Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারী বর্ষণ ছাড়াই বিদায় নিচ্ছে বাঙালীর বর্ষোৎসবের মাস আষাঢ়

| প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মাসের ১৭ দিন কেটেছে বৃষ্টিহীন অবস্থায়
সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : বাঙালীর বর্ষোৎসবের মাস আষাঢ় এর বৈশিষ্ট হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। ভারী বর্ষণ ছাড়াই এবার বিদায় নিচ্ছে অতি বৃষ্টি তথা ভারী বর্ষণের মাস আষাঢ়। হিন্দু সনাতন বর্ষ পঞ্জী অনুযায়ী আষাঢ় বিদায় নিবে আজ রবিবার। আর ড. মো: শহিদুল্লাহ কেলেন্ডার অনুযায়ী গতকাল শনিবার প্রচন্ড কাঁঠ ফাটা রোদ উপহার দিয়ে আষাঢ় বিদায় নিয়েছে।
মুষলধারে বৃষ্টি নেই, বিল ঝিলে পানি নেই, নদ-নদীতে ঢল নেই। বৃষ্টিহীন কেটে গেছে আষাঢ়ের অনেক দিন। এবছর আষাঢ়ের ৩১ দিনের মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৪ দিন। বাকী দিনগুলো কেটেছে খাঁ খাঁ রোদ কিংবা গুমোট অবস্থায়। এবছর নরসিংদীতে আষাঢ় মাসে বৃষ্টিপাতের সর্বোচ্চ রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র ৭০.১ মিলিমিটার। অন্য দিনগুলোতে ছিল ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। অথচ আষাঢ় মাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে ১৭২ মিলিমিটার পর্যন্ত। প্রবীনজনদের মতে আষাঢ়ের প্রথম দিনই ভারী বর্ষণ হয়ে থাকে। এরপর আষাঢ়ের প্রায় প্রতিদিনই মুষলধারে বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে বাংলাদেশে। আষাঢ়ের বৃষ্টিপাতেই নদীতে ঢল নামে। খাল, বিল, নদী-নালা বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। পরিপূর্ণ বর্ষাকাল শুরু হয় বাংলাদেশে।
বাঙালীর শিল্প সাহিত্যে আষাঢ় মাসের বৃষ্টিপাত নিয়ে রচিত হয়েছে বহুসংখ্যক ছড়া, কবিতা, গান, গল্প, প্রবাদ ও শ্লোলকসহ বিভিন্ন রচনাবলী। আষাঢ়ের বৃষ্টি প্রকৃতিগতভাবেই মানুষকে ভাবাবেগ আশ্রিত করে ফেলে। বিশেষ করে আষাঢ়ের অঝোর ধারায় যুবক, যুবতী, তরুণ, তরুণীরা বেশী আবেগাল্পুত হয়।
আষাঢ়ের বৃষ্টি নিয়ে উপ-মহাদেশে রয়েছে একটি বিখ্যাত জনপ্রিয় গান ‘আষাঢ় শ্রাবন মানেনাতো মন, ঝরঝর ঝড়েছে’। এই গান এখনো মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। জনৈক কবি লিখেছেন ‘আষাঢ়ে নামে ঢল খালে আর বিলে, মনু মিয়া মারে মাছ, নিয়ে যায় চিলে’। কবিতার এই পংতি দুটির মাধ্যমে আবহমান বাংলার এক চিরায়ত রুপ ফুটে উঠে। আষাঢ়ের ভারী বৃষ্টিপাতে খাল, বিল, নদী নালা কানায় কানায় ভরে যায়। নদী থেকে মাছ উঠে খাল বিল ও প্লাবন ভূমিতে। এদেশের কৃষককুলের লোকেরা তখন প্লাবন ভূমি থেকে বড়শি, ধর্মজাল, ঝাকি জাল, ঠেলা জাল, চাই ইত্যাদি মাছ ধরার যন্ত্র দিয়ে মাছ শিকার করে। রবীন্দ্র সাহিত্যে আষাঢ়ের রয়েছে বিশাল জায়গা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভরো ভরো, মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর, দুই কুলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া, বরষার উৎসবে জেগে উঠে পাড়া’। আষাঢ়ের ভারী বৃষ্টিপাতের সময় নদীতে ঢল নেমে নদীকে প্লাবিত করে দুকুল ছাপিয়ে প্লাবন ভূমিতে উঠে যায় পানি। এসময় বাঙালী শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা বৃষ্টির পানিতে জলকেলি করে বেড়ায়, বাঙালী নব বধুরা বৃষ্টিতে ভিজে পালন করে বর্ষোৎসব। আষাঢ় পরিনত হয় বাঙালীর বর্ষ উৎসবে। আষাঢ় মাসের অবিরাম বৃষ্টিতে প্রকৃতি এর নিজস্ব রুপ ফিরে পায়। বনে বনে মাটি ভেদ করে জন্ম নেয় অজানা অচেনা হাজারো লতাগুল্ম। তরুরা লাভ করে নবরুপ। বর্ষার পানিতে প্রকৃতি সজিব হয়ে উঠে।
আষাঢ় মাসে আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটায় সূর্য প্রায় দেখাই যায় না। আকাশে মেঘের আধিক্যে যেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এই অবস্থাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিলঠাঁই আর নাহিরে, ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’ আরেক পংতিতে লিখেছেন ‘কালিমাখা মেঘে ওপারে আধার ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে, ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’। একটি দেশের শিল্প সাহিত্য সে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। গান, কবিতা থেকেই মানুষের অক্ষিপটে ভেসে উঠে আষাঢ়ের প্রকৃত অবয়ব। কিন্তু আষাঢ় মাস এখন আর পূর্বাবয়বে নেই। জলবায়ূর পরিবর্তন, অতিরিক্ত কার্বনডাই অক্সসাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিএফসি গ্যাস নি:সরনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের রাস্তাঘাট পাকাকরণ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন জনিত বৃষ্টির রিসাইক্লিং পদ্ধতি বাধাগ্রস্থ হবার কারণে এ অবস্থার সৃষ্ট হয়েছে। বৃষ্টিপাতের হার দিন দিন কমে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, চৈত্র থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত সব চেয়ে বেশী ভারী বৃষ্টিপাত হয় আষাঢ় মাসে। কিন্তু এবছর আষাঢ় মাসের অন্যান্য বছরের তুলনায় বৃষ্টি অনেক কম। এবার আষাঢ় মাসে ১৭ দিন কেটে গেছে একেবারে বৃষ্টিহীন অবস্থায়। এর মধ্যে ৪ থেকে ৫ দিন আকাশে মেঘসহ গুমোট অবস্থা বিরাজিত ছিল। আষাঢ়ে বৃষ্টিহীনতার কারণে নরসিংদীর ৭টি নদীর পানি এখনো বর্ষাসীমায় পৌছতে পারেনি। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের পানিতে মেঘনা, আড়িয়ালখাঁ, হাড়িধোয়া, শীতলক্ষা ও ব্রহ্মপুত্রসহ নরসিংদীর নদ-নদীতে পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও এখনো স্বাভাবিক বর্ষার সীমায় পৌছতে পারেনি নদ-নদীর পানি। মেঘনা অববাহিকা চরাঞ্চলগুলো এখন পানি শূন্য অবস্থায় রয়েছে। অথচ আষাঢ়ের ঢলের পানিতেই মেঘনা ভরপুর হয়ে যেতো। বাঙালী কবিতা সাহিত্যে এ নিয়ে রচিত হয়েছে কবিতাও। কবি হুমায়ূন কবির ‘মেঘনায় ঢল’ নামে তার কবিতায় লিখেছেন ‘শোন মা আমিনা, রেখে দেরে কাজ ত্বরা করি মাঠে চল, এলো মেঘনায় জোয়ারের বেলা, এখনি নামিবে ঢল। কবি সুকুমার রায় তার মেঘের খেয়াল কবিতায় লিখেছেন ‘আকাশের ময়দানে বাতাসের ভরে, ছোট বড় সাদা কালো কত মেঘ চরে। কচি কচি থোপা থোপা মেঘেদের ছানা, হেসে খেলে ভেসে যায় মেলে কচি ডানা’। সুকুমার রায় তার কবিতায় আষাঢ় মাসে মেঘেদের আনাগোনা নিয়েই এ কবিতা রচনা করেছেন। শিল্প সাহিত্যে যে আষাঢ় মাসের বর্ণনা পাওয়া যায় সে আষাঢ় মাস বাঙালীর জীবন থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে নদ-নদী, খালবিল তথা আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ