হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মুনশী আবদুল মাননান : হাওর এলাকায় হঠাৎ ভয়াবহ বন্যায় প্রায় সমুদয় বোরো ধান বিনষ্ট হওয়ার দায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রবল পানির তোড়ে হাওর রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে, কোথাও বাঁধ উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করে ধান ডুবিয়ে দেয়। বলা হচ্ছে, অন্তত ১০ লাখ টন ধান এতে নষ্ট হয়েছে এবং হাজার হাজার কৃষক তাদের একমাত্র ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, হাওর রক্ষা বাঁধ উঁচু ও টেকসই করে নির্মাণ করা হলে এবং সংস্কার কাজ যথাসময় সম্পন্ন হলে এতবড় ফসলহানির ঘটনা ঘটতে পারতো না। বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় কিছু কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা যোগসাজস করে বরাদ্দকৃত অর্থের একটা বড় অংশ লোপাট করেছে। দুদক অনুসন্ধান করে এই অভিযোগের সত্যতার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে। ইতোমধ্যে কতিপয় কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই আগাম বন্যা ও ব্যাপক ফসলহানির জন্য কি কেবলই পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতি ও ব্যর্থতাই দায়ী? আমরা আবারও বলছি, বন্যায় ফসলহানির দায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এড়িয়ে যেতে পারে না। কিন্তু এই সংস্থাটিই এ জন্য একমাত্র দায়ী নয়। টানা ভারি বর্ষন এ জন্য দায়ী। সবচেয়ে বেশী দায়ী ভারত থেকে নেমে আসা ঢল। যত বর্ষণই হোক, কয়েক দিনের মধ্যে গোটা হাওর এলাকা পানির নীচে তলিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভারত থেকে ধেয়ে আসা পানির ঢল এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। বিস্ময়কর ব্যাপারে হলো, এ কথা কিন্তু জোরেসোরে বলা হচ্ছে না। হাওর রক্ষা বাঁধ কেন পানি ঠেকাতে পারলো না, সেটাই বড় করে দেখা হচ্ছে।
দু’মাস পর মৌলভীবাজার ও সিলেট ব্যাপক বন্যা ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। অবিরাম বর্ষণই এর একমাত্র কারণ নয়। ভারত থেকে নেমে আসা ঢলই এর প্রধান কারণ। এখন উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চল বন্যার পানিতে ভাসছে। অন্তত ১৩ জেলা বন্যাক্রান্ত এবং পরিস্থিতির দ্রæত অবনতি ঘটছে। নতুন নতুন এলাকা বন্যাকবলিত হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ পানি বন্দী হয়ে আছে। তাদের দু:খ-দুর্দশার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বন্যাকবলিত এলাকায় আশ্রয় ও ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। সরকারীভাবে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা, বিপন্ন লোকদের আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে সহায়তা করা এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা আংশিক সত্য, পুরো সত্য নয়। সরকারের তৎপরতা মোটেই যথেষ্ট নয়; বরং প্রচারসর্বস্ব। প্রতিদিনের সংবাদপত্র ও টিভিতে অসহায় ও বিপন্ন মানুষের যে চিত্র উঠে আসছে তাতেই বুঝা যায়, কতটা বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে বানভাসি মানুষ। এ জন্যও কি লাগাতার ভারি বর্ষণই দায়ী? মোটেই না। এ জন্যও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলই মূলত দায়ী। খবর পাওয়া গেছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত গজলডোবা বাঁধের সবকটি গেট ভারত একযোগে খুলে দেওয়ায় হুড় হুড় করে পানি নেমে আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। এতেই উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। আগ্রাসী রূপে মধ্যাঞ্চলেও বিস্তৃত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, লাগাতার বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতির এই পটভূমিতে ভারত গজলডোবা বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে। এর ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নীলফামারীর ডিমলা, গয়াবাড়ী, জলঢাকা উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা ও কালিগঞ্জ উপজেলার সব গ্রামের পাশাপাশি অসংখ্য চর তলিয়ে গেছে। গজলডোবা বাঁধের উন্মুক্ত গেটগুলো একইভাবে উন্মুক্ত থাকার কারণে উত্তরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা বন্যা কবলিত হচ্ছে। খবর অনুযায়ী, ইতোমধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া জামালপুর, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে এবং পরিস্থিতি দ্রæত অবনতি ঘটছে। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পাশাপাশি তিস্তা, ধলেশ্বরী, করতোয়া, ধরলা প্রভৃতি নদীতে পানি বাড়ছে। অধিকাংশ নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদনদীর ধারণ ক্ষমতাহীন বিপুল পানিরাশি বাড়িঘর, স্থাপনা, ফসলাদি ডুবিয়ে দিচ্ছে। এই সঙ্গে নদী দু’কূল ভেঙ্গে তছনছ করে দিচ্ছে সবকিছু। বিভিন্ন এলাকায় শহর রক্ষা, ফসল রক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হয় ভেঙ্গে গেছে না হয় ভাঙনের হুমকির মুখে এসে পড়েছে। ভারত থেকে পানি আসা বন্ধ না হলে বন্যা ও নদীভাঙন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
খবর পাওয়া গেছে, ভারতের উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে আরো বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির আরো বিস্তৃতি ও অবনতি ঘটা অবধারিত। ক্ষয়ক্ষতি ও জনদুর্ভোগ আরো বেশি ও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। ইতোমধ্যে আবহাওয়াবিদরা বলে দিয়েছেন, এবার বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সেটা যে ভারতের দিকে তাকিয়েই তারা বলেছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এটা আমরা বরাবরই দেখে আসছি, ভারতে যখনই প্রবল বর্ষণ হয়, বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখনই ভারত অভিন্ন নদনদীতে দেয়া বাঁধগুলো ভেঙ্গে বা গেট খুলে দিয়ে পানি একযোগে বাংলাদেশ চালান করে দেয়। আর বাংলাদেশের মানুষ ডুবে মরে। এবারও সেটা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। গজলডোবা বাঁধের গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফারাক্কার গেট খুলে দেয়া হয়েছে কিনা, জানা যায়নি। তেমন অবস্থা হলে ফারাক্কার গেটও খুলে দেয়া হবে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় ভারত ফারাক্কারসহ বিভিন্ন নদীর ওপর দেয়া বাঁধগুলো খুলে দিয়ে গোটা বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়। তখনকার পানিসম্পদমন্ত্রী এর কোনো প্রতিবাদ না করে বলেছিলেন উজান দেশের পানিতে ভাটির দেশকে ডুবতেই হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাঁধ খুলে দেয়ার আগে বাংলাদেশকে অবহিত করার ন্যূনতম দায়িত্ববোধের পরিচয় ভারত কখনোই দেয় না। আন্তর্জাতিক বিধি-নিয়ম মতে, ভাটির দেশের সম্মতি ছাড়া উজানের দেশ অভিন্ন নদীতে কোনো বাঁধ বা প্রতিবন্ধক নির্মাণ করতে পারে না। নদী প্রবাহের কোনো পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। ভারত এই আন্তর্জাতিক বিধি-নিয়ম তোয়াক্কা না করে অভিন্ন প্রায় সব নদীতে বাঁধ, গ্রোয়েন, স্পার নির্মাণ করেছে। একই সঙ্গে নদী প্রবাহের পরিবর্তন সাধন করেছে। নির্বিচারে পানি তুলে নিয়ে নদী প্রবাহে পরিবর্তন এনেছে, যার ফলে বাংলাদেশ পানিবঞ্চনার শিকার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিধি-নিয়ম অনুযায়ী, ভাটির দেশের সম্মতিতে উজানে বাঁধ নির্মাণ করা হলে এবং কোনো কারণে বাঁধ খুলে দিয়ে পানি ছাড়ার প্রয়োজন হলে আগে-ভাগেই ভাটির দেশকে জানাতে হবে, যাতে ভাটির দেশ সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নিতে পারে। গজলডোবা বাঁধের গেট খুলে দেয়ার আগে যদি ভারত বাংলাদেশকে জানাতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যতটা সম্ভব প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নিতে পারতো। সেটা নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে ক্ষতির মাত্রা বেড়েছে।
এখানে আমাদের সরকারের ব্যর্থতাও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। সেই এপ্রিল মাস থেকেই আবহাওয়াবিদদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, এবার বড় ধরনের বন্যার কবলে পড়তে পারে দেশ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষিতে সরকারের সর্তক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রকৃতির এটাই নিয়ম, উজানের পানি ভাটিতেই নেমে আসে। ভারতের অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশ দিয়েই সাগরে পতিত হবে। তাছাড়া ভারতের অতীতের আচরণও বিবেচনায় রাখা উচিৎ ছিল যে, ভারত অভিন্ন নদীর বাঁধগুলো এক সাথে খুলে দিয়ে পানি বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বশীলরা আলমত ও অভিজ্ঞতা আমলে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রোধ করেনি। এমনকি ভারত এই যে পানি ঠেলে দিয়ে বন্যার তান্ডব ঘটিয়ে দিলো, তার প্রতিবাদ তো দূরের কথা, তাকে বিবেচনাযোগ্য বলেও মনে করা হচ্ছে না।
পানি নিয়ে শুরু থেকেই ভারত ‘রাজনীতি’ করে আসছে। এই রাজনীতির মূলকথা, বাংলাদেশের মানুষকে পানি না দিয়ে শুকিয়ে এবং পানি ঠেলে দিয়ে ডুবিয়ে মারা। বাংলাদেশ সব সময়ই ভারতকে বন্ধু বলে গণ্য করে। ভারতও কথায় কথায় বলে, বাংলাদেশ তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু বা মিত্র। কদিন আগেও ভারতের প্রেসিডেন্ট একথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, অভিন্ন নদীর পানির প্রশ্নে এই মিত্রতা ও বন্ধুত্বের পরিচয় ভারত একেবারেই দিচ্ছে না। অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে শুকনো মওসুমে বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিত করা হচ্ছে। অভিন্ন নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভর করে ভারত বহু সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ শুকনো মওসুমে ব্যাপক পানিশূন্যতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের নদীগুলো ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বহুনদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। পানির অভাবে বাংলাদেশের কৃষি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সেচ প্রকল্পগুলো পানির অভাবে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত এদের আওতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছে অতিরিক্ত পানি চায় না, চায় ন্যায়সঙ্গত হিস্যা। সেটাও ভারত দিচ্ছে না। গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি থাকলেও বাস্তবে তার কোনো কার্যকারিতা নেই। কোনো বছরই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পায় না। তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার বাংলাদেশের পুন: পুন: তাকিদ বার বার অগ্রাহ্য হচ্ছে। চুক্তি হলেই যে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও বাংলাদেশকে ভারত বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছে। ভারতের আশ্বাসে বাংলাদেশের মানুষের আর বিশ্বাস নেই।
অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, নৌচলাচল, মৎস্য উৎপাদন, ভূপ্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়ায় ভারসাম্য কীভাবে বিপর্যয়কর হয়ে উঠছে, কী পরিমাণে ও মাত্রায় বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ এখানে নতুন করে দেয়ার প্রয়োজন নেই। এব্যাপারে ওয়াকিবহাল মহল ভালোরকম জ্ঞাত আছে। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ বন্ধ্যা, নিস্ফলা, ও মানব বসতির অনুপযোগী একটা দেশে পরিণত হওয়ার পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।
এ গেলো একদিক। অন্যদিক হলো, বর্ষা মওসুমে পানি ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়া। তার জনগণের দুর্গতি-দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করে ক্ষতিগ্রস্ত করা। চলতি বন্যা যতটুকু আঘাত হেনেছে তাতেই লাখ লাখ মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। খাদ্য, আশ্রয় ও ত্রাণের জন্য তারা এখন দিশাহারা। শুধু মাত্র পানি রাজনীতির শিকার হয়ে একটা দেশ ও তার জনগণ কী রূপ অসহায় ও নিরূপায় হয়ে পড়তে পারে, কত প্রকার ক্ষতির শিকার হতে পারে, বাংলাদেশ ও তার জনগণ তার উল্লেখযোগ্য নজির।
বাংলাদেশের জনগণ স্মরণকাল থেকে বন্যার সঙ্গে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের সঙ্গে বসবাস করে আসছে। তাদের ধারাবাহিক অস্তিত্বই প্রমাণ করে, এই বন্যা ও দুর্যোগ-বিপর্যয় মোকাবিলা করার এক অশেষ সক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু গত অর্ধশতাব্দীকাল ধরে এই সক্ষমতা ক্রমে আসছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। প্রকৃতিসৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবিলা করা যায়; কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবিলা করা কঠিন। সেটাও হয়তো এত কঠিন হতো না, যদি রাষ্ট্রপরিচালকরা দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও প্রাজ্ঞ-যোগ্য হতেন। এক্ষেত্রে বড় রকমের ঘাটতি রয়েছে। পানির মামলায় আমাদের রাষ্ট্রপরিচালকরা পূর্বপর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। ভারত একতরফাভাবে পানিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশ তা রুখতে পারেনি; পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেনি। পানির আগ্রাসন ঠেকাতে পারেনি। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন-প্রথা বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও কিছু করতে পারেনি। উপযুক্ত পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শুকনো মওসুমে পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভবপর হলেও সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই। বর্ষায় ভারতীয় পানির আগ্রাসন থেকে দেশ ও জনগণকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগও নেই। পর্যবেক্ষণ-বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিলেও সরকারের তাতে ভ্রæক্ষেপ নেই।
সন্দেহ নেই, চলতি বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার বড় ধরনের বিপাকে পড়ে গেছে। এ বিপাক আরো বাড়তে পারে। এ মুহূর্তে মানুষ বাঁচানো ও তাদের দুর্ভোগ লাঘব করা জরুরি। দরকার ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা। বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য খাদ্য, পানযোগ্য পানি, ওষুধপত্র ইত্যাদি যোগান দেওয়ার বিকল্প নেই। অথচ বাস্তবতা এই যে, এসব যোগান দেয়ার পূর্ণ সামর্থ সরকারের নেই। বন্যাকবলিত এলাকায় প্রচন্ড খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। সরকার ত্রাণ হিসাবে যে খাদ্য দিচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। চালের সরবরাহ কম; দাম নাগালের বাইরে। ভানভাসি অধিকাংশ মানুষের চাল কেনার সামর্থ নেই। পানযোগ্য পানির অভাব আছে; অভাব আছে ওষুধসহ অন্যান্য সামগ্রীর। পানি বা অন্যান্য সামগ্রীর অভাব হয়তো পূরণ করা যাবে। কিন্তু চালের কি হবে? সরকারের গুদামে চাল নেই বললেই চলে। থাকলে হয়তো বিনামূল্যের পাশাপাশি স্বল্পমূল্যেও চাল দেয়া যেতো। ত্রাণমন্ত্রী বলেছেন, ত্রাণের কোনো অভাব নেই। অথচ চালের গুদাম প্রায় খালি। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারী খাদ্যগুদামে খাদ্য মজুদের পরিমান দুই লাখ টনের নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকার বোরো সংগ্রহের যে অভিযান শুরু করেছিল, তা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে এই ঘাটতি পূরণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপও নেয়া হয়নি আমদানির মাধ্যমে ঘাটতিপূরণ করা সম্ভব হতো। খাদ্য মন্ত্রণালয় কুম্ভুকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় এখন একটা লেজে গোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে চালের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে ১০/১৫ টাকা বেড়েছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম বেড়েছে। এখন এক মাসের ব্যবধানে দেড়গুণ মূল্য দিয়ে চাল আমদানি করা হচ্ছে। বেসরকারী আমদানিকারকদের জন্য শুল্ক রেয়াত দেয়া হয়েছে। এটা আরো আগে দেয়া যেতো। সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্বের কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের চড়াদামে চাল কিনতে হয়েছে। চালের দাম যখন দফায় দফায় বাড়ছিল তখন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, ব্যবসায়ী ও মিলারদের কারসাজিতে চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। তখন সরকার এদিকে নজর দেয়নি। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ১৬ হাজার মিলারকে খাদ্য মজুদ করে রাখার দায়ে কালো তালিকা ভুক্ত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, চোর পালালে যতই বুদ্ধি বাড়–ক তাতে কোনো ফায়দা হয়না। একথা খুব স্পষ্ট করেই বলা যায়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এব্যাপারে সম্পূর্ণ অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তারপরও পরিস্থিতির কি হবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এখনো বলা যাচ্ছে না। আমদানিকৃত চাল দেশে ঢুকলেও বাজারে এখনো তার কোনো প্রভাব পড়েনি। এটা বড়ই আশ্চর্যের কথা যে, দেশের সরকারী গুদামে নিরাপত্তামূলক খাদ্য মজুদ নেই। সরকারের হিসাবের এত খাদ্য তাহলে কোথায় গেলো? খাদ্য উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বলে সরকারের দাবির ভিত্তি তাহলে কি? খাদ্যমন্ত্রী দায় এড়াতে বলেছেন, তিনি গনক নন যে, আগেই জানবেন দেশ আকস্মিক বন্যার শিকার হবে। এটা দূরদর্শী কোনো মন্ত্রীর কথা নয়। যাই হোক, এখন সরকারকে ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানোসহ চালের বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বানভাসি মানুষকে আরো অন্তত তিন মাস খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। একই সঙ্গে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এনে স্থিতিশীল করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।