোম্পানি, ব্যাংক ও পোস্ট অফিসে নানা মাসিক আয় প্রকল্প চালু আছে। বিভিন্ন দেশ তিন ভাগে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। প্রথমত, কোনো কোনো দেশ অবসরের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণত জাতীয় গড় আয়ুর সাথে অবসরের বয়স এক করে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ কন্ট্রিবিউটরি পেনশন স্কিমকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ইক্যুইটি বা ন্যায়ের ভিত্তিতে কোথাও পেনশনের আয় বন্টন করা হচ্ছে। তৃতীয়ত, কোনো কোনো দেশ তাদের নাগরিকদের বৃদ্ধ বয়সের জন্য বেশি সঞ্চয় করতে বাধ্য করছে।
এদিকে, ইউরোপিয়ান দেশগুলো যে পেনশন দেয় তা পেনশন প্রাপকের জমার পাঁচ ভাগের তিন ভাগ মাত্র হয়। তাই তাঁদের বাধ্য হয়ে পেনশনের পরও কাজ করতে হয়। ওইসব দেশে পেনশনের বয়স হল ছেলেদের বেলায় ৬২ বছর ও মেয়েদের ৬০ বছর। আবার কখনও চাকুরির সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ বা ৪০ বছর ধরে পেনশন দেয়। কোনো সরকার এই সর্বনিম্ন বয়স থেকে বেশি কাজ করলে প্রতি বছর অতিরিক্ত বোনাস দেয়। তবে তার ট্যাক্স দিতে হবে। জাপানে এই ট্যাক্স কম তাই সে দেশে ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধ কাজ করেন। আর বেলজিয়ামে এই ট্যাক্স বেশি তাই মাত্র ২০ শতাংশ বৃদ্ধ পেনশনের বেশি বয়স পর্যন্ত কাজ করেন। গ্রিসে আবার অবসরের পর কাজ করলে সারা জীবনের আয় ৮৫ শতাংশ কমে যাবে। তাই সেখানে অবসরের পর কেউ কাজ করেন না। আবার লুক্সেমবার্গের কর্মীরা সেখানে ক্ষতির ভয়ে ফ্রান্স বা বেলজিয়ামে গিয়ে কাজ করেন আর নিজেদের লুক্সেমবার্গের বাড়ি কোম্পানিকে ভাড়া দিয়ে আয় করেন। সেখানে সরকার সাধারণত প্রগতিশীল ট্যাক্স নীতি আরোপ করে। অর্থাৎ বেশি আয় বেশি ট্যাক্স এই নীতি পেনশন ও পেনশন সেভিংস এর ক্ষেত্রে আরোপ করে। ধনীরা তাই কম জমান আর গরিবরা বেশি জমান। ফলে গরিবরা বেশি পেনশন ও ধনীরা কম পেনশন পান। তবে স্পেন, ফ্রান্স ও ইতালিতে ধনী ও গরিব প্রায় সমান অঙ্কের টাকা জমান।
আরেকটি কথা হল, সরকারের ইচ্ছা বৃদ্ধরা বেশিদিন কাজ করুন তবে পেনশন ভার কমবে। কিন্তু বৃদ্ধরা বেশিদিন ধরে কাজ করলে তাঁদের বেতন বাড়বে ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের খরচ বাড়বে। তাই নিয়োগকারীরা বৃদ্ধদের ছাঁটাই করে যুবকদের চাকুরি দেন। তা ছাড়া বৃদ্ধদের দক্ষতা কমে যায় বা পুরনো হয়ে যায়। তাঁরা নতুন করে সবসময় সব কিছু নিতেও পারেন না। তাই বিভিন্ন আইন করেও শিল্প প্রতিষ্ঠানে বৃদ্ধদের বেশিদিন কাজে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আর আমাদের দেশে যুবকদের মধ্যে বেকার সমস্যা এত বেশি যে তারা বৃদ্ধদের বেশিদিন চাকুরি করা পছন্দ করেন না বা করবেন না। আবার বৃদ্ধরা যে বসে বসে পেনশন পান এটাও ঠিক সহ্য করতে পারেন না।
যাক দেখা যাচ্ছে, বিদেশে আইন করেও বৃদ্ধদের কাজের পরিধি বাড়ানো যাচ্ছে না। নিয়োগকারীরা যুবকই পছন্দ করছেন। তবে দেশের নিয়োগ ক্ষমতা ভালো থাকলে যুবা-বৃদ্ধ সবাই কাজ পান। তবে সব দেশেই পেনশন ফান্ড বিভিন্ন জায়গায় খাটানো হয়। (এক) কিছু টাকা অবশ্যই স্থির রাখতে হবে জীবন চলার জন্য, আর (দুই) টাকা খাটিয়ে ঝুঁকি নিয়ে লাভের চেষ্টা করা। তবে সরকার টাকা খাটানোর বিভিন্ন নিয়ম করে। তবে দেখা গেছে, বিভিন্নভাবে টাকা খাটালেও লাভ খুব একটা হয় না। ওইসিডি যে ৩১ টি দেশে সমীক্ষা করেছে তার মধ্যে ১৮টি দেশের পেনশন ফান্ড খাটিয়ে ক্ষতিই হয়েছে। কারণ নিরাপত্তা বজায় রাখতে তারা সরকারি বন্ড ইত্যাদিতেই বেশি টাকা খাটিয়েছে। কোনো ঝুঁকি নেয়নি। আবার কিছু দেশ যেমন ইউএসএ, কানাডা, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও পোল্যান্ড শেয়ারেও টাকা খাটিয়েছে। কেউ কেউ আবার সম্পত্তি, ঋণ, প্রাইভেট ইক্যুইটিতে টাকা খাটিয়েছে। তবে বেশির ভাগ ফান্ডের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ হয়েছে। তবে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো পশ্চিম ইউরোপীয় দেশেও এই ফান্ডের টাকা বিনিয়োগ করেছে।
যাই হোক, সবদিকে ভেবে দেখা যাচ্ছে ধনী দেশগুলো বর্তমানে পেনশনের সুবিধা কমাবার চেষ্টা করছে। কারণ পেনশন ফান্ডে কুলাচ্ছে না। ওইসিডি বলছে, যেহেতু মানুষ বেশিদিন বেঁচে থাকছেন তাই অবসরের বয়সের সীমা বাড়িয়ে দিতে হবে। যখন মানুষ আর কাজ করতে পারবেন না তখন তাদের শিশুদের মতো যত্ম করতে হবে। ব্রিটেনের প্রখ্যাত প্রফসর শেলীর মতে, সেসব দেশে শারীরিক কষ্টে করণীয় কোনো কাজ নেই তাই বৃদ্ধরা কাজ অনায়াসেই করতে পারবেন। সুতরাং অবসরের দরকার নেই।
অনেকগুলো দেশের পেনশনের অবস্থা পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে যে, আগে বৃদ্ধের সংখ্যা কম ছিল আর মৃত্যুও তাড়াতাড়ি ঘটত তাই নির্দিষ্ট পেনশন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। বর্তমানে বৃদ্ধদের জীবনরেখা অনেক বেড়ে গেছে, সংখ্যাও বেড়েছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও মাঝে মাঝে টালমাটাল হয়ে পড়েছে। তাই ভবিষ্যতে বৃদ্ধরা কতটা নিশ্চিত হয়ে থাকতে পারবেন, তা সময়ই বলবে।
বৃদ্ধদের যথাসম্ভব সুস্থ থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির দায়িত্বভার থেকে একেবারে দূরে সরে দাঁড়ালে চলবে না। যতদিন সম্ভব কারোর উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। কিন্তু মুশকিল হল, বৃদ্ধরা কোনো অর্থকরী কাজের জন্য যদি যুবকদের সাথে প্রতিযোগিতা করেন তাহলে যুবকরা মেনে নেবে না কারণ চাহিদার তুলনায় কাজের অভাব। কাজের অভাব না-থাকলে বৃদ্ধরাও কাজ করতে পারবেন। আরেকটা কথা, যুবকরা আজকাল বৃদ্ধদের খবরদারি পছন্দ করে না। তাই স্বস্তিতে থাকতে হলে খবরদারিও কিছুটা কমাতে হবে। অর্থকরী কাজ ছাড়াও অন্যান্য সমাজসেবামূলক কাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক কাজ বৃদ্ধরা অবশ্য করতে পারেন। যাঁরা অতিবৃদ্ধ, অশক্ত তাঁদের প্রতিপালন করা পারিবারিরক ক্ষেত্রে একান্ত সম্ভব না-হলে সমাজ ও সরকারকে তাঁদের ভার অবশ্যই নিতে হবে। সরকারিভাবে সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত, সুচিকিৎসক ও ভালো নার্সের ব্যবস্থাসহ সরকারি বৃদ্ধালয় অবশ্যই দরকার।
মানুষ মরণশীল। এ জেনেও মানুষ প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। মহাপুরুষ ছাড়া মৃত্যুকালে সকলেরই কষ্ট হয়। তাই তো কবি লিখেছেন ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে।’ আবার অনেক চিন্তায়, অনেক ভাবনায়, অনেক তপস্যায় মানুষ যখন বুঝে মৃত্যুই চিরশান্তি, মৃত্যুই ধ্রুব, মৃত্যুই চিরসুখ তখনই কবির কন্ঠে আবার বেজে ওঠে ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান।’ তবে ইচ্ছামৃত্যুর বিধান কেউই দিচ্ছেন না। বর্তমানে দু-একটি দেশ ছাড়া কোনো দেশই ইচ্ছামৃত্যুর ছাড়পত্র দেয় না। দু-একটি দেশও গভীর যন্ত্রণা লাঘবে শর্তসাপেক্ষে ইচ্ছামৃত্যু চাইছে। তাই অতিবৃদ্ধরা চাইলেই পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারবেন না। তাই তাঁদের শান্ত হতে হবে, বৃহৎ কিছুতে মনোযোগ দিতে হবে। সময় এলে চলে যাবেন কেউ দাগ রেখে, কেউ নীরবে। তারপরও তো যন্ত্রণা। শরীর মেডিকেল কলেজে দেব? নাকি কবর দেওয়া হবে? নাকি উন্মুক্ত প্রান্তরে শকুনের খাবার হিসাবে রেখে দেওয়া হবে? নাকি সলিল সমাধি? মিশরের মমি করার ব্যবস্থা এখন প্রায় অবলুপ্ত। নয়তো তাও করা হত। মানুষ তো বুদ্ধিমান জীব। তাই তো বুদ্ধির মারপ্যাঁচ।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ