Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বুড়িগঙ্গায় প্রাণের স্পন্দন

জেলেদের জালে ধরা পড়ছে মাছ : স্বচ্ছ পানিতে নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ

| প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : প্রাণ ফিরেছে বুড়িগঙ্গায়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই নদীর বুকে এখন টলটলে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। জেলেদের জালে ধরা পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বিকালে মানুষজন নৌকা দিয়ে বুড়িগঙ্গার বুকে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। বহুদিন পর বুড়িগঙ্গায় প্রাণের স্পন্দনে ঢাকা যেন তার ঐতিহ্য আবার ফিরে পেতে চলেছে।
একদিন বুড়িগঙ্গা ধরেই দাঁড়িয়েছিল ঢাকা। এই বুড়িগঙ্গা এক সময় শহরের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন-জীবিকার অন্যতম অবলম্বন ছিল। ছিল সারাদেশের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। দিন দিন মানুষ বেড়েছে আর কমেছে বুড়িগঙ্গার চলার ছন্দ। গত অর্ধশতকে ধুঁকে ধুঁকে যেন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা। এবার বর্ষার পানিতে টইটুম্বর বুড়িগঙ্গা বহু মানুষের প্রাণে আশার স্বপ্ন জাগিয়েছে। পরিবেশবিদদের মতে, সরকার ইচ্ছা করলেই বুড়িগঙ্গাকে স্বরুপে ফিরিয়ে আনতে পারে। সরকারের সদিচ্ছাতেই বুড়িগঙ্গার এই স্পন্দন স্থায়ী রুপ নিতে পারে। বুড়িগঙ্গায় ৩০ বছর ধরে নৌকা চালান ষাটোর্ধ জলিল মৃধা।
তিনি বলেন, গত এক যুগে যা হারিয়ে গিয়েছিল তা আবার যেন ফিরে পেয়েছি। বিশুদ্ধ পানির প্রবাহে নদীর চেহারাই পাল্টে গেছে। মানুষ নতুন করে নৌকা ভ্রমণের জন্য বুড়িগঙ্গায় আসছে। জলিল মৃধা জানান, তিনি দুই মাস আগেও তিনি ফেরী পারাপারের কাজ করেছেন। বৃড়িগঙ্গায় প্রাণ ফিরে পাওয়ার পর এখন তিনি বিকেলে সদরঘাট থেকে পাগলা পর্যন্ত নৌকা চালান। যারা নদীতে ভ্রমণ করতে আসেন তাদেরকে একবার ঘুরিয়ে আনলে তিণশ’ টাকা রোজগার হয়। এজন্য বেজায় খুশি তিনি। বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষায় নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় দূষণের পরিমাণ কমেছে। এ কারণেই এই মৌসুমে দেখা মিলছে মাছের। দেখা মিলছে ডলফিনেরও। সারা বছর দূষণমুক্ত করা গেলে নদীতে ফিরে আসবে জলজ প্রণীসহ সব প্রজাতির মাছ। জেলেরা ফিরে পাবেন তাদের জীবিকা। এ জন্য দরকার একটি সম্মিলিত উদ্যোগ।
বুড়িগঙ্গা নদীর পোস্তগোলা এলাকায় গত শনিবার মাছ ধরছিলেন বদরুল হোসেন নামে এক জেলে। তিনি বলেন, ঝোপঝাড়ের নিচেই মাছ বেশি পাওয়া যায়। গত সপ্তাহে টানা বৃষ্টির পর মাছের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিনই ছোট বড় মাছ পাচ্ছি। কয়েকজন মাঝির সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তারা জানান, সদরঘাট ও কামরাঙ্গীর চরের দিকে মাছের আমদানি বেশি। কয়েক দিন যাবত জেলেরা নৌকা দিয়েও মাছ ধরছে। কেউ কেউ সারারাত মাছ ধরে। জেলেদের জালে ধরা পড়ছে কালি বাউস, টেংরা, চাপিলা, পুটি, নলা, রুই, কাতল, বোয়াল, শিং, মাগুর, কৈ, বাইমসহ নানা প্রজাতির মাছ। ঠেলা জালে মাছ বেশি উঠছে জানিয়ে বিকাশ নামে এক জেলে বলেন, মনে হচ্ছে আমাদের দিন ফিরছে। তিনি বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে বলেন, বুড়িগঙ্গা বাঁচলে আমার মতো বহু জেলে বাঁচবে। জেলেরা জানান, সন্ধ্যা হলে এখন বুড়িগঙ্গায় জেলেদের দেখা মেলে বেশি। দুপুরের পর থেকে সবাই মানুষজনকে নিয়ে নৌকা চালায়। তাতে এক ঘণ্টায় অনায়াসে ২/৩শ’ টাকা রোজগার করা যায়। সকালেও মানুষ আসে নৌকা দিয়ে ঘুরতে। সন্ধ্যার পর মানুষ আর নৌকা দিয়ে ঘোরে না। তখন ওই নৌকা নিয়ে মাঝিরা মাছ ধরে। প্রদী নামে এক মাঝি জানান, তাদের জেলে পাড়ার বেশ কয়েকজন মাঝি সারারাত বুড়িগঙ্গার বুকে মাছ ধরে। ভোরে সেই মাছ নিয়ে তারা গাবতলী অথবা সোয়ারীঘাটের বেপারীদের কাছে বিক্রি করে। বুড়িগঙ্গায় প্রাণের স্পন্দন সম্পর্কে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, ভাই কয়েক দিন আগেও মুখে রুমাল দিয়ে নদী পার হতাম। এখন বুড়িগঙ্গাকে দেখলে আসলেই মন ভরে যায়। মতিঝিলের ব্যাংক কর্মকর্তা ফিরোজ আলম থাকেন কেরানীগঞ্জের ঝেুর বাগান এলাকায়। নৌকায় নদী পার হতে কেমন লাগে- এমন প্রশ্নের উওরে তিনি বলেন, দুমাস আগে হলে উওরটা দিতে পারতাম না। তিনি বলেন, এই নৌকাগুলো দেখছেন তার অর্ধেক এখন বিকেলে নদীতে ঘুরতে আসা লোকজন নিয়ে বেড়ায়। এখন ঘুরতে আসা মানুষের ভিড়ে নদী পারাপারের জন্য নৌকা পাওয়া যায় না। গত শনিবার বিকালে শ্যামপুর ইকোপার্কের পাশে ছোট ছোট অনেক নৌকায় করে মানুষজনদের ঘুরতে দেখা গেছে। মাঝিরা জানান, ইকোপার্ক এলাকায় ছোট নৌকায় একশ’ টাকায় অনেকক্ষণ ঘোরা যায়।
বুড়িগঙ্গা নিয়ে ঢাকার পুরান বাসিন্দাদের স্বপ্নের শেষ নেই। তারাও চান নদীটি তার স্বরুপে আবার ফিরে আসুক। বুড়িগঙ্গার মাঝেই তারা ঢাকার ঐতিহ্যকে খুঁজে পান। যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব কাজী মনিরুল ইসলাম মনু বলেন, আমরা চাই বুড়িগঙ্গাকে আগের মতো দেখতে। এই নদীকে ঘিরে কতো স্মৃতি এখনও মনে ভর করে। তিনি বলেন, মিল ফ্যাক্টরী ও ঢাকার বর্জ্য যদি বুড়িগঙ্গায় ফেলা বন্ধ করা হয় তাহলে সারাবছরই বুড়িগঙ্গার পানি টলটলে থাকবে। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য তিনি সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহবান জানান। শামপুর এলাকার নদীর পাড়ের বাসিন্দা শফিকুর রহমান বলেন, হাজারীবাগের ট্যানারী সরানোর কারনে বুড়িগঙ্গার পানি অনেকটাই বিষমুক্ত হয়েছে। অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে এখন নদীতে মাছও পাওয়া যাচ্ছে। শফিকুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, হাজারীবাগের বর্জ্য বন্ধ হলেও শ্যামপুর শিল্প এলাকার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। এটা বন্ধ করা না গেলে শীত মৌসুমে আবারও পানি বিষাক্ত হতে পারে। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমাদের আবেদন শিগগিরি যেন এ বিষয়ে একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়। বুড়িগঙ্গার পাড়ে কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম শাহীন বলেন, দূষণের বাইরেও বুড়িগঙ্গার অনেক রূপ আছে। কাশফুল, বক, মাছরাঙ্গা, পাল তোলা নৌকা, জেলে আর মাঝি। এই নদীকে ঘিরে অনেক উৎসব এখনো টিকে আছে। এগুলো মাথায় রেখে সরকারকে উদ্যেগ নিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থা বিরাজমান রাখার জন্য অন্য নদী থেকে বুড়িগঙ্গায় পানি এনে প্রবাহ বাড়াতে হবে। শিল্প ও গৃহস্থলী বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গার প্রবাহ ঠিক রাখতে সরকার নানা ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গত বছরের জুন মাসে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের’ অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশী-তুরাগ নদী পুনঃখনন করা হবে যাতে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা মহানগরীর চারপাশে বহমান নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ বজায় থাকে।



 

Show all comments
  • সাজ্জাদ ১০ জুলাই, ২০১৭, ১:৫৪ পিএম says : 0
    খবরটা শুনে খুব ভালো লাগছে।
    Total Reply(0) Reply
  • তানবীর ১০ জুলাই, ২০১৭, ১:৫৪ পিএম says : 0
    বুড়িগঙ্গাকে পুরোপুরি দুষণ মুক্ত করা হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বুড়িগঙ্গা

২২ নভেম্বর, ২০২২
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ