ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
হোসেন মাহমুদ : সন্ধ্যা নামলেই তারা আসে। বাসা, দোকান, পার্ক, কোনো ফাঁকা জায়গা যেখানেই বসুন না কেন সেখানেই তারা আসবে। গুনগুন ঠিক বলা যায় না, নিজস্ব রীতি ও স্বরের এক অন্য ঘরানার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুচ্চ আওয়াজে তারা জানাবে যে ‘আমরা এসেছি’। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে, পায়ে, মুখে, ঘাড়ে তথা শরীরের যে কোনো ফাঁকা জায়গায় তারা হুল ফোটাবে, শরীর থেকে চুষে নেবে তাজা রক্ত। তাদের কামড়টা ঠিক পেলে মারার বা তাড়ানোর চেষ্টা করে মানুষ। যারা টের পায় না তাদের রক্ত শোষণ করে নিজের পেট মোটা করে নিষ্ঠুর মশা। সারারাত ধরে চলে তাদের অবিশ্রান্ত হামলা। যারা বাসা-বাড়িতে থাকেন, শোয়ার সময় মশারির আশ্রয়ে শুয়ে মশার কামড় থেকে নিজেদের বাঁচান। যারা ফুটপাতে রাত কাটান তারা কেউ কয়েল জ¦ালিয়ে, কেউ কাগজ পুড়িয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি করে, কেউবা চাদর মুড়ি দিয়ে মশার কবল থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রতি রাতেই মশার সাথে লড়াই চলে সাধারণ মানুষের। এ লড়াই অন্তহীন, অনিঃশেষ।
এ ভূখন্ডে মশার উৎপত্তি কবে, কবে থেকে মশা মানুষকে কামড়াতে শুরু করেছে তা বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। বাঙালির ইতিহাস বেশিদিনের নয়। ইতিহাসে মশার কথা নেই। ধর্মীয় কাহিনীতে খোদাদ্রোহী নমরূদের নাকের ভিতর দিয়ে মশা ঢুকে মস্তিষ্কে কামড়ানোর কথা জানা যায়। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদে মশার কথা নেই। যতদূর জানা যায়, উনিশ শতকে ব্যঙ্গ রসের প্রখ্যাত কবি ও পত্রিকা সম্পাদক ঈশ^রচন্দ্র গুপ্তের সেই বিখ্যাত দু’ পঙ্ক্তিতে আধুনিককালে প্রথম মশার কথা বলা হয়: ‘রাতে মশা দিনে মাছি/ এ নিয়ে কলকাতা আছি।’ তারপর অবিস্মরণীয় ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনও লিখেছিলেন ব্যঙ্গ করেইÑ ‘পুরুষের দশ দশা/ কখনো হাতি কখনো মশা।’ তারওপর ‘পল্লীজননী’ কবিতায় আমাদের গ্রাম বাংলায় রাতে মশার ভনভন করার কথা লিখেছিলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীনÑ ‘ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে ফুল ফুটে ঝরে বনে/ ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল গড়াইছে তার সনে।’ আরো কারো কারো লেখায় মশার উল্লেখ আছে।
ঢাকা মহানগরীতে মশার বাড়বাড়ন্ত যে কোন পর্যায়ে সে ব্যাপারে মেয়রগণ ও দুই সিটি কর্পোরেশনের বড় কর্মকর্তাদের কেউ খবর না রাখলেও মশা যাদের নিত্য রাতের সাথী তারা তা ভালোই জানেন। একটি সংবাদ মাধ্যমে ভুক্তভোগী মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা হাকিম মিয়া বলেন, ‘মশা নিধনে সিটি কপোরেশন তেমন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এলাকায় গত দুই মাসেও মশার ওষুধ ছিটানোর নজির দেখতে পাচ্ছি না। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আসে ঘরের মধ্যে।’ বাসাবোর আশিক মাহমুদ বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরেই মশার অত্যাচার বেড়ে গেছে। রাত-দিন সমানতালেই চলছে মশার আক্রমণ। আর মশার কামড়ে আশেপাশের অনেকের চিকুনগুনিয়া হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তেমন কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি।’ গেন্ডারিয়ার মোহসিন হোসেন বলেন, ‘মশার অত্যাচারে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। দল বেঁধে মশা আসে। আর কয়েল? সে তো মশার বন্ধু। জা¡লিয়ে কোনো কাজ হয় না। কবে যে আমারও চিকুনগুনিয়া হয় তাই ভাবছি।’
আমাদের দেশে নগর-শহরের মশা দমনের জন্য স্বাধীনতা পূর্ব আমলে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি চালু ছিল। সম্ভবত ব্রিটিশ আমলেই ম্যালেরিয়া এরাডিকেশন ডিপার্টমেন্ট নামে একটি দফতর খোলা হয়েছিল। সাবেক পাকিস্তান আমলেও এ দফতরটি বহাল ছিল। এ কর্মসূচির আওতায় শহর এলাকায় ওষুধ দিয়ে মশা নিধন, ডোবা-থেকে কচুরিপানা সাফ ইত্যাদি কাজ করা হতো। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত এলাকায় রোগীদের জন্য কুইনাইন প্রদান করা হতো। ম্যালেরিয়ার উৎস মশার দমনে বাংলাদেশ আমলেও চালু ছিল এ কর্মসূচি। একালে দফতরটি চালু আছে কিনা জানা নেই। এখন সিটি করপোরেশনের উপর মশক নিধনের দায়িত্ব ন্যস্ত। সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হয় না বলে বহুদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন কাঁধে ঝোলানো মেশিন দিয়ে নর্দমা ও অন্যান্য জায়গায় মশা মারার ওষুধ ছিটানো হত। তাতে একটু আধটু মশা কমত। পরে ওষুধ ছিটানো হলেও মশা মরত না। দুর্মুখেরা বলতে শুরু করে, মশা মারার ওষুধে ভেজাল দিয়ে আসল ওষুধ অন্যত্র বিক্রি করে সংশ্লিষ্টরা পয়সা কামাচ্ছে। ভেজাল ওষুধের জন্য মশা মরে না। সমালোচনার কারণেই হোক আর পুরনো হয়ে যাওয়ার জন্যই হোক, ওষুধ ছিটানো মেশিনের পাশাপাশি এলো ফগার মেশিন। যেমন বিকট আওয়াজ তেমনি ধোঁয়া। প্রথম দিকে এতে কাজ ভালোই হচ্ছিল। নাগরিকরা একটু খুশিই হলেন- যাক এবার মশা জব্দ হবে। কিন্তু কিছুদিন পরই ফগার মেশিন হাতে সংশ্লিষ্ট লোকদের আগমন কমে গেল। রাজধানীর সর্বত্র আবার মশারা অবাধ রাজত্ব বিস্তার করল, কিন্তু সিটি করপোরেশনের ঘুম ভাঙ্গল না। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলেও কাজ হলো না।
ভয়ংকর ডেঙ্গু জ¦রের কথা সবার জানা যা এক বিরাট আতংক। বেশ কিছু মানুষ এ জ¦রে মারা গেছেন। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ঘরে ফুলদানির পানিতে জন্ম নেয়া এডিস মশার কারণে এ রোগ হয়। রেডিও-টিভি-পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশ কমে আসে। মানুষ এখনো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, তবে মৃত্যুর ঝুঁকি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু ঢাকা মহানগরবাসীর শান্তি নেই। এবার আরেক রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এর নাম চিকুনগুনিয়া। এডিস মশা থেকেই চিকুনগুনিয়া রোগ হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিস বাইরের মশা নয়, ঘরের ভেতর জন্ম নেয়া মশা। চিকুনগুনিয়া নিয়ে পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়, টিভি চ্যানেলগুলোও বাদ যায়নি। নগরবাসীদের মধ্যে নানারকম আলোচনা জন্ম নিতে থাকে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ১১ জুলাই বলেন, চিকুনগুনিয়ার উৎপত্তি হয় এডিস মশা থেকে। মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব হল সিটি করপোরেশনের। তিনি বলেন, রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ার জন্য সিটি করপোরেশন দায়ী। এ দায়িত্ব কোনোভাবেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ কথা মানতে পারেননি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব নিয়ে ১৪ জুলাই গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র নগরবাসী চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। তবে মানুষের এই কষ্ট ও দুর্ভোগের জন্য সিটি করপোরেশন দায়ী নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর ভাষায়, চিকুনগুনিয়া মহামারি হোক আর যাই হোক, এর জন্য কোনোভাবেই সিটি করপোরেশন দায়ী নয়। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মশা মারা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ড্রেনের ভেতর নয়, ঘরের ভেতর জন্ম নেয়া মশায় চিকুনগুনিয়া হচ্ছে। চিকুনগুনিয়ার প্রাইম রিজন ঘরের ভেতরে জন্ম নেয়া মশা। সে পর্যন্ত পৌঁছনো সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব না। মেয়র আরো বলেন, আপনার ঘরের ভেতরে গিয়ে আমি মশারি টানাতে পারবো না। আপনার বাসার চৌবাচ্চায় আমি ওষুধ লাগাতে পারবো না। আপনার ঘরের ভেতর সামান্য স্বচ্ছ পানিতে যে মশা জন্মাচ্ছে, সেটা আমি মারতে পারবো না। মেয়র মহোদয় এ দিন জানান, এডিস মশা মূলত বাসা বাড়ির ফ্রিজ, এসির ট্রে, ফুলের টব, ছাদে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। এ ছাড়া পড়ে থাকা ভাঙ্গা হাঁড়ি, ক্যান, পরিত্যক্ত টায়ার ও বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবনে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা এ মশার বংশ বিস্তারের অন্যতম কারণ।
মেয়রের রূঢ় ভাষা নগরবাসীকে অবাক করে। তাঁর নিজের দোষ স্খালনের চেষ্টা অনেকের কাছেই অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। বিশেষ করে ‘আপনার ঘরের ভেতরে গিয়ে আমি মশারি টানাতে পারবো না’ মন্তব্যটি সাধারণ ভব্যতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে এ টানাহেঁচড়া নগরবাসীকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। সবারই মনে প্রশ্ন, মশা মারার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন কারোরই নয়Ñ তাহলে কার? সমালোচনার ব্যাপকতা দেখে পর দিন ১৫ জুলাই মেয়র আনিসুল হক তার মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, আমি আমাদের সচেতনতামূলক পোস্টারে মশারির ছবি দেখিয়ে ওই কথা বলেছিলাম। কিন্তু যেভাবে বলেছি, তা ঠিকভাবে বলতে পারিনি। বলতে চেয়েছি, যে বাড়ির ভেতরে ঢোকার অধিকার আমাদের সেভাবে নেই। আমার বক্তব্যের জন্য কেউ যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমি তার জন্য দুঃখিত।
পত্র-পত্রিকা-টিভি চ্যানেলগুলোতে কোনো বিশেষ ঘটনা বিষয়ে জনগণের মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়। ইদানীং এর সাথে যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সেখানে অন্য সংবাদ মাধ্যমের আগেই সচেতন মানুষ কোনো বিশেষ ঘটনা বা স্পর্শকাতর বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করে বলে দেখা যায়। মেয়র আনিসুল হকের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে অসংখ্য মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। জনমতের প্রতিফলন হিসেবে সে সব মন্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
ঢাকা মহানগরবাসীর নাগরিক জীবনে স্বস্তি-শান্তি আনা ও বজায় রাখা, মানুষের দুর্ভোগের অবসান করা দুই সিটি করপোরেশনের ঘোষিত দায়িত্ব এবং মেয়রদের নির্বাচনী অঙ্গীকার। তাদের ওয়াদা-প্রতিশ্রæতিতে প্রভাবিত হয়ে নগরবাসী তাদের নির্বাচিত করেছিলেন। সে অঙ্গীকার থেকে সরে যাওয়া, তাকে শুধু মৌখিক বুলিতে পরিণত করা মর্যাদার বিষয়ও নয়, ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচকও নয়। নগরবাসী মেয়রদের কাছ থেকে নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের প্রত্যাশা করে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।