Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড-এর কলাম -- বাংলা চলচ্চিত্র এবং আমাদের ঐতিহ্য

| প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

যৌথ প্রযোজনার নামে এদেশের নীতিমালা তথা রাষ্ট্রীয় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে কোলকাতার ‘বস টু’ এবং ‘নবাব’, ছবি দুটি গত ঈদে মুক্তি দিয়ে জাতিকে চমকে দেয় এদেশেরই কিছু মানুষ। ওই দুই ছবি স¤পর্কে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপিত হলে, যৌথ প্রতারণা অবিহিত করে এর বিরুদ্ধে শুরু হয় চলচ্চিত্র পরিবারের আন্দোলন। রাষ্ট্রীয়নীতি অমান্য করা ছবি দুটির মুক্তি প্রতিরোধে যখন চলচ্চিত্র পরিবার রাজপথে, তখন অভিযুক্ত ছবি দুটোর পক্ষ থেকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ‘বস টু এবং নবাব, এই দুই ছবি মুক্তি দিতে না দিলে সব হল বন্ধ করে দেয়া হবে।’ তার মানে নিজ দেশের চলচ্চিত্রকেই তারা ব্যবসা করতে দিবেনা! সব হল বন্ধ করে দিবে। প্রকাশ্যে ঘোষণা। স্বাধীন দেশে এও কি সম্ভব? এই উত্তর খোঁজার জন্য একটু পেছনের দিকে যেতে হয়। আমাদের এই সোনার বাংলায় দৃশ্যত সোনার খনি, আমরা দেখিনা সত্য। কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটা আছে! যার কারণে অতি প্রাচীণ কাল থেকেই এদেশটাকে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে বর্গী আগমণ ঘটেছে। তবে একথা সত্য যে, কোনো বর্গীগোষ্ঠীই এখানে বিস্তার লাভ করতে পারত না, যদি না এদেশে বর্গীরা তাদের দোসরদের সহযোগিতা পেতো। এর জ্বলন্ত প্রমাণ ১৯৭১ সাল। যখন এদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীনতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর সাথে প্রাণপণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত, তখন শহীদ হয় ত্রিশ লাখ নিরীহ মানুষ। সম্ভ্রম হারায় দুই লাখ নারী। তারপরেও আশার কথা হলো, কোনো কালেই কোনো বর্গীগোষ্ঠী এখানে বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি, কারণ নিজের অগোচরেই আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের চেতনা আমাদের অনুপ্রাণিত করে বলেই, আমাদের জনগণ লড়াকু সৈনিকে রূপান্তরিত হয়ে বারুদের স্ফুলিঙ্গের মত বিস্ফোরিত হয়। আমাদের পূর্বসুরী থেকে এই আমরা, ধারাবাহিক জীবন সংগ্রামর মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় থেকেছি অটল। পাল, সেন, মোগল, পাঠান, ইংরেজদের মত মহাশক্তির সাথে কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায় আমাদেরকে সাপলুডু খেলতে হয়েছে। জীবনবাজি রেখে খেলেছিও আমরা। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন নবাব সিরাজ, তিতুমির, ফকির মজনু শাহ, ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা সূর্য্য সেনসহ আরো অনেকে। সর্বশেষ পশ্চিম পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সমগ্র বাংলায় ছড়ানো ছিটানো প্রাচীন ঐতিহ্য আর নিদর্শনের অস্তিত্ব বলে দেয় আমাদের এই ভূ খন্ডের হাজার বছরের ইতিহাস কত গর্বের। অনেক ইতিহাসবিদের মতে নানা ধরনের প্রস্তর শিলালীপি এমনকি পীর আওলিয়াদের স্বহস্তে লেখা কোরআন শরীফ, কাসিদা ইত্যাদি এই ভ‚খন্ড থেকে লুট করে নিয়ে গিয়ে বৃটিশ মিউজিয়ামসহ অনেক দেশ তাদের নিজ ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। রূপবান, কালু গাজী, চ¤পাবতী অথবা নিñিদ্র লোহার বাসরে সাপে কাটা স্বামী ল²ীন্দরের লাশ নিয়ে ভেলায় চেপে বেহুলার স্বর্গ যাত্রা-আধুনিক বিশ্বে বাংলার এইসব উপাখ্যানের মূল্য না থাকলেও, এগুলো আমাদের অমূল্য স¤পদ। টার্জানের অ্যাডভেঞ্চারে আমরা যতটা না পুলকিত হই, তার চেয়ে অনেক বেশি কাঁদায় বারো দিনের রহিম বাদশাহকে কোলে নিয়ে রূপবানের বনবাস। মুখে মুখে ঘুরে সাত ভাই চ¤পার গল্প, ভাওয়াল রাজা সন্ন্যাসীর ইতিহাস। এই বাংলায় জারি, সারি, মুর্শিদী, মহুয়া, পল্লীগীতি আলকাপ, গম্ভীরা, ভাওইয়া, ভাটিয়ালি, কীর্তন আর জ্যোৎ¯œা রাতে গৃহস্থের নিকানো উঠনে পুঁথি পাঠের আসর পৃথিবীর বুকে আমাদের সংস্কৃতিকে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা। মাছ ভাত লাল শাক মুসুরের ডাল কিংম্বা কৃষকের নুন ছিটানো কাঁচা মরিচ ডলা ভোরের পান্তার সাথে পিঁয়াজ-এ কেবলই বাংলার সংস্কৃতি। ঘামে ভেজা প্রচন্ড গরমে বৈশাখের ঢাক। কুয়াশা আবৃত শীতের ভোরে খেজুরের রস। এই সবই তো আমাদের এই ভ‚খন্ডের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এখানে মাথার চুল ঝাঁকিয়ে কোমর দুলিয়ে দুই পায়ের মাঝে বালিশ নিয়ে কুদ্দুস বয়াতির 'আমার পাগলা ঘোড়ারে', এই সুরের কাছে পরাজিত মাইকেল জ্যাকসনের 'থ্রিলার'। আবার সাকিরার বিশ্ব মাতানো 'ওয়াকা ওয়াকা' কি পেরেছে মমতাজের 'পোলা তো নয় যেন আগুনের গোলা’ অথবা ফরিদা পারভিনের কন্ঠে লালনের 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়', হৃদয় ছোঁয়া সুরকে পরাভ‚ত করতে? আব্বাসউদ্দীনের 'ওকি গাড়িয়াল ভাই কত রইব পন্থের পানে চাহিয়া', আমাদের এই আবেগ জড়ান সুরকে ছাপিয়ে কি ভিনদেশী কোনো গান হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে পেরেছে? আবহমান বাংলার নিজস্ব চেতনায় বাঙালি জাতি বড়ই আত্মকেন্দ্রিক এবং অদ্বিতীয়ও বটে। এর অনেক বড় প্রমাণ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী। পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী যখন এই ভ‚খন্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির উপর তাদের উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে বলেছে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা, তখনই এই জাতির গর্জে উঠার ইতিহাস বিশ্বে অহংকারের প্রতীক হয়ে রয়েছে। অতএব কেউ যদি শহীদ নূর হোসেনদের কথা ভুলে বাঙালি ইতিহাসকে তুচ্ছজ্ঞান করে অতি মুনাফা অর্জনের আশায় যৌথ প্রতারণার নেশায় বিভোর হয়ে এই জাতিকে আজ শোনায়, ‘বেটা শো'যা, শো'যা বেটা, নাহিতো গাব্বার সিং আয্যায়ে গা।’ তাহলে তাদের ভাষায় বলতে হয়, পাঁচাশ পাঁচাশ কোড়স দূর গাঁওকা, গাব্বার সিংয়ের খবর তোমরা রাখ, কিন্তু ঘরের পাশে ডাকাত সর্দার কালীকিংকর স্যানালের খবর রাখনা। রাখবেই বা কেনো। ইস্টন্ডিয়া কো¤পানি তো এদেশে এসেছিল ব্যবসা করার জন্য, দেশত্ববোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নয়। অতএব ক্লাইভের দোসর মীর জাফর আলী খানের কাছে দেশপ্রেম আশা করাও তো ছিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার রাজনৈতিক ব্যর্থতা। তাই বলছি, নীতিমালানুযায়ী যৌথ প্রযোজনা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নাই। না আছে দর্শকের, না আছে চলচ্চিত্র পরিবারের। কিন্তু যৌথ প্রতারণার যাঁতাকলে বাংলার ঐতিহ্য ক্ষুণè হতে দেখলে এ জাতি বসে থাকবে না। বুকের রক্ত দিয়ে হলেও তা রুখে দিবে। এখানে কোনো ছাড় নাই। নব্য বর্গীদের পরাস্ত হতেই হবে। নিজেস্ব ঐতিহ্য রক্ষায় জাতি যখন রাজপথে, বাংলা চলচ্চিত্রের জয় তখন অনির্বাজ্য। দেরিতে হলেও যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ স্থগিত করে পুনরায় নীতিমালা গঠণের উদ্যোগ নেয়ার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ