Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফরহাদ মজহার অপহরণ, মার্থা গেলহর্ণ এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা

| প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : কবি, প্রাবন্ধিক ও প্রাজ্ঞ সমাজচিন্তক ফরহাদ মজহার অপহৃত হওয়া ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ত্বরিৎ পদক্ষেপে যশোরের অভয়নগর থেকে উদ্ধার হওয়ার পর ইতিমধ্যেই ৮দিন পেরিয়ে গেছে। পুলিশি অভিযানে ঢাকায় ফেরার পর অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত ফরহাদ মজহার আদালতে নিজের জবানবন্দি রেকর্ড করে বাসায় ফিরেছেন বটে শারীরিক-মানসিকভাবে এখনো তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেননি। তিনি কবি, প্রকৃতিকে ভালবাসেন, কবিতায়, গল্পে, কলামে-প্রবন্ধে এ দেশের মাটি ও মানুষের কথা বলেন। এ দেশে এমন আরো অনেক কবি, প্রাবন্ধিক-কলামিস্ট ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট আছেন, তাদের সাথে ফরহাদ মজহারের মধ্যে কোথায় যেন একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেটা একদিকে তাঁর চিন্তাধারা, পোশাক-আশাকসহ লালন সাঁই ও নদিয়ার ভাববাদিধারা অনসুরণের ক্ষেত্রে অন্যদিকে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ, ইনডিজিনাস খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থাপনা ও প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ষড়যন্ত্র ও মুনাফাবাজির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের মধ্য দিয়ে তিনি বিশিষ্টতা লাভ করেছেন। ঢাকায় ফেরার পরই ডাক্তার ও মনোবিশেষজ্ঞরা তার মধ্যে একধরনের ট্রমাটিক সিন্ড্রোম লক্ষ্য করেছেন। এ কারণে পরিবারের সদস্যরা তাকে হাসাপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। ঊনসত্তুর বয়েসী ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সারাবিশ্বে লাখ লাখ বাংলা ভাষাভাষি মানুষ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। বিশেষত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মানুষের আবেগ ও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার আকারে প্রকাশ পাচ্ছিল। পাশাপাশি একটি বিপরীতমুখী মনোভাবও প্রকাশ পাচ্ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফরহাদ মজহার এক সময় বাম রাজনীতির সমর্থক ছিলেন, গত দু’এক দশকে সে চিস্তাধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। হেফাজতে ইসলামসহ কিছু ধর্মীয় সংগঠনের প্রতি তার সিম্প্যাথি ও সমর্থনের অভিযোগ করে কেউ কেউ এই চিন্তাধারা পরিবর্তনকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যাওয়া বলেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতপূর্ণ প্রায় সব ইস্যুতেই ফরহাদ মজহার পত্রিকায় কলাম লিখে, টিভি টকশোতে কথা বলে এবং ফেইসবুকে পোষ্ট লিখে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তগণমাধ্যম, মাল্টিকালচারালিজম এবং গ্লোবালাইজেশনের যুগে ফরহাদ মজহারের মত ব্যক্তিরাই পাওয়ার এলিট, আঞ্চলিক আধিপত্যবাদি ও সা¤্রাজ্যবাদি শক্তির টার্গেটে পরিনত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে যারা নিজেদেরকে সংস্কারমুক্ত, সেক্যুলার, বামপন্থী ও সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধি বলে দাবী করে থাকেন, ফরহাদ মজহার অপহৃত হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ কেন বিষয়টিকে নিয়ে রুচিহীন রগড়ে জড়িত হলেন তা’ বোধগম্য নয়। আমরা বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, অনেকেই তার লুঙ্গি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে কটাক্ষ করে ফরহাদ মজহার অপহরনের পর নিজেদের নিরবতাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন। যদিও ফরহাদ মজহার এখনো পর্যন্ত পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিজমের প্রতিই আস্থা রাখছেন বলেই প্রতিয়মান হয়। তবে সমাজতন্ত্রের প্রতি তার এই সমর্থন শর্তহীন নয়। মোটাদাগে বলতে গেলে, আমাদের দেশে প্রত্যাশিত সমাজতন্ত্রে ভাববাদ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় চিন্তাধারাকে খারিজ করতে তিনি রাজি নন। কারো কারো কাছে সম্ভবত: এটাই তার অনেক বড় অপরাধ।
ফরহাদ মজহার অপহৃত হওয়ার ২০ ঘন্টা পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মোবাইল ট্রাকিংয়ে উদ্ধার হওয়ার আটদিন অতিক্রান্ত হলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই ঘটনার মোটিফ উদ্ধার করতে পারেনি। তবে খুব শীঘ্রই ‘রহস্য’ উদঘাটন করা হবে বলে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে বলা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আমাদের স্মৃতিপটে অতীতের আরো অনেক অঘটনের চিত্র ভেসে ওঠে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী নিজ ফ্লাটে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পরও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপরাধিদের ধরা হবে বলে ঘোষনা দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য ঘটনার পাঁচবছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সে ঘটনার তদন্ত বা বিচার আলোর মুখ দেখেনি। নিহতদের সন্তান ও স্বজনরা প্রিয়জন হারানোর বিচার না পেয়ে সে প্রত্যাশা ত্যাগ করার প্রকাশ্য ঘোষনা দিয়েছেন। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সাগর-রুনি হত্যা মামলার প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ৪৯ বারের মত পিছিয়েছে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। ফরহাদ মজহার অপহরণ ও উদ্ধার হওয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য উঠে আসতে দেখা গেছে, যা’ প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার অপপ্রয়াস হিসেবে গণ্য হতে পারে। এ ব্যাপারে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী, নয়া কৃষি আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্ট ফরিদা আকতার তদন্তাধীন একটি বিষয় নিয়ে মনের মাধুরি মেশানো মন্তব্যগুলোকে অত্যন্ত দু:খজনক বলে অভিহিত করেছেন। তদন্ত রিপোর্ট বের হওয়ার আগ পর্যন্ত কারা, কেন ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করেছিল তা নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও যুক্তিপূর্ণ উভয়বিধ প্রস্তাব ও সন্দেহ উঠতেই পারে। এই সরকারের আমলে গুম-অপহরণ বেড়ে গেছে এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। গুম বা নিখোঁজ হওয়ার পর কয়েক বছর অতিক্রান্ত হলেও অনেকেই অনেকেই আর ফিরে আসেননি। কোন কোন রাজনৈতিক নেতা নিখোঁজ হওয়ার পর প্রতিপক্ষের তরফে তিনি বা তারা আত্মগোপনে যাওয়ার সন্দেহও প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। এমনকি ফরহাদ মজহার অপহরনের পরও একশ্রেনীর মানুষকে এমন সব তত্ত¡ হাজির করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। ফরহাদ মজহারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, লেখালেখি এবং প্রতিবাদি ভ’মিকার বেশীরভাগ সরকারের বিরুদ্ধে যায়, একারণেই তার অপহরণের ঘটনায় সরকারি কোন সংস্থা অথবা সরকারকে বিব্রত করতে চায় এমন কোন পক্ষ জড়িত থাকতে পারে বলে যে সব সন্দেহ প্রকাশিত হয়েছে তা’ অস্বাভাবিক নয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে ঢাকা থেকে যশোরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে সীমান্ত পার করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল প্রবল। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অপহৃত হওয়ার আগের দিন ফরহাদ মজহার একটি সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ভারতে গোরক্ষার নামে মুসলমানদের হত্যা ও মানবাধিকার হরণের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ফরহাদ মজহার অপহৃত হওয়ার পর পরিবারের কাছে ফোন করে মুক্তিপণ দাবীর সাথে সাথেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ফরহাদ মজহারের মেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর সাহায্য প্রার্থনা করেন বলে জানা যায়। গত শনিবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, ফরহাদ মজহার অপহরণের নেপথ্যে ভারতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে সন্দেহ করছে পশ্চিমা কয়েকটি দূতাবাস। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনেও ফরহাদ মজহার অপহরণের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনা কখনো আদৌ উদঘাটিত হবে কিনা তা নিয়ে একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইতিমধ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। গত সোমবার অনলাইনে প্রকাশিত এক মন্তব্য কলামে জনৈক ব্যারিষ্টার জ্যোর্তিময় বড়–য়া লিখেছেন, ‘ফরহাদ মজহারের রহস্যজনক অপহরণ বা ১৮ ঘন্টার অনুপস্থিতির সত্য কখনোই জনগনের সামনে আসবেনা। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তা হতে দেবেনা।’ ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বেøইম গেম যা’ই হোক, গুজব ও সন্দেহের অপনোদন ঘটিয়ে প্রকৃত সত্য বের করে আনা এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের।
দেশের মানুষের মানবাধিকার যখন দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থবাদের দ্বারা লঙ্ঘিত হতে থাকে। শাসক শ্রেনী, রাজনৈতিক দল এবং কর্পোরেট মিডিয়া যখন ক্ষমতা ও মুনাফাবাজির দ্বন্দে একপাক্ষিক ভ’মিকা নিয়ে জাতিকে ক্রমশ হতাশার দিকে ঠেলে দেয়, তখনো এক শ্রেনীর মানুষ সব প্রতিবন্ধকতা উৎরে নিজেদের কলম ও কণ্ঠকে উচ্চকিত রাখেন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শ্সানামলে এ দেশের অনেক বড় লেখক সাহিত্যিক রাজতোষণে ব্যস্ত থাকলেও দেশের মানুষের পক্ষে বিদ্রোহী কবি নজরুল একাই লড়াই করে জীবনের ঝুঁকি গ্রহন করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদি শাসকদের বিরুদ্ধে দেশে দেশে যে সব কবি, লেখক সাহিত্যিক রাষ্ট্রশক্তির বিপক্ষে জনচেতনায় বিপ্লব সঞ্চার করেছিলেন তাদের মধ্যে নজরুলের সমাসাময়িক তুরস্কের নাজিম হিকমত, ইতালিতে এন্তোনিও গ্রামসি, স্পেনে গার্সিয়া লোরকা এবং চিলির পাবলো নেরুদাকে শাসকশ্রেনীর রোষানলে পড়তে হয়েছে। এদের সবাইকেই শুধুমাত্র প্রকাশিত লেখার জন্য, জনমনে প্রভাব সৃষ্টির অপরাধে জেলে অথবা নির্বাসনে যেতে হয়েছে। চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থানে নির্বাচিত শাসক জেনারেল আলেন্দেকে হত্যা করার পর আলেন্দের বন্ধু নেরুদার জীবন সংশয় দেখা দেয়। সে সময় স্বৈরশাসক পিনোশের বাহিনীকে ইঙ্গিত করে পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, ‘লুক এরাউন্ড- দেয়ার ইজ অনলি ওয়ান থিং অব ডেঞ্জার ফর ইউ হেয়ার- পোয়েট্রি’। সেই প্রাচীন গ্রীক সামন্তবাদের(সক্রেটিস) যুগ থেকেই শান্তি ও সাম্যবাদি কবি, দার্শনিক ও লেখকরাই হচ্ছেন প্রবল রাজশক্তির প্রধান প্রতিপক্ষ। সময় অনেক বদলে গেছে। দেশে দেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন, মূল্যবোধ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের মত ইস্যুগুলো জনচেতনায় প্রভাব বিস্তার করছে। অতএব শাসকশ্রেনীর স্বার্থরক্ষায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অরাজনৈতিক কায়দায়, কালাকানুনের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার পাশাপাশি গণমাধ্যম এবং মুক্তচিন্তার লেখকদের নিয়ন্ত্রন করার একটি বহুমুখী এজেন্ডা সক্রিয় রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদিরা যুদ্ধবাদি পররাষ্ট্রনীতি গ্রহনের সাথে সাথে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রন ও অ্যাম্বেডেড জার্নালিজমের আশ্রয় গ্রহন করছে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্যবিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর তথ্য নিয়ন্ত্রন অনেক কঠিন হলেও কর্পোরেট মিডিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণের সুবাদে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সামরিক কমান্ডের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রনের আওতাধীন রিপোর্টগুলোই মূলধারার পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। এ কারণেই সিরিয়া, ইরাকে, আফগানিস্তান বা ইয়েমেনে আসলে কি ঘটছে তার নিরপেক্ষ তথ্য পাচ্ছেনা বিশ্ব। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন ও তথ্যের পুরো নিয়ন্ত্রণ কোন কালেই সম্ভব হয়নি। এখনো সম্ভব হচ্ছেনা। নিয়ন্ত্রনের আয়রণ কার্টেনের ভেতরেই থাকে বিদ্রোহ-বিপ্লবের বীজ। ইতালীতে ফ্যাসিবাদের কারাগারে বসে এন্তানিও গ্রামসি যে নোটবুক বা ডায়রি লিখেছিলেন, সেখানে তিনি পুঁজিবাদি বিশ্বের শাসকশ্রেনীর বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন কৌশলের ত্বাত্তিক ন্যারেটিভ তুলে ধরেছেন, যাকে তিনি ‘হেজেমনি’ বলে অভিহিত করেছেন। এখনকার মুক্তচিন্তার লেখক-সাংবাদিকরা একটি ব্যাপক ভিত্তিক কালচারাল-ইকোনমিক হেজিমনির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাওয়ার্ড জিন, এডোয়ার্ড সাইদ এই কপোর্রেট হেজিমনির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। এখনো নোয়াম চমস্কি, জন পিলজার, রবার্ট ফিস্ক, রবার্ট পেরি, আন্দ্রে ভিচেক, প্যাট্রিক ককবার্ন, এরিক মারগোলিস, ধর জামিলের মত কলম সৈনিকেরা সা¤্রাজ্যবাদের ব্যাপক প্রপাগান্ডা মেশিনারিজমের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব সীমিত পরিসরে হলেও এদের উত্তরাধিকারিরা আমাদের দেশেও আছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট মিডিয়া প্রভাব বেড়ে চলেছে। আমাদের লেখক ফরহাদ মজহারদের জীবন যখন অদৃশ্য শক্তির হাতে বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তখন মেইনস্ট্রীম মিডিয়া যাই বলুক, লাখ লাখ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দিয়ে শাসকদের শঙ্কিত করে তোলেন।
পশ্চিমা সাংবাদিকতায় অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কার মার্থা গেলহর্ন প্রাইজ ২০১৭ ঘোষিত হল ঈদের পরদিন ২৭ জুন। এবারের ১৫তম মার্থা গেলহর্ণ প্রাইজ পেলেন রবার্ট পেরি। বিচারক পেনেলের অন্যতম সদস্য জন পিলজার লন্ডনে আনুষ্ঠানিক ঘোষনাকালে যে বক্তৃতা দিয়েছেন তার প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল যার সম্মানে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছিল, সেই বিখ্যাত সাংবাদিক মার্থা গেলহর্ণের কীর্তি গাথা। ১৯০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির সেইন্ট লুইসে জন্মগ্রহনকারি লেখক-সাংবাদিক মার্থা গেলহর্ণ ১৯৯৮ সালে নব্বই বছর বয়েসে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। নব্বই বছরের সুবিশাল কর্মময় জীবনে মার্থা গেলহর্ণ সাহসী সাংবাদিকতার অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তিরিশের দশকের স্পেনিশ গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধসহ বিশ্ব ইতিহাসের অসংখ্য চাঞ্চল্যকর ঘটনার অনুৎঘাটিত রহস্য গেলহর্ণ জীবনের ঝুকি নিয়ে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। একজন মার্কিন সাংবাদিক হওয়া সত্বেও তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর নিরস্ত্র মানুষ হত্যার তথ্যাবলী ও চুলচেরা বিশ্লেষন পশ্চিমা দুনিয়ার সামনে হাজির করেছেন। এভাবেই খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধি ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছিল। তবে শুধুমাত্র মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের(এমআইসি)স্বার্থে এই যুদ্ধ প্রায় দুই দশক প্রলম্বিত করা হয়েছিল। সন্ত্রাস বিরোধি যুদ্ধের নামে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অন্তহীন যুদ্ধ সেই সা¤্রাজ্যবাদি অর্থনৈতিক এজেন্ডারই ধারাবাহিকতা মাত্র। ভিয়েতনাম যুদ্ধে সা¤্রাজ্যবাদি নৃশংসতা ফাঁস করে দেয়ার অপরাধে মার্কিন সেনাবাহিনী পরবর্তিতে দক্ষিন ভিয়েতনামে মার্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করে অবাঞ্চিত ঘোষনা করেছিল। ভিয়েতনামযুদ্ধে নিজের অভীজ্ঞতা সম্পর্কে জন পিলজার বলেন, গার্ডিয়ান এবং সেন্ট লুইস-পোষ্ট পত্রিকায় প্রকাশিত মার্থা গেলহর্নের রোমহর্ষক অনুসন্ধানী রিপোর্টগুলো সামনে মেলে ধরে তার সম্পাদক তাঁকে ভিয়েতনামে পাঠিয়েছিলেন। পিলজার স্মুতিচারণ করেন, ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ সিনিয়র যখন পানামায় সামরিক আগ্র্সান চালিয়ে প্রেসিডেন্ট নরিয়েগাকে তুলে আনার নির্দেশ দেন, এ সংবাদ শোনার পর টেলিফোনে মার্থা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেন, দাল মে কুছ কালা হ্যায় (আই স্মেল অ্যা র‌্যাট), অর্থাৎ তিনি সেখানে ব্যতিক্রমী আগ্রাসী তৎপরতার গন্ধ পাচ্ছেন। সরকার বা কর্পোরেট মিডিয়ার উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতাকে তিনি বলতেন অফিসিয়াল ড্রাইভ। মার্কিন বাহিনী পানামা আক্রমনের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ৮২ বছর বয়েসী মার্থা প্লেনে উঠে পানামা সিটির ভিকটিমদের কাছে চলে যান। সেখানে তিনি মার্কিন বাহিনীর চোখ এড়িয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরী করতে থাকেন, যে সব তথ্য সামরিক প্রেসনোট বা কোন মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছিলনা। সেখান থেকে তিনি সরাসরি পেন্টাগনে সামরিক বাহিনীর প্রেস কনফারেন্সে হাজির হয়ে জেনারেলদের প্রশ্ন করেন, কেন তোমরা পানামায় ৬ হাজারের বেশী মানুষকে হত্যা করেও মিথ্যা তথ্য দিচ্ছ? এমন প্রশ্নের কোন জবাব সামরিক জেনারেলদের কাছে ছিলনা। রবার্ট পেরি আশি র দশকের শুরুতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর কন্ট্রা-কেলেঙবকারির তথ্য ফাঁস করে দিয়ে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। জন পিলজার, রবার্ট ফিস্ক’র মত সাংবাদিকরা এখনো বেঁচে আছেন, লিখছেনও, তবে মার্থা গেলহর্ণ সামরিক বাহিনীর রক্তপিপাসু জেনারেলদের যেভাবে অপরাধের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে দিতেন, এখন অনেক বেশী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার পরও কোন জেনারেল বা শাসককে সরাসরি এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়না। কারণ মিডিয়াগুলোও এখন তারা নিয়ন্ত্রন করছে। তবে সরাসরি না হলেও বিশ্বের প্রতিটি সামরিক-বেসামরিক এট্টসিটি, আগ্রাসন এবং সাম্প্রম্রাজ্যাদি প্রপাগান্ডার পাল্টা জবাব সব প্রান্ত থেকেই দেয়া হচ্ছে। আমাদের মাঝে একজন হাওয়ার্ড জিন, মার্থা গেলহর্ন বা নোয়াম চমস্কি নেই। ক্ষমতার হালুয়া রুটি ও প্রবল শক্তির গড্ডালিকা প্রবাহের বিপরীতে দাড়ানোর সাহস যারা করেন, তাদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যুগে যুগে আমাদের তিতুমীর, কাজী নজরুল ইসলামের মত বিশালত্ব না থাকলেও ফরহাদ মজহারের মত ব্যক্তিরাই এখন আমাদের মুক্তবুদ্ধি- মুক্তচিন্তার প্রতিক হয়ে দাড়াচ্ছেন। তার সাথে আমার মতের অমিল থাকতেই পারে, আমি যদি সভ্যতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সপক্ষের কেউ হই, তবে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ না করে মুক্তচিন্তা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারের পক্ষে আমাদেরকে দাঁড়াতেই হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ