হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোবায়েদুর রহমান : গত ১৩ জুলাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জেএসডি নেতা আ.স.ম আব্দুর রবের উত্তরার বাসায় যা ঘটে গেল সেটি শুধু আমি কেন অনেকে কল্পনাতেও ভাবতে পারেন নি। আ.স.ম রবের বাসায় সেদিন যারা এসেছিলেন তাদের অনেকের সাথেই আমার এবং আপনাদের অনেকরই রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং বিশ্বাস এক নয়। সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু একজনের বাস ভবনে,তার বৈঠক খানায় কয়েক ব্যক্তি চা চক্রে বা নৈশ ভোজে মিলিতও হতে পারবেন না, সেটি ভাবনার অতীত। যারা সেখানে সেদিন হাজির হয়েছিলেন তাদের প্রায় সকলেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এমনকি সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করলেও সেখানেও রাজনীতি থাকে। থাকবে না কেন? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। প্রতিটি নাগরিকেরই নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করার অধিকার রয়েছে। রাজনীতি কোথায় না হয় ? বিয়ের আসরে সাধারণত এমন সব ব্যক্তির সাথে দেখা হয় যাদের সাথে সাধারণত আপনার অনেকদিন হলো, এমনকি অনেক বছর হলো, দেখা হয় না। সেই সব জায়গায় পুরানা বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা হলেই কথা শুরু হয় এভাবে, কি ভাই কেমন আছেন? ভাবী সাহেবা ভাল আছেন? আপনার বাচ্চা কাচ্চারা ভাল আছে? এসব নিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পর আসে আসল কথা, ভাই দেশের খবর কি? আপনারাতো আবার এখানে ওখানে ঘোরেন, কিছু খবরা খবর রাখেন। আমাদের বলুন তো, আমরা কোথায় যাচ্ছি? এভাবেই বিয়ের আসরেও চলে আসে রাজনীতি। নিজের অথবা ছেলে মেয়েদের জন্মবার্ষিকী অথবা বিবাহবার্ষিকী পালন করতে গেলেও আজকাল কম করে হলেও ৫০-৬০ জন মেহমানকে দাওয়াত করতেই হয়। সেখানেও, এভাবেই রাজনীতি হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করে।
আ.স.ম আব্দুর রবের বাসভবনে সেদিন যারা গেট টুগেদারে মিলিত হয়েছিলেন তাদের নাম গুলো দেখুন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী, তার ছেলে মাহী বি চৌধুরী, আ.স.ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বাসদের খালেকুজ্জামান, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, নাগরিক ঐক্যের নেতা এস এম আকরাম প্রমুখ।
যেসব নাম দেখছেন, তারা সকলেই গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। তাদের দল ছোট, কিন্তু বেশ কয়েক জন নেতা অত্যন্ত সুপরিচিত। সন্ত্রাসবাদের কথা এরা জীবনে কল্পনাও করতে পারেনি। এরা চরম পন্থীও নন। আর রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথা চিন্তার বাইরে। বি চৌধুরী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আ.স.ম আব্দুর রব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। জেনারেল এরশাদের সময় তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রীসভায় একজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী ছিলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে যে চারজন ছাত্রনেতা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত করছিলেন তিনি তাদের অন্যতম। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তিনি অস্ত্রসমর্পণ করেন এবং তারপর আর কোনো দিন অস্ত্র ধারণ করেন নাই। কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নাই। দেশের অভ্যন্তরে থেকে তিনি কাদেরিয়া বাহিনী গড়ে তুলে অসীম বীরত্বের সাথে তার বাহিনী নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেন। মাহমুদুর রহমান মান্না স্বাধীনতার পর স্বদেশে ফিরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ডাকসুর দুই বারের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তার স্বপ্ন হলো নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। বদিউল আলম মজুমদার শুধু মাত্র গণতন্ত্রই চান না, সেই সাথে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর লেভেলে অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী লেভেলে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বাসদের খালেকুজ্জামান একজন নির্লোভ ত্যাগী নেতা। এই সব মানুষ যখন কোথাও এক সাথে মিলিত হন তখন রাজনীতি অবশ্যই এসে পড়বে। বরং না আসাটাই অস্বাভাবিক। কারণ তারা রাজনীতির প্রোডাক্ট।
\দুই\
তারা রবের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। তারা রাজনীতির কথা বলেছেন। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে তারা একটি তৃতীয় রাজনৈতিক স্রোত সৃষ্টির বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করেছেন। তাদের আলোচনায় ছিলনা কোনো মাইক্রোফোন, ছিলনা কোনো উত্তেজক বক্তৃতা, ছিলনা কোনো হরতাল বা ঘেরাওয়ের ডাক। তারা যদি সেখানে চা-বিস্কুট খেতে খেতে অথবা ভাত-মাংস খেতে খেতে তৃতীয় রাজনৈতিক ফ্রন্টের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করে থাকেন তাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় কিভাবে? সেই রকম ড্রয়িং রুমের একটি বৈঠকী আড্ডায় পুলিশ হানা দেয় কিভাবে? কোন যুক্তিতে? তাহলে কি এখন থেকে আমরা আমাদের ড্রয়িং রুমে দুই-চারজন মেহমান ডাকবো এবং তাদের সাথে গল্পে-গল্পে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবো, তার জন্যও কি পুলিশের পারমিশন নিতে হবে?
যখন আমি বগুড়া জেলা স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি তখন রাজনীতির কিছুই বুঝতাম না। তারপরেও দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক আজাদ পড়তাম। রাজনীতির জটিল হিসাবগুলো মাথায় ঢুকতো না। তবুও রাজনীতির খবর পড়তে ভালো লাগতো। এভাবেই সেই শৈশবকাল থেকেই আজ জীবনের শেষ প্রান্তে আসা অবধি রাজনীতি গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করিনি। আজও কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত নই। মুসলামান হিসাবে ইসলামী মূল্যবোধ ছাড়াও রাজনীতিতে নির্ভেজাল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আমি গণতন্ত্রের মানস পুত্র হিসেবে শ্রদ্ধা করি।
দেশে কোন সামরিক শাসন নাই। নাই কোনো ইমার্জেন্সি। সরকার বলে, যে দেশে নাকি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু কোনো দিনকোনো আমলেই শুনিনি যে, নিজের বাড়িতে ড্রয়িং রুমে দুই দশজন বন্ধু-বান্ধব এবং সহকর্মীকে নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা করতে গেলেও সরকারের তথা পুলিশের পারমিশন নিতে হবে।সম্ভবত সেই কারণেই সেদিন আ.স.ম আব্দুর রব প্রশ্ন করেছেন আমরা কোন দেশে বাস করছি? যারা সেদিন একত্রে বসে ছিলেন তাদের কোনো দলই তো নিষিদ্ধ নয়। একজনের বাড়ির মধ্যে পুলিশ অযাচিতভাবে হানা দিয়েছে। তারপর চারদিন হয়েছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন নীরব। রাস্তায় নামা তো দূরের কথা রাজনৈতিক দল এবং নেতারা যদি ঘরের মধ্যেও বসতে না পারেন তাহলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে কিভাবে? লেভেল প্লেইং ফিল্ড, অর্থাৎ সকলের জন্য সমান সুযোগ না থাকলে সেই ইলেকশন তো ফেয়ার হতে পারে না। প্রথম শ্রেণীর এবং নেতৃস্থানীয় ইংরেজি এবং বাংলা জাতীয় দৈনিক সমূহ মনে করছে, রবের বাসায় পুলিশী অভিযান আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলসমূহকে ভয় দেখানোর একটি মহড়া।
\তিন\
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই যে, বিরোধী দলসমূহের সাথে এই ধরণের ভীতি সৃষ্টির আচরণ ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে। বিএনপি এবং তার জোট ভুক্ত দলসমূহ যখন ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বয়কট করে তখন মাসের পর মাস বিএনপি অফিস পুলিশ তালাবদ্ধ রেখেছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী বিএনপি প্রধান বেগম জিয়ার অফিস ৯২ দিন ধরে ঘেরাও করে রেখেছিল এবং বেগম জিয়া সেই কয়দিন ঘর থেকে বেরোতে পারেন নি। চলতি বছরের মে মাসে পুলিশ অকস্মাৎ বেগম জিয়ার অফিস তল্লাশি করে। তারা ভেবেছিল, সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতার প্রমাণ রয়েছে। নাম না জানা এক ব্যক্তির ডায়েরির ওপর ভিত্তি করে এই পুলিশী অভিযান পরিচালিত হয়। প্রতিটি রুমের ছবি তোলা হয়, সিসি টিভির ফুটেজ নেওয়া হয়। কিন্তু তারা অভিযোগের সপক্ষে বিন্দুমাত্র প্রমাণও পাননি।
ইংরেজি ডেইলি স্টার প্রশ্ন করেছে, আ.স.ম আব্দুর রবের বাসায় যা ঘটে গেল, তারপর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে: আমরা কি সামরিক শাসনের অধীনে বাস করছি? দেশে কি ইমার্জেন্সি বা জরুরি অবস্থা জারি রয়েছে? তা না হলে কার হুকুমে পুলিশ এই অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটালো? পুলিশ বলে যে, ওপরের হুকুমে এটা ঘটেছে। তখন রব বলেন যে, হয় সেই ওপরওয়ালাকে এখানে আনেন, না হলে তার টেলিফোন নাম্বার দেন, আমি কথা বলবো। কিন্তু পুলিশ সেটি করেনি। ডেইলি স্টার আরও বলে যে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির সাথে নিয়মিতভাবে এই ব্যবহার করা হচ্ছে। তাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তো দূরের কথা, খোলা আকাশের নিচে কোনো সভা করার অনুমতি দেওয়া হয়না।
বিএনিপর প্রতি পুলিশের আচরণ এবং রবের বাসায় পুলিশী অভিযানের পর ডেইলি স্টারে প্রশ্ন করা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে বিরোধীদলসমূহের সাথে সরকার কি ব্যবহার করবে এগুলো কি তারই ইঙ্গিত?
রবের বাসায় পুলিশী অভিযান সম্পর্কে লন্ডন যাত্রার প্রাক্কালে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, একদলীয় দুঃশাসনের মাধ্যমে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশকে চরম অন্ধকারের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। তিনি বলেন, বর্তমান গণবিচ্ছিন্ন অবৈধ সরকার এখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এই চরম সীমা লঙ্ঘনের কারণেই দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে উন্মুক্ত কোনো স্থানে তো নয়ই, বরং ঘরোয়া পরিবেশেও সভা কিংবা আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠান করতে বাধা দেয়া হচ্ছে। পুলিশী বাধা অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হামলা চালিয়ে সেসব সভা ও আলোচনা নস্যাৎ করতে যে ন্যক্কারজনক অসদাচরণ করা হচ্ছে তার ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই। আ.স.ম আব্দুর রবের বাসভবনে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলসমূহের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সভায় পুলিশী হস্তক্ষেপে আবারো প্রমাণিত হলো রাষ্ট্র এখন অমানবিক এবং চরম গণবিরোধী।
বাংলাদেশে ৪৬ বছরের রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, একমাত্র জেনারেল এরশাদের আমলে এই ধরণের একটি ঘটনা ঘটেছিল। তখন জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন দিয়ে দেশ চালাচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো বেসামরিক শাসনের আমলে এই ধরণের ঘটনা ঘটেনি। আজ যখন একটি বেসামরিক সরকারের আমলে এমন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলো তখন আশঙ্কা হয় যে, দেশের আগামী নির্বাচনও কি এমন ভয়-ভীতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে? সুতরাং জনগণের মনে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে সেই ভীতি দূর করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।