Inqilab Logo

সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪, ১০ আষাঢ় ১৪৩১, ১৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

দেড় যুগ পরে আগের সেই হারানো রূপে ফিরেছে বর্ষা : পড়েছে নৌকা তৈরীর ধুম

শত শত পরিবারের জীবীকার দ্বার উন্মুক্ত

| প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মহসিন রাজু , বগুড়া থেকে : প্রায় দেড় যুগ পরে আগের সেই হারানো রুপে ফিরে এসেছে বর্ষা বগুড়া তথা উত্তারাঞ্চলে। ফলে লাগাতার ভারি ও মাঝারি বর্ষণে যমুনা সহ ছোট বড় নদ নদীতে জেগেছে যৌবনের ঢেউ। নদ নদী ছাড়াও নদী সংযুক্ত খাল বিলও ভরে উঠেছে পানিতে। নীচু এলাকাগুলো বর্ষা নামার সাথে সাথেই সয়লাব পানিতে। ফলে বিস্তির্ণ এলাকা নৌকা চলাচলের উপযোগি হয়ে উঠায় নৌকা তৈরীতে ঝুঁকে পড়েছে স্থানীয় মাঝিরা। ফলে বগুড়ার বন্যা কবলিত সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ বিভিন্ন এলাকায় নতুন নৌকা তৈরীর হিড়িক পড়েছে। শত শত পরিবার এখন নতুন নৌকা তৈরীর কাজকে আয়ের উৎস হিসেবে খুজে পেয়েছে।
পুর্ব বগুড়ার বন্যাকবলিত তিন উপজেলার মধ্যে সারিয়াকান্দি উপজেলা ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ১২ টি ইউনিয়নই নদীদারা বেষ্টিত। সারিয়াকান্দি উপজেলার চার লাখ মানুষের অর্ধেকই বসবাস করে নদীর চরে। এক ইউনিয়নের সাথে আরেক ইউনিয়নের যোগাযোগ করার সহজ মাধ্যমই হল নৌকা। ইউনিয়ন ছাড়াও প্রায় অর্ধশত চরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। বর্ষা মৌসুমের পরে প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস নদী পাড়ের মানুষের আয়ের চিন্তা করতে হয় না। নদীতে নৌকা নিয়ে জাল দিয়ে মাছ ধরা, মানুষ পরাপার ও চরে উৎপাদিত ফসল পারাপার করে নৌকার মহাজন ও মাঝিদের ভালভাবে দিন চলে যায়। দেড় যুগ পরে পুরনো চেহারায় বর্ষা ফিরে আসায় যমুনা নদীর নৌপথ গুলো সরব হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে মাঝিরা এক বুক স্বপ্ন নিয়ে নৌকা তৈরী করে চলেছে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দির উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চলতি বর্ষা মৌসুমে নদী পাড়ের মানুষের মধ্যে যেন নৌকা তৈরির ধুম পড়েছে। এছাড়াও সচল করার জন্য কেউবা নৌকা মেরামত, কেউবা আলকাতরা দেয়ার পাশাপাশি গতিময় করার জন্য বিভিন্ন ইঞ্জিন স্থাপন করছেন। সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা বাজারের নিকট যমুনা পাড়ে নৌকা তুলে মেরামত করছেন কয়েকজন শ্রমিক। এছারাও মথুড়াপাড়া বাজার এলাকার লাবলু, আলমগীর বারো হাত ও চিলাকাঊরিয়া গ্রামের ইজের উদ্দিন পঁয়ত্রিশ হাত নৌকা তৈরি করেছে এবার। পুরাতন নৌকাগুলোর ভাঙ্গা অংশ তুলে ফেলে সেখানে নতুন করে বাঁশকাঠ দিয়ে মেরামত করছে। চৌদ্দ হাত থেকে ষাট হাত পর্যন্ত লম্বা নৌকা তৈরি করছেন কেউ কেউ। মোটা টিনের সীট, কাঠ, লোহা -লক্কর দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এ সব নৌকা। রকমভেদে একেকটি নৌকা তৈরি করতে সময় লাগছে তিন থেকে শুরু করে একুশ দিন পর্যন্ত। মিস্ত্রি মজুরি সহ সব মিলিয়ে খরচ পড়ছে প্রতি হাতে (১৮ইঞ্চি) কমপক্ষে বারো শত টাকা ।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা পাড়ের কুতুবপুর ইঊনিয়নের দেবডাঙ্গা গ্রামের হোতাচন্দ্র বর্মন জানান, মাছ ধরার কাজে ব্যবহারের জন্য একত্রিশ হাত নৌকা তৈরি করছেন। শ্যালো মেশিন বাদে খরচ পড়ছে প্রায় আটত্রিশ হাজার টাকা। আর শ্যালোতে খরচ পড়বে আরো পনেরো হাজার টাকার মতো। নৌকাটির আয়ুস্কাল তিন চার বছর হবে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চন্দবাইশা এলাকার মোঃ সোহেল জানান, উপজেলায় রয়েছে অনেক খাল, বিল ও নিচু এলাকা। নদীগুলোতে বছর জুড়ে কমবেশি পানি থাকলেও খাল বিলে পানি থাকে ৬/৭ মাস। খালে বিলের পানিতেই বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মাছ চাষ করেন অনেকে। আর মাছের খাদ্য দিতে পানি পথে নৌকার বিকলপ নেই। এ ছাড়াও খেয়া পারাপারে নৌকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর যমুনা নদীতে বর্ষায় পানি বৃদ্ধি পেলে এক চর থেকে অন্য চরে যাতায়াত, চর থেকে ফসলাদি কর্তনের পর তা বাড়িতে নেয়া, গবাদি পশুদের জন্য ঘাস কেটে নদী পাড়ি দিয়ে বাড়িতে আনতে নৌকার প্রয়োজন প্রতিদিন। নৌকায় চড়ে জাল দিয়ে মাছ ধরতে, নদী পাড়ের এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় সস্তায় রকমাারি পণ্য পরিবহনে নৌকার ব্যবহার বেড়ে যায়। একই এলাকার মোশারফ হোসেন জানান, কিছু পরিবার আছে যারা নদীতে সব হারিয়ে এখন প্রায় বাস্তুু হারা। তারা নৌকা তৈরী করে বর্ষা মৌসুমে নদীতেই জীবন ধারণ করে। জীবন-জীবিকার তাগিদে রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া ছাড়াও রাত যাপন সহ সকল কাজই নৌকার মধ্যে করে। নদী পাড়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবন জীবিকার জন্য নৌকা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শামীম ইসলাম নামের এক নৌকার মালিক জানান, যাদের সামর্থ্য আছে তারা নতুন নৌকা তৈরী করছে। যাদের সামর্থ্য নেই তারা পুরাতনটা মেরামত করে নদীতে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে। নৌকা তৈরীর পর নদীতে নামানোর পর থেকে কোন কোন না ভাবে আয় হয়েই থাকে। মালামাল পারাপার সহ মানুষ পরাপারেও নৌকার চাহিদা রয়েছে। প্রতিদিন একজন মাঝি ঠিক করে কাজ করলে ৪ থেকে ৫ শত টাকা আয় করে থাকে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো:মনিরুজ্জামান জানান, নদী পাড়ের সংগ্রামী মানুষেরা জমি-জমা হারিয়ে মাছ ধরা সহ জীবন জীবীকার তাগিদে বিভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছে। নতুন পেশা গ্রহন করার জন্য নৌকা তৈরি ও মেরামতে ব্যস্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরের এই সময় এসে নদী এলাকায় নতুন নতুন নৌকা তৈরী করে স্থানীয়রা। তারা নতুন নৌকা দিয়ে মাছ ধরা, মালামাল, কৃষি পণ্য, মানুষ, একা স্থান থেকে অন্য স্থানে বা অন্ত উপজেলায় চলাচল করতে নৌকাগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে। এতে করে কর্মহীন মানুষের আয়ের উৎস বাড়ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ