পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ঢাকার বাংলাবাজারের সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশকদের কেউ ১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশ করার আগ্রহ দেখাননি। পান্ডুলিপি পড়ে সময়ের অপচয় করতে রাজী হননি ব্যস্ত বই ব্যবসায়ীরা। তরুণ লেখকের আগ্রহ দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাংলা ভাষাশান্ত্রের পন্ডিত ড. আহমেদ শরীফ পান্ডুলিপি পড়ে স্বতঃপ্রোণোদিত হয়ে ‘ভূমিকা’ লিখে দেন। আরেক প্রখ্যাত সাহিত্যিক আহমদ ছফা খান ব্রাদার্সের স্বত্ত¡াধিকারীকে অনুরোধ করে বইটি ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। আলোর মুখ দেখে নন্দিত নরকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ণের ছাত্র হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যিক জীবনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ভূমিকায় ড. আহমদ শরীফের নাম দেখে সাহিত্যমোদী কারো কারো মধ্যে ‘নন্দিত নরকে’ পড়ার আগ্রহের সৃষ্টি হয়। নাতিদীর্ঘ উপন্যাস পড়ে অনেকেই ভূয়সী প্রশংসা করেন। হুমায়ূন আহমেদের সামনে সুযোগ সৃষ্টি হয় দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রকাশের। যে হুমায়ূন আহমেদের পাল্ডুলিপি পড়তে প্রকাশকরা বিরক্তবোধ করতেন; বই প্রকাশে আগ্রহ দেখাননি; পরবর্তীতে তারাই লাখ লাখ টাকা পকেটে নিয়ে মাসের পর মাস বছরের পর বছর হুমায়ূন আহমেদের পিছনে ঘুরেছেন একটি লেখার জন্য। বাংলা সাহিত্যের সেই বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদের আজ পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করা হুমায়ূন আহমেদ ২০১২ সালের এই দিনে ইন্তেকাল করেন। দেশের যারা শিল্প সাহিত্যের সমোঝদার, নাটক সিনেমায় অনুসক্ত তারা কেউ হুমায়ূন আহমেদকে ভুলে যাননি। সবাই তাঁর সৃষ্টিকে মনে রেখেছেন। উপন্যাস-সিনেমার চরিত্রকে অনুকরণ-অনুসরণ করেন। বলা যায় জনপ্রিয় মাটির গান ‘তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না’র মতোই। পাঠকরা সত্যি সত্যিই হুমায়ূন আহমেদকে নিজ নিজ হৃদ মাজারেই ধরে রেখেছেন।
দেশের ‘কাক আর কবি’র সংখ্যা নিয়ে শিক্ষিত সমাজে বিতর্ক আছে। সংখ্যায় কোন প্রজাতি বেশি! বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিক বেসুমার। ঘরে ঘরে কবি। শুধু বাংলা একাডেমির বই মেলায় দেশের কবি-সাহিত্যিকদের হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু কতজনের লেখা বই পাঠক পড়েন? আদিকাল থেকেই শিল্প-সংস্কৃতি-নাট্যকলায় ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ শ্রেষ্টত্বের দাবি রাখে। তথ্যপ্রযুত্তির এই যুগে শিক্ষায়ও দেশ অনেক অগ্রহসর। কিন্তু বইয়ের পাঠক সৃষ্টি করতে পেরেছেন কতজন কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী? সত্তর-আশির দশকে রোমেনা আফাজের রহস্য উপন্যাস ‘দস্যু বনহুর’ পাঠক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। হাতে হাতে ছিল চটি বইটি। ট্রেন, স্টিমার, বাস, লঞ্চে ‘দস্যু বনহুর’ ব্যাপকভাবে বিক্রি হতো। বই পড়ে তরুণরা দস্যু বনহুরের মতো আচরণ করতেন। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, পথের দাবি, মেজদিদি ইত্যাদি বইও বিক্রি হতো। পরবর্তীতে বই বিক্রির শীর্ষে তালিকায় যোগ হলো আনোয়ার হোসেনের সেবা প্রকাশনীর গোয়েন্দা সিরিজ ও রহস্য সিরিজ। প্রজাপতি প্রকাশনীর বইও চলতো। কিন্তু তারপর!
বর্তমানে দেশে হাজার হাজার কবি-সাহিত্যিক; অথচ কয়েক বছর আগেও ঢাকায় বই বিক্রির শীর্ষে ছিল কলকাতার লেখক সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু-যাযাবর। ঢাকাসহ বাংলাদেশের সৃজনশীল বইয়ের ‘মার্কেট’ ভারতীয় লেখকদের দখলে! দেশের তরুণ-তরুণীরা যখন কলকাতার লেখকদের বইয়ের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন; তখনই সাহিত্যাঙ্গনে উল্কার বেগে আবির্ভাব ঘটে হুমায়ূন আহমেদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ণের শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ গল্প-উপন্যাসের কাহিনীর পরতে পরতে এমন ‘রসায়ন’ তৈরি করেন যা পাঠক হিসেবে তরুণ-তরুণীরা গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে। সকল বয়সের পাঠক হুমায়ূনের বই পড়তে শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যে বইয়ের বাজার ভারতীয় লেখকদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে হুমায়ূন মুখী হন। সব শ্রেণির পাঠক বই মেলায় এবং বইয়ের দোকানে হুমরি খেয়ে পড়েন হুমায়ূনের বই কিনতে। বই বিমুখ ছাত্রছাত্রীরা হন বইমুখী। যারা হয় টিভি নয়তো ভারতীয় লেখকদের বই পড়তে অভ্যস্ত তারা হুমায়ূনের বই পড়তে শুরু করেন। সৃজনশীল সাহিত্য পাঠে দেশে রাতারাতি ঘটে যায় বিপ্লব। বাংলা সাহিত্যে একশ’ নামজাদা কবি-সাহিত্যিক মিলে যুগের পর যুগ ধরে যে ‘পাঠক’ তৈরি করতে পারেননি; রসায়নের শিক্ষক হয়ে হুমায়ূন আহমেদ একাই তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি পাঠক সৃষ্টি করেন। এখন আর পাঠকের কাছে গল্প-উপন্যাস মানে কলকাতার সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশের বই নয়; উপন্যাস মানেই হুমায়ূনের বই।
বলা যায় হুমায়ূন আহমেদ বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে মনে করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। প্রচুর গানও লিখেছেন সিনেমার প্রয়োজনে। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবহেলিত জারি-সারি-মুর্শিদী-ভাওয়াইয়া গান তিনি সংগ্রহ করে নিজের সিনেমায় যুথসই ব্যবহার করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মূলত আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের হুমায়ূন পথিকৃৎ। টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। তাঁর চিন্তার জগৎ যেমন ছিল সীমাহীন তেমনি হাতে ছিল যাদুর কাঠি। সেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই ফলিয়েছেন সোনা। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। হিন্দুয়ানী সমাজচিত্রের পরিবর্তে তিনি বাংলাদেশের মুসলিম মধ্যবিত্তের সমাজ জীবন তুলে ধরেন। সাহিত্যে তিনি রহস্য, বিজ্ঞান এবং গল্পের ভিতরেই সংলাপ প্রধান নতুন শৈলীর তৈরি করেন। সত্তর দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্ব›িদ্ব কারিগর। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক সাহিত্যিক হুমায়ূন আজাদসহ কিছু আঁতেল বুদ্ধিজীবী হুমায়ূন আহমেদের লেখার সাহিত্যমান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু পাঠক ধরে রাখার সম্মোহনী যে শক্তি হুমায়ুন আহমেদের তা সব আঁতেলের অভিযোগ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর সৃষ্ট হিমু, মিসির আলি, শুভ্র, রুপা চরিত্রগুলো বাংলাদেশের তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের এখনো গভীরভাবে উদ্বেলিত করে। তাঁর সৃষ্টিকর্ম সাহিত্যের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী অন্তভূক্তি পাঠকদের আকাশ ভেদ করে অচীনপুর স্বপ্নের ঘোরে নিয়ে যায়। দেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর দিয়ে সাহিত্য রচনা করে যে পাঠক সৃষ্টি করা যায় তার স্বার্থক প্রমাণ রেখেছেন তিনি। তাঁর রচিত প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ এবং তাঁর নির্মিত সিনেমাগুলো পেয়েছে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তাঁর লেখা এবং পরিচালিত টেলিভিশন নাটকগুলো ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। বাংলা একাডেমির মাসব্যাপী বই মেলায় যে কয়েক লাখ বই বিক্রি হয় তার অর্ধেক বই বিক্রি হয় হুমায়ূন আহমেদের। যার জন্য প্রকাশকরা হুমায়ূনের বই প্রকাশের জন্য উদগ্রীব থাকতেন। আগে প্রকাশকরা স্বনামধন্য লেখক-কবিদের বই প্রকাশ করলেও রয়েলিটি দিতে গরিমসি করতেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ লেখকদের এই দুঃখ-দুর্দশা ঘুচিয়ে দেন। প্রকাশকরা বইয়ের পান্ডুলিপি পাওয়ার দুই থেকে তিন বছর আগে হুমায়ূন আহমেদকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা অগ্রিম সম্মানি দেন। এতে অন্যান্য লেখকরাও বই প্রকাশের আগে সামান্য হলেও সম্মানি পাওয়া শুরু করেন।
শুধু কি লেখক! নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ? বর্তমানে বাংলাদেশে যে সিনেমার ক্রান্তিকাল চলছে। সাংস্কৃতি চর্চার নামে কোলকাতার সাংস্কৃতির দিকে ঝুকে পড়েছে। ভারতীয় সাংস্কৃতি আগ্রাসনে আত্মসমর্পণ করছে দেশের কিছু সংস্কৃতি ব্যাক্তিত্ব। তার মূলে রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখক-পরিচালকদের অনুপস্থিতি। হুমায়ূন আহমেদের শত শত উপন্যাস যেমন পাঠক হৃদয় জয় করেছে; তেমনি তার নির্মিত নাটক ও সিনেমা দর্শকদের করেছে মাতোয়ারা। নব্বই দশকে বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকানো ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় মিছিল নিয়ে বের হয়েছিল। তাঁর রচিত-নির্দেশিত ও পরিচালিত এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার নাটকগুলো বাংলা ভাষায় নির্মিত এবং বিটিভিতে প্রচারিত নাটকগুলোর মধ্যে ছিল শ্রেষ্ট এবং জনপ্রিয়। তার নাটক দেখার জন্য দর্শকরা বুঁধ হয়ে বসে থাকতেন টিভির সামনে। সিনেমা’য় তিনি কম সাফল্য দেখাননি। শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, দারুচিনি দ্বীপ সিনেমাগুলো তাকে নিয়ে যায় অন্যরকম উচ্চতায়। সিনেমা এবং টিভি নাটকে আজ যে দৈন্যদশা তা হুমায়ূন আহমেদের প্রয়োজনীয়তার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।