দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
এ, কে, এম, ফজলুর রহমান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মহান আল্লাহ জাল্লা শানুহুর ওপর ঈমান আনয়নের সঙ্গে সঙ্গে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ঈমান আনয়ন করা এবং অন্যান্য নবী ও রাসূলগণের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা একান্ত অপরিহার্য। তা না হলে ইসলামে পরিপূর্ণরূপে দাখিল হওয়া মোটেই সম্ভব হবে না। এই বিশেষত্বটি আল্লামা শিবলী নুমানী (রহ.) ও আল্লামা সুলায়মান নদভী (রহ.) অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আসুন এবার সেদিকে নজর দেয়া যাক।
রাসূলগণের ওপর ঈমান
ইসলামী আকিদা এবং বিশ্বাসের একটি চূড়ান্ত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিশ্বাসভিত্তিক কর্মকা-ের পরিপূর্ণতা প্রদান করা। আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র আবির্ভাবের পূর্বে বিশ্বের প্রতিটি সম্প্রদায়ের মাঝে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, তারা নির্দিষ্টভাবে আল্লাহপাকের প্রিয়পাত্র ও বন্ধু এবং সারা পৃথিবীর হেদায়েতের লক্ষ্যেই তাদের নির্বাচিত করা হয়েছে। তাদের ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক এই মর্যাদা থেকে সার্বিকভাবে বঞ্চিত। শুধু কেবল বঞ্চিতই নয়, বরং এই মর্যাদা লাভ করা তাদের পক্ষে সম্ভবও নয়। এ জন্যই এই পৃথিবীর সর্বত্র দেবতা ও দেবীদের আস্তানা গড়ে উঠেছিল এবং তারা মনে করত, দেবতাদের মুখের ভাষা সত্যিকার অর্থে আল্লাহরই নির্দেশ বিশেষ। তাই ব্যাবিলন, নিনুয়া, গ্রিস, ইরান, আরমেনিয়া, আর্য-ভারত এবং হিন্দুস্থানের সর্বত্র মানুষের নিজে নিজেই আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার দাবি উত্থিত হয়েছিল এবং তারা আল্লাহপাকের বার্তাবাহক পদে নিজেদের অধিষ্ঠিত বলে দাবি করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহতী শিক্ষা এই হীনমন্যতা ক্ষুদ্র ও চিন্তার বেষ্টনী ছিন্ন করে বিশ্বময় এক পবিত্র বিশ্বাসের জোয়ার- ধারা প্রবাহিত করেছে। একমাত্র তিনিই ঘোষণা করেছেন যে, দুনিয়ার সমস্ত জাতি আল্লাহপাকের দৃষ্টিতে এক সমান। আরবদের আজমিদের ওপর এবং আজমিদের আরবদের ওপর কোনোই ফজিলত নেই । একইভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের শ্বেতাঙ্গদের ওপর কোনোই শ্রেষ্ঠত্ব নেই, এমনকি শ্বেতাঙ্গদের কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর কোনোই বাড়তি মর্যাদা নেই। (মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বল)
দুনিয়ার সব ভাষা আল্লাহপাকের সৃষ্টি এবং সব জাতি আল্লাহপাকেরই মাখলুক।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এ কথাও ঘোষণা করেছেন যে, তোমরা সবাই একই পিতার (আদম আ.) সন্তান এবং তিনি ছিলেন মাটির তৈরি মানুষ। (জামে তিরমিজী : কিতাবুল মানাকেব)
অনুরূপভাবে তিনি এ শিক্ষাও প্রদান করেছেন যে, মানুষের বংশভিত্তিক পার্থক্য, রং, রূপ, ব্যাস, আঞ্চলিকতা এবং ভাষার মাধ্যমে নির্ণীত হয় না; বরং তাকওয়া এবং পুণ্য কর্মের দ্বারাই মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠত হয়।
এই শিক্ষায় সর্বপ্রথম শুভ ফল এই দাঁড়াল যে, বিভিন্ন জাতি এবং বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক ফজিলতের অতীত কাহিনী থেকে মানুষ বিমুক্ত হয়ে গেল এবং তারা এসব অসার মতাদর্শ বিস্মৃত হয়ে গেল। এতে করে দুনিয়ার সব জাতি একই পরিম-লে এসে গেল এবং মানবিক সমতা বিধানের রাস্তা সুগম হয়ে উঠল। বনী ইস্রাঈলদের দাবি ছিল এই যে, তারা আল্লাহর গোত্রভুক্ত। কিন্তু অহীয়ে মুহাম্মদী (দ.) তাদের এই দাবিকে ভ্রান্ত ও অসঙ্গতিপূর্ণ বলে ঘোষণা করল। ইরশাদ হচ্ছে : “বরং তোমরাও আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মতো মানুষ।” (সূরা মায়িদাহ : আয়াত-১৮, রুকু-৩) শুধু তাই নয়, বনী ইস্রাঈলরা এই দাবিও করত যে, নবুওত ও পয়গম্বরই তাদের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার, যে দাবি আমরা আর্য-ভারতের অধিবাসীদের মাঝেও দেখতে পাই যে, আল্লাহর মুখের ভাষা কেবলমাত্র তাদের মণি-ঋষিরাই শুনতে পেরেছে যা তাদের লিখিত পুস্তকগুলোতে পাওয়া যায়। অনুরূপ দাবি অন্যান্য ধর্মের লোকদের মাঝেও দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলাম তাদের এসব দাবি এবং অলীক কল্পনা বিলাসকে মহান আল্লাহপাকের ইনসাফ, ন্যায়বিচার, দয়া ও সাধারণ রহমতের প্রতিকূল বলে সাব্যস্ত করেছে। ইরশাদ হচ্ছে : “নবুওত হলো আল্লাহপাকের মেহেরবানী, তিনি যাকে ইচ্ছা তা প্রদান করেন এবং তিনিই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ মেহেরবানীর অধিকারী।” (সূরা জুমআ : রুকু-১) অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “বলে দিন সত্যিকার হেদায়েত হচ্ছে আল্লাহপাকেরই হেদায়েত! (ইস্রাঈলি ওলামাগণ নিজেদের ধর্মনুসারীদের কাছে বলত যে) এটাও কি সম্ভব যে, যে ধর্মীয় বিধান তোমাদের প্রদান করা হয়েছে অনুরূপ বিধান অন্যান্যদের দেয়া হবে? এই নতুন দ্বীনের অনুসারীরা আল্লাহর সামনে তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে; সুতরাং বলে দিন যে ফজিলত ও বুজুর্গী আল্লাহপাকের হাতেই নিহিত আছে। তিনি যাকে চান তাকে দান করেন এবং আল্লাহর রহমত সবার ওপর সমভাবে সম্প্রসারিত এবং তিনি স্বীয় হেকমত ও মুসলিহাত সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত। তিনি যাকে চান রহমতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। অবশ্যই তিনি শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী।” (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-৭৪, রুকু-৮) অন্যত্র আরও ঘোষণা করা হয়েছে : “কিতাবধারীদের মাঝে যারা অবিশ্বাসী এবং মুশরিকগণ এটাই চায় যে, তোমাদের ওপর তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে কোনো মঙ্গল অবতীর্ণ না হোক, অথচ আল্লাহপাক স্বীয় রহমতের দ্বারা যাকে ইচ্ছা সুনির্দিষ্ট করেন। বস্তুত আল্লাহপাক সুবিস্তৃত মর্যাদার অধিকারী।” (সূরা বাকারাহ : আয়াত-১০৫, রুকু-১৩)
ইসলামই এই শিক্ষা প্রদান করেছে যে, এ পৃথিবীর প্রতিটি আবাদি, প্রতিটি জাতি এবং প্রতিটি ভাষাভাষী লোকের প্রতি আল্লাহর মনোনীত পথপ্রদর্শক আগমন করেছেন এবং আল্লাহর বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এবং মানুষকে অজ্ঞানান্ধকারের বেড়াজাল থেকে মুক্তি প্রদান করতে বিভিন্ন পয়গম্বর ও নায়েবে পয়গম্বরগণ আগমন করেছেন। নবী ও রাসূলগণের এই পর্যায়ক্রমিক সিলসিলা রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর আবির্ভাবকাল পর্যন্ত সমভাবে জারি ছিল।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে দুনিয়ার সবক’টি জনপদ বিভিন্ন গোত্র ও সংস্থায় বিছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এদের এক অংশের কোনো রকম যোগসূত্র ও পরিচয়ের সেতুবন্ধন ছিল না। হিন্দুস্থানের মণি-ঋষিরা আর্য-ভারতের বাহিরের দুনিয়াকে আল্লাহর আওয়াজ শ্রবণকারীদের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করত না। তাদের মত অনুযায়ী, পরমেশ্বর শুধুমাত্র আর্য-ভারতের হেদায়েত ও সুপথ প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেন। অনুরূপভাবে ইরানের অগ্নি পুজারিরা সেখানকার অধিবাসীদের ছাড়া ইয়াজদান বা মঙ্গল প্রভুর আলোকজ্জ্বল শক্তিমত্তার অধিকারী আর কেউ নয় বলে বিশ্বাস করত। বনী ইস্রাঈলদের সদস্যরা নিজেদের পরিম-লে আবির্ভূত নবী এবং রাসূলগণ ছাড়া অন্য কোথাও তাদের আগমন ঘটতে পারে এমনতর ধারণা কল্পনাও করতে পারত না। আর খ্রিস্টানরা নিজেদেরকে আল্লাহর ছেলে হওয়ার উপযুক্ত বলে মনে করছিল। কিন্তু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, আল্লাহপাকের হিদায়েত এবং পথনির্দেশনা বিকাশের জন্য কোনো জাতি, কোনো দেশ এবং কোনো ভাষার বাধ্যবাধকতা নেই। আল্লাহর দৃষ্টিতে আরব ও আজম, শাম ও হিন্দুস্থান একই বরাবর। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সর্বদর্শী দৃষ্টিশক্তি ইউরোপ, উত্তর এবং দক্ষিণ প্রান্তের প্রতিটি দেশ এবং প্রতিটি জাতির সামনে আল্লাহপাকের হেদায়েতের নূরকে উদ্ভাসিত করেছে এবং সব ভাষাভাষীর সামনে তিনিই সর্বপ্রথম এই ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন যে, “প্রতিটি জাতির জন্যই রাসূল এসেছেন।” (সূরা ইউনুস : আয়াত-৪৭, রুকু-৫) অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি।” (সূরা নাহল : রুকু-৫) অন্যত্র আরও ঘোষণা করা হয়েছে : “আমি তোমার পূর্বে বহু রাসূলকে তাদের জাতির মাঝে প্রেরণ করেছিলাম।” (সূরা রূম : রুকু-৫) মহান আল্লাহপাক আরও ইরশাদ করেছেন : “প্রত্যেক কওমের জন্য একজন পথপ্রদর্শক এসেছে।” (সূরা রা’আদ : রুকু-১) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে : “এমন কোনো কওম নেই যার মাঝে একজন সতর্ককারী আগমন করেনি।” (সূরা পাতির : রুকু-৩) আল্লাহপাক এ কথাও ঘোষণা করেছেন : “আমি অতীত সম্প্রদায়গুলোর মাঝে বহু পয়গম্বর প্রেরণ করেছি, তাদের মাতৃভাষার লোকদের মাঝে যেন তারা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর নির্দেশ তাদের সমানে উপস্থাপন করতে পারে।” (সূরা ইব্রাহিম : রুকু-১) এই সর্বশেষ আয়াতের দ্বারা এ কথাও প্রতিপন্ন হয় যে, রাসূলগণ এই ঐশী শিক্ষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। একজন ইহুদির জন্য হযরত মূসা (আ.) ব্যতীত অন্য কোনো পয়গম্বরকে মান্য করা জরুরি নয়। একজন খ্রিস্টান অন্যান্য পয়গম্বরদের অস্বীকার করেও খ্রিস্টান থাকতে পারে। একজন হিন্দু সারা পৃথিবীকে ম্লেচ্ছ, শুদ্র এবং চ-াল বলে অভিহিত করেও পাকাপোক্ত হিন্দু থাকতে পারে। একজন অগ্নি উপাসক গোটা পৃথিবীকে অন্ধকারের সমুদ্র বলেও নিজেকে আলোকোজ্জ্বল ভাবতে পারে এবং তারা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবং হযরত মূসা (আ.) এবং ঈসা (আ.)-কে (নাউজুবিল্লাহ) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেও দ্বীনদারির দাবি করতে পারে। কিন্তু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এহেন মহাদর্শকে অসম্ভব বলে তিনি ঘোষণা করেছেন যে, কোনো লোক তাঁর অনুসরণের দাবিদার হয়ে তাঁর পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণকে কোনোক্রমেই অস্বীকার করতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাহাজ্জুদের নামাজে যে দোয়া পাঠ করতেন এর একটি বাক্য এই ছিল, “সকল নবীই সত্য এবং মুহাম্মদ (সা.) ও সত্য।” (সহীহ বুখারী : বাবুত্তাহাজ্জুদ)
মোটকথা, কোনো ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা.)-এর সত্যিকার অনুসারী হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে পূর্ববর্তী নবী ও রাসূল হযরত মূসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং হযরত সুলায়মান (আ.) এবং হযরত দাউদ (আ.)-এর দীক্ষা ও শিক্ষাকে সত্য বলে না জানবে। এবং কোনো ব্যক্তি ওই সময় পর্যন্ত প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সব পয়গম্বরের সত্যতা, যথার্থতা, সত্যবাদিতা এবং পবিত্রতার অঙ্গীকার ও স্বীকৃতি প্রদান না করবে। এবং এই বিশ্বাস না করবে যে, তাদের দ্বারা আল্লাহপাক আরবের মতো প্রতিটি জাতি এবং কওমকে স্বীয় হেদায়েতের আলোকে সৌভাগ্যবান করেছেন। এবং এই মতাদর্শকে এমনভাবে মেনে চলতে হবে যেভাবে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা জরুরি। কেননা, নবীগণ আল্লাহপাকের মনোনীত ও চয়নকৃত প্রতিনিধি, যারা আল্লাহর নির্দেশের বিপরীমুখী চিন্তা ও চেতনার সংস্পর্শ হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত।
আল কোরআনে এই বিশেষত্বটি এভাবে ব্যক্ত হয়েছে : “অবশ্যই যে সকল লোক আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলগণের মাঝে পার্থক্য ও প্রাচীর উপস্থাপনে তৎপর হয় এবং বলে যে, আমরা তাদের কিয়দংশকে মেনে চলব এবং কিয়দংশকে অস্বীকার করব এবং তারা এ প্রত্যাশাও পোষণ করে যে, আল্লাহ এবং রাসূলগণের মধ্যবর্তী কোনো রাস্তা আবিষ্কার করব। সত্যিকারভাবে তারাই হচ্ছে কাফির এবং কাফিরদের জন্যই আমি লজ্জাকর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছি। কিন্তু যারা আল্লাহর ওপর এবং তাঁর রাসূলগণের ওপর ঈমান এনেছে এবং রাসূলগণের মাঝে পার্থক্য নির্ণয়ে সচেষ্ট হয় না তারাই হচ্ছে ওই শ্রেণীভুক্ত লোক যাদের মজদুরী ও বিনিময় আল্লাহপাক পরিপূর্ণ প্রদান করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহপাক ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” (সূরা নিসা : রুকু-২১)
অন্য এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং ফেরেশতাদের ওপর এবং কিতাবের ওপর এবং নবীর ওপর ঈমান আনয়ন করাই হচ্ছে পুণ্য।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২২) অপর এক আয়াতে আরও ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং যে ব্যক্তি আল্লাহকে এবং তাঁর ফেরেশতাগণকে, কিতাবসমূহকে, তাঁর রাসূলগণকে এবং কিয়ামতকে অস্বীকার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তারা জঘন্যতম পথভ্রষ্টতায় নিমগ্ন হয়েছে।” (সূরা নিসা : রুকু-২০) তাছাড়া সূরা বাকারার শেষাংশে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘আমরা সবাই আল্লাহর ওপর এবং তাঁর রাসূলগণের ওপর ঈমান এনেছি, আমরা আল্লাহর রাসূলগণের মাঝে কোনো পার্থক্য করি না।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৪০) অনুরূপ নির্দেশ সূরা আলে ইমরানেও এসেছে : “আমরা তাঁদের কারও মধ্যে পার্থক্য করি না।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-৯)
স্মর্তব্য যে, পয়গম্বরদের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করার অর্থ হচ্ছে এই যে, তাদের মাঝে কাউকে মান্য করা এবং কাউকে মান্য না করা। ইসলাম এই দৃষ্টিকোণকে সার্বিকভাবে নিষিদ্ধ ও অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং সাধারণভাবে হুকুম দেয়া হয়েছে যে, দুনিয়ার সব পয়গম্বর ও রাসূলগণকে সমানভাবে আল্লাহর জন্য রাসূল হিসেবে স্বীকার করতে হবে এবং তাঁদের সততা ও সত্যবাদিতার স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।
ইহুদিরা হযরত ঈসা (আ.)-কে মিথ্যাবাদী এবং মিথ্যা নবী বলে মনে করত (নাউজুল্লিাহ) এবং তাঁর ওপর নানা ধরনের অপবাদ আরোপ করত এবং অদ্যাবধি তাদের সেই বিশ্বাস অটুট রয়েছে। ইহুদি মতবাদ এবং ইসলামের মাঝে যে যোগসূত্র আছে তা হযরত ঈসা (আ.)-এর চেয়ে বহুদূর বিস্তৃত। এ কারণে যদি ইসলামের পথে হযরত ঈসা (আ.)-এর নাম না আসে তাহলে অনেক ইহুদি মুসলমান হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। কিন্তু ইসলাম কখনো সংকীর্ণতার প্রশ্রয় দেয়নি এবং সার্বিকভাবে কোনো ইহুদির নিকট থেকে ইসলাম জোরপূর্বক হযরত ঈসা (আ.)-এর নবুওত, নিষ্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক হওয়ার স্বীকৃতি আদায় করেনি। এ জন্য ইহুদিরা হযরত ঈসা (আ.)-কে নবুওতের পরিম-লে দাখেল হওয়ার অনুমতি দিতেও সম্মত নয়। তাই দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আমলে বহুসংখ্যক ইহুদি তাঁর রিসালত ও শরিয়তের ওপর ঈমান আনয়ন করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু যেহেতু ইসলাম হযরত ঈসা (আ.)-কে নবী হিসেবে স্বীকার করে তাই এ কথা মানতে তারা প্রস্তুত ছিল না। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের বন্ধুত্বসুলভ বৃহত্তর উপকারিতা হতে দূরে অবস্থান করাকেই বরণ করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু হযরত ঈসা (আ.)-এর সত্য নবী হওয়ার পদমর্যাদাকে অবনমিত করতে রাজি হননি। (তাফসিরে ইবনে জারির : তাবারী সপ্তম খ-, ১৬৭ পৃঃ) শুধু তাই নয়, আল কোরআনে এ অবস্থাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : “হে ইহুদিরা! তোমাদের কি শত্রুতা আমাদের সাথে রয়েছে? কিন্তু এ নয় কি যে, আমরা আল্লাহপাকের ওপর ঈমান এনেছি এবং আমাদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের ওপর ঈমান এনেছি এবং আমরা পূর্ব নাজিলকৃত কিতাবসমূহের ওপরও বিশ্বাস স্থাপন করি। বস্তুত তোমাদের অধিকাংশই নির্বোধ।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-৯)
খোদ কোরাইশদের অবস্থাও এই ছিল যে, তারা হযরত ঈসা (আ.)-এর নাম শুনলেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। কিন্তু তাদের দিক থেকে হযরত ঈসা (আ.)-এর নবুওত, পবিত্রতা বরং পরিচ্ছন্নতার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়নি। কোরআনুল কারীমে এ সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে : “যখন মরিয়ম তনয়ের কথা তাদের নিকট প্রকাশ করা হয়, তোমরা বংশধরেরা চিৎকার করতে থাকে এবং বলতে থাকে যে, আমাদের উপাস্য দেবতাই উত্তম, না তোমার উপাস্য উত্তম? যে সকল নামে তারা তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়? এটা শুধু তোমার সাথে বিরোধিতা প্রকাশের জন্যেই। বস্তুত তারা খুবই ঝগড়াটে। অবশ্যই আল্লাহপাক সেই নেক বান্দার ওপর ফজিলত প্রদান করেছেন।” (সূরা যুখরূফ : রুকু-৫)
কোরাইশদের এ কথাও জানা ছিল যে, ইসলাম হযরত মরিয়ম তনয় হযরত ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহর রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করে; খোদা হিসেবে নয়। এতদসত্ত্বেও খ্রিস্টানদের মতো তারা মুসলমানদের ওপর হযরত ঈসা (আ.)-কে মান্য করার কারণে অভিযোগ আনয়ন করত। কোরআনুল কারীমের বহু আয়াতে তাদের এই নিরর্থক অভিযোগের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। ইসলামে নবী ও রাসূলদের সংখ্যার কোনো নির্দিষ্ট অংক নেই। তিবরানীর একটি দুর্বল বর্ণনানুসারে জানা যায় যে, পৃথিবীতে এক লাখ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর প্রেরিত হয়েছেন। অন্যান্য বর্ণনায় পয়গম্বরদের সংখ্যা এরচেয়ে কম উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কোরআনুল কারীমে শুধু ওই সকল আম্বিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে আরববাসী যে সকল নামের সঙ্গে পরিচিত ছিল। অথবা তাদের প্রতিবেশী ইহুদি-নাসারাদের কিতাবে যে সকল নবীর কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কোরআনুল কারীমে এমন কিছু আম্বিয়ার নাম উল্লেখ আছে যাদের সম্পর্কে কেবলমাত্র আরবরাই পরিচিত ছিল। ইহুদি এবং নাসারা এদের সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ বেখবর। যেমন হযরত হূদ (আ.) এবং হযরত শোয়ায়েব (আ.)। কোনো কোনো নবী সম্পর্কে ইহুদি ও নাসারা অবগত ছিল। কিন্তু তারা তাদেরকে নবী ও রাসূল হিসেবে স্বীকার করত না। যেমন হযরত দাউদ (আ.) এবং হযরত সুলায়মান (আ.)। কিন্তু অহীয়ে মুহাম্মদী (সা.) এদের সকলকেই নবী বলে স্বীকার করে নিয়েছে এবং একই সঙ্গে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা ও সত্যতার স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
এ প্রসঙ্গে অপর একটি দিকনির্দেশনার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা খুবই জরুরি। তা হলো এই যে, ইসলাম পূর্ব যুগে নবুওত, রিসালত এবং পয়গম্বরীর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ ও উদ্দেশ্য এমনকি সন্দেহাতীত হাকীকত পৃথিবীর সামনে পরিস্ফুট ছিল না। ইহুদিদের কাছে নবুওতের অর্থ ছিল কেবলমাত্র ভবিষ্যদ্বাণী করা এবং তারা বলে বেড়াত যে, নবী হচ্ছে ভবিষ্যদ্বক্তা মাত্র এবং তাদের সম্পর্কে এ ধারণাও পোষণ করত যে, তাদের নেক দোয়া এবং বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়। (তৌরাত : তাকবীন কা- অধ্যায় ২০-৭) এ জন্য হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত লূত (আ.), হযরত ইসহাক (আ.) , হযরত ইয়াকুব (আ.) এবং হযরত ইউসুফ (আ.)-এর নবুওত ও রিসালতের অস্পষ্ট ও আবছা অবকাঠামো তাদের নিকট অবশিষ্ট ছিল। এমনকি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পরিবর্তে সিরিয়ার কাহিনীকার মালেককে তারা পয়গম্বরের চেয়েও অধিক মর্যাদাশীল বলে মনে করত। (তাকবীন কা- : ১৪-১৮) হযরত দাউদ (আ.) এবং হযরত সুলায়মান (আ.)-এর পদমর্যাদা ছিল তাদের দৃষ্টিতে একজন রাজা-বাদশাহর অনুরূপ। সে যুগের ভবিষ্যদ্বক্তা আরও অনেক পয়গম্বরের পরিচয় পাওয়া যায়। এ কারণেই ইহুদিদের কাহিনী ও কিতাবসমূহে ইসরাইলি পয়গম্বরদের প্রতি অত্যন্ত কটূক্তি নির্দ্বিধায় করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, খ্রিস্টান সমাজেও নবুওত ও রিসালতের সার্বিক বৈশিষ্ট্যাবলী সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। অন্যথায় তারা এ কথা মোটেও উচ্চারণ করতে পরত না যে, আমাদের পূর্ববর্তী আগমনকারীগণ চোর-ডাকাত ছাড়া কিছুই ছিল না। (ইঞ্জিল)
প্রচলিত ইঞ্জিল নামক গ্রন্থগুলোতে আল্লাহর প্রশংসা পরিদৃষ্ট হয় না। এমনকি রাসূলগণের আলোচনাও সেগুলোতে নেই। এসব কিতাবে নবীগণের সততা ও সত্যবাদিতার সাক্ষ্য-প্রমাণও নেই। হযরত যাকারিয়া (আ.), হযরত ইয়াহইয়া (আ.) যাদের উল্লেখ ইঞ্জিলে আছে তারাও পয়গম্বরসুলভ মর্যাদাসহ তাদের দৃষ্টিতে পরিগণিত হতো না। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) আগমন করে মর্যাদাপূর্ণ পদমর্যাদা ও হাকিকত প্রকাশ করেছেন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্যকে তুলে ধরেছেন এবং তিনিই এই বৈশিষ্ট্যাবলী তুলে ধরেছেন এবং তাদের সবার ওপর ঈমান আনয়নকে মুক্তি নিষ্কৃতির উপায় বলে নির্ধারণ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, নবুওত এবং রিসালত হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কতিপয় মানুষকে প্রদত্ত আল্লাহর নির্ধারিত এক পদমর্যাদা। এসব মনোনীত ব্যক্তিবর্গকে এই পৃথিবীতে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে, তারা আল্লাহর নির্দেশাবলী মানুষের সামনে তুলে ধরবে এবং সততা ও পবিত্রতার পুণ্যময় রাস্তা তাদের সামনে উন্মুক্ত করবে। কেননা, তারা হচ্ছে পথপ্রদর্শক, ভীতি প্রদর্শনকারী, আল্লাহর পথে আহ্বানকারী, খোশ-খবরী দানকারী, সত্যিকারের শিক্ষার মুবাল্লেগ এবং নূর। আলাহপাক তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং নিজের বাণীসমূহ তাদের কাছে তুলে ধরতেন। এমনিভাবে নবী ও রাসূলগণ আল্লাহর নির্দেশাবলী সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করতেন। তারা ছিলেন গুনাহ থেকে মুক্ত এবং অপবিত্র কর্মকা- থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত। তারা ছিলেন আল্লাহপাকের মাকবুল ও পুণ্যশীল বান্দা এবং তারা সে আমলের সর্বোৎকৃষ্ট লোক ছিলেন। তাদের যাবতীয় কর্মকা- কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই উৎসর্গিকৃত ছিল। শুধু তাই নয়, আল্লাহপাকও তাদের প্রতি রাজি ও সন্তুষ্ট ছিলেন। অসমাপ্ত
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।