দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
হাফেজ ফজলুল হক শাহ
জনশ্রুতি আছে যে, বিশিষ্ট স্প্যানিশ নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯২ খৃষ্টাব্দে সর্বপ্রথম আমেরিকায় পৌঁছেন। তিনিই নাকি আমেরিকার আবিষ্কারক। সত্যিই কি তাই? কে সর্বপ্রথম আমেরিকা আবিষ্কার করেন? এই জটিল ও কঠিন প্রশ্নের যথার্থ উত্তর অনুসন্ধান যে করা হয়নি তা নয়। বহু পূর্বেই এর সঠিক জবাব পাওয়া গেছে, যথাযথভাবে এ জবাবের সত্যতাও প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও গবেষকগণ এই সত্যতাকে স্বীকৃতিও প্রদান করেছেন। খোদ আমেরিকায় অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দ্বারা একে যাচাই করা হয়েছে। নৃতত্ত্ব, প্রতœতত্ত্ব, প্রাক নিদর্শন, সভ্যতা চয়ন, ঐতিহাসিক তথ্য ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে পরিচালিত গবেষণাগুলোতে এ কথা দিবাকরের ন্যায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে যে, ইতালীর অধিবাসী তাঁতী তনয় ক্রিস্টোফার কলম্বাস, যিনি পাঁচ শতাব্দী পূর্বে বিখ্যাত সামুদ্রিক অভিযান চালিয়েছেন- তিনি আমেরিকার আবিষ্কারক নন। তার বহু পূর্বে আমেরিকায় মুসলমানগণ পৌঁছেন। তাছাড়া কলম্বাসের কথিত আমেরিকা আবিষ্কারের পূর্বে সেখানে রেড ইন্ডিয়ানদের বসবাস ছিল। নিঃসন্দেহে তারা ছিল সেখানকার অধিবাসী এবং তাদের মধ্যে ছিল অনেকেই মুসলমান। বস্তুত এ কথাকে সত্য প্রমাণিত করার নিমিত্তেই বক্ষমান নিবন্ধের অবতারণা।
“আল-বয়ান” ও “আল-মুসলিমুন” পত্রিকার প্রতিবেদন
আন্তর্জাতিক মুসলিম দাতা সংস্থা “আল-মুনতাদীল ইসলামী” -এর লন্ডনভিত্তিক মাসিক মুখপত্র “আল-বয়ান” (১৯৯৩ ইং, ১৪১৩ হিঃ, সংখ্যা নং- ৬৫) পত্রিকার একটি সামুদ্রিক অভিযান সম্পর্কিত প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “আমেরিকায় কলম্বাস পৌঁছার পূর্বেই সেখানে মুসলমানগণ বসবাস করতেন।” আমেরিকায় মুসলমানদের আদি উৎস এবং আমেরিকা আবিষ্কারক নাবিকদের অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে উক্ত নিবন্ধের বিদগ্ধ লেখক খালিদ আয্যাব উল্লেখ করেন, কলম্বাসের আগেই মুসলিম নাবিকদের জাহাজ আমেরিকায় পৌঁছে যাওয়ার দলিল প্রমাণিত। একই পত্রিকার ১৬নং সংখ্যায় মুহাম্মাদ আল-উবদাহ লিখেছেন, মুসলমানদের আবিষ্কৃত আমেরিকায় এক দিন নাবিক হিসেবে কলম্বাস সেখানে গিয়ে উপনীত হন। আমেরিকার আবিষ্কারক যে কলম্বাস নন এবং কলম্বাসের পূর্বেই যে মুসলমানগণ আমেরিকায় পৌঁছেছেন এ প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সৌদি অরবের জেদ্দা হতে প্রকাশিত “আল-মুসলিমুন” নামক আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক পত্রিকায় একটি তথ্যবহুল ও গবেষণালব্ধ দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটন থেকে পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক আম্মার বাকার রচিত ও প্রেরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরবচ্ছিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং বহু আনুসন্ধানের পর নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানী, প্রতœতত্ত্ব বিজ্ঞানী, গবেষক এবং ঐতিহাসিকগণ এ সিন্ধান্তে উপনিত হয়েছেন যে, অতি প্রাচীন কাল হতে আমেরিকায় অসংখ্য জাতি-গোষ্ঠীর আগমন ঘটে। সম্প্রতি সেখানে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন গবেষকগণ সহজেই খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন। মিসরীয় সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতাসহ এশীয় অনেক সভ্যতার চিহ্ন প্রতœতত্ত্ববিদগণ আবিষ্কার করেছেন। তাছাড়া মধ্যযুগে আমেরিকায় মুসলিম বিজয়ী বীরদের আবির্ভাবের প্রভূত স্থাপত্য বিদ্যমান রয়েছে।
আটলান্টিক মহাসাগরের বক্ষ ছেদন করে জেগে ওঠা আমেরিকা নামক দ্বীপপুঞ্জে একদিন তারা আল্লাহর মহিমা প্রচার ও তার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কায়েম করেছিলেন “লাইলাহা ইল্লাল্লাহ” ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা। সেখানে তারা সগৌরবে উড়িয়েছেন শাশ্বত ইসলামের সুমহান পতাকা। সে সময় আমেরিকার প্রতিটি জনপদে ঝংকৃত হত ইসলামের তাওহীদের বাণী। কিন্তু যুগের ঘূর্ণনে এমন একদিন এসেছিল যখন আমেরিকার অধিবাসীদের যোগাযোগ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা হয়ে পড়ে মুসলিম জাহান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বড়ই পরিতাপের ব্যাপার হল যে, এ বিষয়ে প্রচুর প্রতœতাত্ত্বিক সাক্ষ্য ও উজ্জ্বল নিদর্শন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাকে একটি নৃতত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসাবে আজও বিশ্ববাসীর সামনে দাঁড় করানো আদৌ সম্ভব হয়নি। এগুলো শুধু মসলিম গবেষকদের একাডেমিক কিছু উপকরণ, মুসলিম রেড ইন্ডিয়ানদের স্মৃতি কথন আর প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য। এখনও এসব তত্ত্ব ও তথ্যভিত্তিক সমন্বিত একটি থিউরী প্রতিষ্ঠার জন্য উল্লেখযোগ্য কোন গবেষক এবং সংস্থা এগিয়ে আসেনি যা বর্তমানে ইসলামী রেনেসাঁ ও পুনর্জাগরণ আন্দোলনে শক্তি, প্রাণ ও স্পন্দন যোগাতে সহায়ক হয়। আমেরিকার বিভিন্ন স্থানের আরবী নাম আমেরিকার অনেক গ্রাম, শহর, বন্দর, নগর, মহানগরের ইসলামী ও আরবী নাম রয়েছে। সেখানকার প্রাচীন ও আদি অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা সেসব নামের প্রচলন করেছে বলে অনুমান করা হয়। ইউরোপীয় এবং আমেরিকানরা সে নামগুলো আজও অপরিবর্তিত রূপে ব্যবহার করে আসছে। যেমন “তাল্লাহি হাসী” রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষায় শব্দটির অর্থ হল, “আগামীতে আল্লাহ তোমাকে দিবেন।” লেবাননের বিশিষ্ট গবেষক ও সাংবাদিক ডা. ইউসুফ মারওয়া এ যাবৎ আমেরিকার ৫৬৫টি নদী, হ্রদ, গ্রাম, নগরের ইসলামী ও আরবী নাম আনুসন্ধানে বের করেছেন। তন্মধ্যে ৪৮৪টি খোদ আমেরিকায়, আর বাকি ৮১টি কানাডায়। বস্তুত এসবের নামকরণ কলম্বাসের অভিযানের পূর্বেই হয়েছে। ইসলামী ও আরবী নামানুসারে নামকরণকৃত আমেরিকা এবং কানাডার কয়েকটি অঞ্চলের নাম নিম্নে প্রদত্ত হল, মাক্কা (আমেরিকার ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি গ্রাম), মদীনা (আমেরিকার ওহায়ূ অঙ্গরাজ্যের একটি গ্রাম), মদীন (নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে), হাযিন (নর্থ ডাকোটা অঙ্গরাজ্যে), মদীনা (টেনেসি অঙ্গরাজ্যে), মদীনা (টেকসাস অঙ্গরাজ্যে), মদীনা (উইন্টার অঙ্গরাজ্যে), মুহাম্মাত (এলিনিউ অঙ্গরাজ্যে), মিনা (ইউটা অঙ্গরাজ্যে), আরাফা (উইন্টার অঙ্গরাজ্য, কানাডায়)। এছাড়াও আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের পৃথক দুটি উপশহরের নাম “মদীনা”। তিনি অনুরূপভাবে জ্যামাইকা, বাহামা, হাইতি, ডোমিনিকা, ত্রিনিদাদ, প্রোটোরিকো, কিউবা, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও মেক্সিকো প্রভৃতি স্থানের অনেক আরবী ও ইসলামী নামের সন্ধান পেয়েছেন।
তন্মধ্যে মক্কা, ইয়া আল্লাহ, মদীনা, মিনা, আদন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার ডায়েরীতে লিখেছেন, তিনি ১৪৯২ খৃষ্টাব্দের ১২ অক্টোবরে বাহামান নামক ছোট্ট একটি দ্বীপে অবতরণ করেন, সে দ্বীপের প্রাচীন নাম “জাওয়ান হানী” পরিবর্তন করে সান সালভাদর করা হয়। ডা. মারওয়ার মতে “জাওয়ান হানী” শব্দদ্বয় ছিল স্পেনে ব্যাপক ব্যবহৃত আরবী নাম “ইখওয়ান হানী” শব্দদ্বয় ছিল পরিবর্তিত রূপ। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সম্ভবত কলম্বাসের পূর্বে সে দ্বীপটি মুসলিম স্প্যানিশরা আবিষ্কার করেছিলেন।
কলম্বাস পুত্র ফার্ডিনান্ড বলেন, তার পিতা হন্ডুরাস জনপদে কতিপয় কৃষ্ণাঙ্গ লোক দেখেছেন। যারা বর্তমানে আল-মামী গোত্রের পূর্ব পুরুষ হতে পারেন। ড. ইউসুস মারওয়া বলেন, “আল-মামী” শব্দটি আরবী “আল-ইমাম” হতে নির্গত। আমেরিকানদের ভাষায় আরবী শব্দ
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় নৃতত্ত্ব ও প্রতœতত্ত বিভাগের বিশিষ্ট মার্কিন গবেষক ড. ফীল বারী কর্তৃক রচিত “জন্মের পূর্বে আমেরিকা, আধুনিক বিশ্বের আদিবাসী” শীর্ষক গ্রন্থে আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের ব্যবহৃত অনেক আরবী শব্দের কথা উল্লেখ করেছেন যা আজও পূর্বের ন্যায় অপরিবর্তিত রূপে আমেরিকানদের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। যেমন, ওয়াতন (ভূমি), সেকায়া (পানি পান), হাসিদা (ক্ষেতের ফসল), বুনাইয়ান (জমি হতে উঁচু করা), হুয়া (সে), কাহের (জবরদস্ত), এহইয়ানী (জীবন দান), ইয়া আয়াহ (কি অশ্চর্য), ওয়ামেল (বৃষ্টি), কাওন (জগত) প্রভৃতি। বর্ণিত শব্দসমূহ আমেরিকানরা বন্ধনীতে দেয়া অর্থে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করত এবং আজও করে।
বিধায় সাপ্তাহিক আল-মুসলিমুন পত্রিকার ওয়াশিংটনস্থ প্রতিবেদক শায়েখ আম্মার বাকার এরূপ মন্তব্য করেছেন যে, উপরোল্লিখিত শব্দসমূহ পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত শব্দ, কোরআনের তাফসীর চর্চাকারী সম্প্রদায়ের ভাষা থেকেই এ শব্দগুলো আমেরিকানদের ভাষায় অনুপ্রবিষ্ট হয়।
আফ্রিকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিদগ্ধ গবেষক ড. আব্দুল আযীয বিন-আব্দুল্লাহ “মিনাল খালিজুল আরাবী ইলাল মহীতুল আতলাসী” (আরব্য উপসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পরিবেষ্টিত উপদ্বীপ পর্যন্ত) শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রবন্ধে লিখেছেন, কুরআন, হাদীস এবং ফিকহের চর্চা করতে গিয়ে মুসলমানদের অসংখ্য পরিভাষা বিভিন্ন উপদ্বীপ ও উপসাগরীয় অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত “লিসানুল আরব” পত্রিকার ৫নং সংখ্যার বরাত দিয়ে সে পরিভাষাগুলো বিধৃত করেছেন।
যথা- বায়াত (খাবারের অবশিষ্ট অংশ), আল-বুহায়রাতুন (জলাভূমি), বাররাহ (যাত্রা), বাগী ইয়াবগী (ইচ্ছা), আল-বালদাতুন (নক্ষত্রের কক্ষ পথ), আল-বালাদিয়া (পৌরসভা), বালাম ফামাহ (বন্ধ করা), আল-হাসানাহ (ক্ষুর), হুব্বা (পূর্বে), আল-খাতিমা (সমাপ্তিত কুরআন), দরবেশ (ফকির), আর-রুবআ (কুরআনের চতুর্থাংশ), রুদহা (নৃত্যশিল্পী), আল-ইয়াল (আওলাদ)। অসমাপ্ত
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।