Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

যুক্তরাষ্ট্র কি একঘরে হয়ে পড়ছে?

| প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরদার সিরাজ : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হচ্ছেন উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা। সর্বোপরি চরম ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী। তার প্রধান নীতি হচ্ছে ‘সবার ওপরে আমেরিকা’। তাই তিনি ক্ষমতাসীন হয়েই বলেন- বাই আমেরিকান, হায়ার আমেরিকান। অর্থাৎ মার্কিন পণ্য কিনুন, মার্কিনিদের কাজে নিয়োগ করুন। এরপর থেকেই আমেরিকা হতে অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়ন করা শুরু হয়েছে। ছয়টি দেশের মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশেধিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু আদালত তা স্থগিত করেন। অবশ্য পরবর্তীতে তা কিছু সংশাধন করে অনুমোদন করেছেন আদালত। এর প্রতিবাদে সমগ্র আমেরিকায় প্রচন্ড বিক্ষোভ হয়েছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থায় প্রদত্ত সাহায্য-সহায়তা হ্রাস করে দিচ্ছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট আছে এমন সব সামরিক জোটের প্রতি সোজা সাফটা বলে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র আর নিজের খেয়ে অন্যের নিরাপত্তা দেখভাল করবে না। ন্যাটোর বৈঠকেও তিনি বলেছেন, সব শরীক দেশের জিডিপির ২% অর্থ প্রদান করতে হবে ন্যাটোর ব্যয় নির্বাহের জন্য। কিন্তু ২৮ সদস্যের এই জোটের বেশিরভাগ দেশের সে সামর্থ্য নেই। ফলে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে এবং ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনকে ইউরোপের দেশগুলো শত্রæ মনে করে রাশিয়ামুখী হয়েছে। ফ্রান্স এবং জার্মানি তার প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়েছে।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১২টি দেশ নিয়ে গঠিত ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি হতে যুক্তরাষ্ট্র সরে পড়েছে। ফলে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৬টি দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা আরসিইপি। এই জোটের নেতৃত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন। সংশ্লিষ্ট সব দেশ তা মেনে নিয়েছে। উল্লেখ্য, উত্তর আমেরিকা জোট তথা নাফটা থেকেও যুক্তরাষ্ট্র সরে আসতে চাচ্ছে। এমনকি দেশটি এখন মুক্ত বাণিজ্যেরও বিরোধিতা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট্র ট্রাম্প জলবায়ু সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি প্রত্যাখান করার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, এই চুক্তির কারণে অ্যামেরিকার জিডিপিতে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে এবং প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে। ন্যায্যচুক্তির জন্য তিনি বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগ্রহও প্রকাশ করেন। তার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সাথে সাথে বিশ্বময় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ২০১৫ সালে হওয়ার সময় ওবামা তখন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরেও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের গভর্নর, মেয়র ওকোম্পানি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এর মধ্যে তিনজন গভর্নর, ৩০ জন মেয়র ও ১০০টির বেশি কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া, ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতিও রয়েছেন এ দলে। হোয়াইট হাউসও এব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। অপরদিকে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এই দিনটি বৈশ্বিক স¤প্রদায়ের জন্য ব্যথিত হওয়ার দিন। প্যারিস চুক্তিতে অ্যামেরিকাসহ আরো ১৮৭টি দেশ মিলে অঙ্গীকার করেছিল যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা তারা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম রাখবে; এমনকি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি নামিয়ে আনার চেষ্টা করবে। তাই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন, জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। উপরন্তু চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই চুক্তি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছে। ভারত এবং রাশিয়াও তাতে শামিল হবে বলে জানিয়েছে। সর্বপরি জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল ঘোষণা করেছেন, জি-২০ এর শীর্ষ বৈঠকে তিনি জলবায়ু প্যারিস চুক্তি-২০১৫ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বাজেটে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের বরাদ্দ হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ডয়চে ভেলেতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের বাজেট এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমানোর প্রস্তাব করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে মিশনের এক চতুর্থাংশ খরচ বহন করে দেশটি। জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান ড্যুশারি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট কমানোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে জাতিসংঘের পক্ষে এ মানবিক কর্মকাÐ চালিয়ে নেয়া একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমাদের বর্তমান অবস্থা থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের দিকে তাকালে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, জাতিসংঘের পক্ষে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া, উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং মানবিক সহায়তা প্রদানের কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে। প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের বাৎসরিক বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। জাতিসংঘের নিয়মিত বাজেট প্রায় সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র এর পঁচিশ শতাংশ প্রদান করে। এছাড়া শান্তিরক্ষা মিশনের আলাদা বাজেটের (প্রায় আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ২৮.৫% এতদিন যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে এসেছে। কিন্তু অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া অর্থ বছরের যে বাজেট পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে পেশ করেছে, তাতে কূটনীতি এবং ত্রাণ বাজেট প্রায় উনিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, শান্তিরক্ষা মিশনের বর্তমান বাজেট থেকে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমানো হবে। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইউনিসেফ এবং ইউএনএফপি-এর বাজেট কমানোরও ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকেও সরে পড়ার চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রায় সব সংস্থা হতেই নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে সজ্ঞানে ও স্ব-ইচ্ছায়। ফলে দেশটি সমগ্র বিশ্ব হতে একঘরে হয়ে পড়ছে। আর সেটা হলে দেশটির জন্য খুব কল্যাণকর হবে বলে মনে হয় না। তাই বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করা উচিৎ আমেরিকার সব রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার। কারণ, যে সব দায়িত্ব আজ তারা দূরে ঠেলে দিচ্ছে, যাকে বলে ঘরের লক্ষী পায়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তার জন্য তাকে ভবিষ্যতে অনুশোচনায় পড়তে হতে পারে।
কতিপয় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের অভিমত, যুক্তরাষ্ট্র একে একে সব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জোট থেকে সরে পড়লে তার বিশ্বকর্তৃত্ব হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তখন বিশ্বে পুনরায় এককেন্দ্রিক পরাশক্তির পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং ফলে যা হবার তাই হবে। যেমন: গত ৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার পর তার পরাশক্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র একক পরাশক্তিতে পরিণত হয়। দেশটি ফাঁকা মাঠ পেয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে থাকে এবং তাতে করে বিশ্বের শান্তি ও উন্নতি বিঘিœত হয়। তাই বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ এর অবসান কামনা করে। যদি যুক্তরাষ্ট্র একে একে সব আন্তর্জাতিক সংস্থা হতে সরে পড়ে পরাশক্তিত্ব খুইয়ে ফেলে, তাহলে চীন-রাশিয়া একক পরাশক্তিতে পরিণত হবে। এবং তারাও যা ইচ্ছে তাই করবে। তাতে করে বিশ্বে পুনরায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়ে শান্তি ও উন্নতি ব্যাহত হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ