Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পিতল-কাঁসার ঐতিহ্য

| প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোঃ আনিস উর রহমান স্বপন, ধামরাই (ঢাকা) থেকে
আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্য পিতল-কাঁসা শিল্প। নিত্য নতুন সিরামিক, মেলামাইন, কাঁচ ইত্যাদির সামগ্রী সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ পিতল-কাঁসার ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে দিয়েছেন। নিকট অতীতেও পিতল-কাঁসা সামগ্রী গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নিত্য ব্যবহৃত সামগ্রী হিসেবে দেখা যেতো। বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ার সাথে সাথে এসবের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে।
ঢাকা জেলার বৃহত্তম উপজেলা ধামরাই এলাকা কাঁসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত ছিল। ওই সময় শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশের বাইরেও ছিল এর প্রচুর চাহিদা।
এছাড়া বিদেশী পর্যটকরা একসময়ে কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকাজ খচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যেতো। কিন্তু এই পিতল-কাঁসা শিল্পের ঐতিহ্য আজ নানা সমস্যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা বর্তমানে অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছে। তাদের দেখারও কেউ নেই। পিতল-কাঁসা শিল্পে জড়িত শিল্পীরা পৈতৃক পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এই কারুশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কখনো কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।
এ ব্যাপারে সরেজমিনে কথা হয় ধামরাই মেটাল ক্রাপ্টস এর স্বত্তাধীকারী সুকান্ত বনিকের সাথে। র্দীঘ প্রায় ২ শত বছর ধরে তার পূর্ব পুরুষ থেকে শুরু করে ৫তম বংশধর হিসেবে এ পেশার সাথে তিনি জড়িত আছেন। তিনি বলেন, ধামরাই উপজেলা সদরেই নোটা, ঘটি, হাড়ি-পাতিল, থালা, গøাস, বদনি ও বিভিন্ন শো-পিচ, দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্র তৈরির জন্য স্বাধীনতার পূর্বে এই এলাকায় ৩০/৪০টি কারখানা ছিল। বর্তমানে এ কারখানা সংখ্যা ৪/৫টি মতো রয়েছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্লাস্টিক, লোহা, ও স্টিলের তৈরী এসব জিনিস পত্র তৈরী হওয়ায় পিতল-কাঁসা ক্রয়ে বেশ ভাটা পড়েছে। তিনি বলেন, কাঁসা-পিতলের তৈরী জিনিস পত্র একবার ক্রয় করলে তা ২০/৩০বছরের বেশী সময় ব্যবহার করা যায়। শুধু তাই নয় পূর্বে যে দামে কেনা হতো ব্যবহারের পর তার চেয়েও বেশী দামে বিক্রি করা যায়।
এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, পূর্বে এসব জিনিসপত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে তেমন একটা বেগ পেতে হতো না। বর্তমানে রপ্তানী করতে গেলে নানা সমস্যার সম্মুখিত হতে হয়।
শ্রমিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার এখানে সারাদিন কাজ করে একজন শ্রমিক যা পায় তার চেয়ে বাইরে কাজ করলে বেশী উপার্জন করতে পারে। তাই দিনদিন শ্রমিকের সংখ্যাও কমে গেছে।
ধামরাই মেটাল ক্রাপ্টসে কর্মরত নিমাই পাল (৪৫) নামের এক শ্রমিক বলেন, তিনি পূর্বে বাপ-দাদার সাথে প্রতিমা তৈরী কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে কাঁসা-পিতলের তৈরীর সঙ্গে তিনি এখানে ২৩ বছর ধরে কর্মরত আছেন। তিনি প্রতিমা ও বিভিন্ন দেবদেবীর এবং জীবজন্তুর প্রতিকৃতির কর্মকার। এখানে তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন।
আরো কথা হয় ৫০ বছর বয়সী কাঁসা পিতলের ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার বাপ-দাদার পেশা ধরেই ২৮বছর ধরে ধামরাই বাজারে ব্যবসা করে আসছেন। স্বাধীনতার পরেও এ ব্যবসা ছিল বেশ জমজমাট। এ বাজারেই ছিল অনেক ব্যবসায়ী। বর্তমানে আছে হাতে গোনা কয়েকজন। তিনি আরো বলেন বর্তমানে শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়ের বিয়েতে উপহার হিসেবে কাঁসা-পিতলের তৈরী কিছু জিনিস পত্র কিনেন। তাছাড়া সচারচার কেউ এ সব নিকেনা। তাই ব্যবসায় পড়েছে ভাটা।
এক সময়ে এই কাঁসা পিতল শিল্প খুব বিখ্যাত ছিল বলে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের শিল্পর্কম নকশা করে বিদেশে রফতানি করতো। তাদের তৈরি থালা, কলসি, বাটি, ঘটি ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রসহ অন্যান্য জিনিসের চাহিদা এখনও অনেকাংশে কমে গেছে। এসব জিনিসের দাম বৃদ্ধির কারণ হলো- প্রয়োজনীয় উপকরনের অভাব, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিল্পী ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে তাদের পেশার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়েছেন। কাঁচামাল আমদানিকৃত বিভিন্ন উপকরনের দাম বেড়েছে গত ১৪/১৫ বছরে প্রায় ৩ গুণ। অপর দিকে স্টিলের জিনিসের থালা, বাটি, চামচ, গøাসসহ বিভিন্ন জিসিনের আর্ধিক্যের কারণে দেশীয় কাঁসা পিতল শিল্পের জিনিসের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
শহর নগর গ্রামে বাঙালির ঘরে ঘরে কাঁসা-পিতল শিল্প ঐতিহ্য বহন করে এনেছে যুগ যুগ ধরে। যখন কোন ফ্যাশন হিসেবে কাঁচর সামগ্রী ও স্টিল সামগ্রী কিছুই ছিল না তখন গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে কাঁসা পিতল শিল্প সামগ্রীর জিনিসপত্র একমাত্র ব্যবহার হিসেবে সবার ভরসা ছিল। এছাড়া প্রতিবেশী দেশসমূহে এর প্রচলন ছিল। তবে এখন দেশের পল্লীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবারে কাঁসা পিতল সামগ্রীর জিনিস পত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। এখনও বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু পরিবারের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানে কাঁসা পিতল সামগ্রী দিয়ে থাকে মেয়ে পক্ষ থেকে। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে এসব শিল্পর্কম নকশা খচিত পিতল-কাঁসা সামগ্রী অর্ডার দিয়ে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, তাজমহল। এছাড়া বিখ্যাত ব্যক্তির ছবির শিল্পর্কম ও বিভিন্ন ধরনের শিল্পর্কম। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য রক্ষা করতে গেলে এই পিতল-কাঁসা শিল্পের বিকল্প নেই।



 

Show all comments
  • Romena A Emu ২৪ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৬ এএম says : 0
    আমি কাসার দোকানের মোবাইল নম্বর টা চাচ্ছিলাম
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ