Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

‘ঈদ’ কেন ‘ইদ’ হবে?

| প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইখতিয়ার উদ্দিন সাগর : ‘নাড়ি’ আর ‘নারী’ বানানের অর্থ যেমন এক হয় না, আষাঢ় আর আসার বানানের অর্থ যেমন এক নয়; তেমনি ঈদ আর ইদ এক হতে পারে না। ঈদ বানান ঈদই। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। মুসলমানদের কাছে ঈদ শুধু একটি শব্দই নয়, আবেগ ও আনন্দ-ভালবাসা জড়িত। হঠাৎ মুসলমানদের এই ঐতিহ্য ও আবেগের ঈদ শব্দের বানান পরিবর্তন করার চেষ্টা চালায় ইসলাম বিদ্বেষী একটি পন্ডিত মহল। বিদেশী সাংস্কৃতির আগ্রাসনের শ্রোতে গা ভাসানো ওই বুদ্ধিজীবীদের দাবি ‘ঈদ’ নয় শব্দটির বানান হবে ‘ইদ’। প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে ‘ঈদ’ বানানকে ‘ইদ’এ রুপান্তরের প্রয়োজন পড়লো কেন? এটা কি ব্যাকারণগত কারণে নাকি তথাকথিত প্রগতিশীলতা থেকে? আধুনিকায়নের নামে ভাষার সৌন্দর্য্য, ব্যঞ্জনা নষ্ট হয়ে গেলে তা মানুষ মানবে কেন? ‘আষাঢ়’ দেখলে যা বোঝা যায় বানান পরিবর্তন করে ‘আসার’ দেখলে নিশ্চয়ই তা বুঝবে না। বাংলা ভাষাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসাকে ‘মন’ বোঝায়। এটার বানান ‘মণ’ করলে মানুষ পার্থকটা কি বুঝা যায় না? ঈদে মানুষ রাজধানী ঢাকা থেকে নাড়ি’র টানে বাড়ি যায়; নারী’র টানে নয়; এটা বুঝতে ভাষাবিজ্ঞানী বা বাংলা ভাষার পন্ডিত হতে হয় না। ঈদ বানান পরিবর্তন করে ইদ আধুনিকায়ন নয়; বরং ভাষার বিকৃতির নামান্তর।
ঈদ বানান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠে। মুসলামানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ বানান কোন ভাবেই ইদ হতে পারে না এমন মন্তব্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি চোখে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, কোনো কোনো বানান থাকে, যার পরিবর্তন হলে চোখে লাগে। কখনো কখনো আবেগে লাগে, কখনো কখনো বিশ্বাসে লাগে। তাই এমন বানান পরিবর্তন করা ঠিক না। বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে জানিয়েছে, অভিধানের দুটি বানানই ব্যবহারযোগ্য। ইদ নয়, ঈদ বানান ব্যবহারের পক্ষেই তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ও বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেছেন, ঈদ শব্দকে ইদ লেখা ভিত্তিহীন যুক্তি। এর মাধ্যমে বির্তক সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু না। ঈদ বানানে দীর্ঘ ঈ-কার ব্যবহারের পরিবর্তে হ্রস্ব ই-কার ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
ঈদ বানান যে শতভাগ সঠিক এর পক্ষে সৈয়দ মনজুরল ইসলাম তিনটি যুক্তি তুলে ধরেছেন। এক. ইসলাম ধর্ম যখন থেকে এ দেশে প্রবেশে করেছে তখন থেকেই ঈদ বানানে দীর্ঘ ঈ-কার ব্যবাহার করা হয়। তাই ঈদের বানান হ্রস্ব ই-কার হওয়ার কোনো কারণ নেই। দুই. ঈদ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ থেকে। এটি এখন বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এখন বিদেশি শব্দ হিসাবে বিবেচনা করা যাবে না। তাই ঈদ বানানই সঠিক। তিন. ঈদ লেখার সময় আরবী শব্দ আইন-দাল-ইয়া অক্ষর ব্যবহার করে ঈদ লেখা হয়। এ ক্ষেত্রে আইনে একটি দীর্ঘ টান আছে। বাংলা লেখার সময়ও ওই টান আসবে। এ জন্য ঈদ শব্দটিই সঠিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ও সদ্য নিযুক্ত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বিশ্বজিৎ ঘোষ ইনকিলাবকে বলেছেন, ঈদ শব্দটি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনো কোনো বানান থাকে, যার পরিবর্তন হলে চোখে লাগে। কখনো কখনো আবেগে লাগে, কখনো কখনো বিশ্বাসে লাগে। ঈদ বানানে যেহেতু আমরা আগে থেকেই ‘ঈ’ ব্যবহার করি। তাই আমার মনে হয় ঈদ বানান অপরিবর্তিত রাখলে অধিকাংশ বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘ-ঈ ব্যবহার করতেন। তাহলে কেন ঈদ বানান হ্রস্ব-ই দিয়ে লেখার প্রস্তাব এলো? এর ফলে সমাজে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ভাষাবিজ্ঞানী ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মনসুর মুসা বলেছেন, ঈদকে দীর্ঘ ‘ঈ’ দিয়ে আবহমানকাল থেকেই লেখা হচ্ছে। এটাই সঠিক বানান। আমি যদি কারও নাম বদলাই, তা ভুল। এতে তার প্রতি অসম্মান প্রকাশ করা হয়। ঈদ তো একটা উৎসবের নাম। নাম ও ট্রেডমার্ক ইচ্ছামতো বদলানো ঠিক নয়। এটা হলো কর্তৃত্বের প্রশ্ন। আজাদ পত্রিকা ৫০ বছর চেষ্টা করেছে ইকবালকে একবাল, ইসলামকে এসলাম লিখতে। টেকেনি। ভাষা বেশি মতাচ্ছন্নতা পছন্দ করে না।
মনসুর মুসা বলেছেন, বিদেশি ভাষার শব্দের বানানে দীর্ঘ ঈ-কার থাকবে না বলা হয়েছে। এই মাপকাঠিটা পরিত্যাজ্য। ১৯ শতক বা ১৮ শতকে ইংরেজরা বিদেশি শব্দ বলতে বোঝাত ফারসি ও ইংরেজিকে। ইংরেজরা বলেছিল, সংস্কৃত আলাদা ভাষা। আলাদা বটে, কিন্তু তা তো ইংরেজির মতো বিদেশি না। সে আমলের তিন-চারটি বিদেশি ভাষার জায়গায় এখন তো আমাদের সামনে রয়েছে বিশ্বের অনেক দেশের ভাষা। এখন সংস্কৃত-আরবি-ফারসি-ইংরেজির অনেক শব্দই বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারের নিজস্ব সম্পদ হয়ে গেছে। সুতরাং বাঙালির মুখ দিয়ে যা বের হয়, তা-ই বাংলা বলে মানতে হবে। এর মধ্যে সংস্কৃত নেই, বিদেশি বলেও কিছু নেই। তাই ঈদ বানানে কোন পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান গতকাল ইনকিলাবকে বলেছেন, ইদ নয়, ঈদ বানান ব্যবহারের পক্ষেই তিনি। তবে অভিধানের দুটি বানানকেই ব্যবহারযোগ্য বলছেন। ঈদ বাবান অনেক আগে থেকেই প্রচলিত তাই এটা ব্যবহার করাই ভালো। তবে ধ্বনির বিবেচনায় ইদও বলা যায়। দুইটির মধ্যে কোন বানান রীতি বর্তমানে ব্যবহার করা উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ঈদ বানান ব্যবহার করা হয়, আপনারাও লেখার সময় ঈদ বানান ব্যবহার করবে।
ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাসও তিনি দিয়েছেন, বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে প্রথম বানান হিসেবে ‘ঈদ’ এবং বিকল্প বানান ‘ইদ’ দেয়া আছে। প্রথম বানানটি প্রচলিত; ২য় বানানটি সংস্কারকৃত। কোনো মানুষ দীর্ঘকাল কোনো বানান ব্যবহার করলে তা ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যায়। ‘ঈদ’ বানানটি তেমনি। অতএব, দুটি বানানই ব্যবহার করা যায়।
বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’ ‘ঈদ’ শব্দটির ভুক্তি রয়েছে দু’টি। এর মধ্যে একটিতে লেখা হয়েছে ‘ঈ’ ব্যবহার করে, অন্যটি ‘ই’ ব্যবহার করে। এর মধ্যে ‘ঈদ’ কে প্রচলিত ও অসংগত বানান এবং ‘ইদ’কে সংগততর ও অপ্রচলিত বানান বলছে বাংলা একাডেমি। বানানবিধিতে বলা আছে, বিদেশি শব্দ লিখতে ‘ঈ’ বা ‘ঈ’-কারের পরিবর্তে ‘ই’ বা ‘ই’-কার লিখতে হবে। এও বলা আছে, ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর বানান পরিবর্তন করা যাবে না।



 

Show all comments
  • ৯ জুলাই, ২০১৭, ৮:১০ এএম says : 0
    যারাএটা.করতে.চাই তাদের কী খেয়েদেয়ে কোন কাজ নাই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ