Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নেছারাবাদে ঐতিহ্যের নৌকার হাট

| প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোঃ হাবিবুল্লাহ, নেছারাবাদ (পিরোজপুর) থেকে : গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহের পর প্রকৃতীতে সগৌরবে এখন চলছে ঘনঘোর বর্ষা। বর্ষার পানি নদীর দু‘কূল ছাপিয়ে এসময়ে পানিতে ভরে ওঠে রাস্তাঘাট, জমিজমা ও পুকুর খাল। তাই এসময়ে পিরোজপুর জেলার বিল ও চরাঞ্চাচলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও চলাচলে নৌকা ছাড়া যেন অনেকটাই বেহাল। তাইতো এসব এলাকার মানুষের প্রয়োজনে যুগ যুগ ধরে নেছারাবাদের আটঘরে চলে আসছে নৌকারহাট। বাংলা জৈষ্ঠ্যর মাজামাঝি থেকে ভাদ্রর শেষ সময় পর্যন্ত সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার আটঘরের বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় জলে ও কূলে বসে এ নয়নাভিরাম নৌকারহাট। রেইনট্রি, মেহগীনি ও কড়াই কাঠের তৈরী হাটে আসা নৌকাগুলো এলাকার প্রায় আধা কিলোমটির জায়গা জুড়ে খালের জলে ও কূলে বিস্তৃতি ঘটে।
সরেজমিনে গতকাল শুক্রবার নৌকারহাট ঘুরে মনে হল, যেন এক নৌ সামরাজ্য। যে দিকেই দু‘চোখ যায় কেবল নৌকা আর নৌকা। আধুনিক সভ্যতায় যান্ত্রিক নানান ইঞ্জিন চালিত বোর্ডের রাজত্ব থাকলেও; এখানকার মানুষের কাছে নৌকার কদর শত শত বছর ধরে। গাছ থেকে পেয়ারা সংগ্রহ, কৃষি কাজ পরিচর্চা, গো খাদ্য সংগ্রহ, ভাসমান সবজির বাজারে বিকিকিনিসহ যাবতীয় কাজে নৌকাই এখানকার মানুষের প্রধান ভরসাকে কেন্দ্র করে আটঘরে চলে আসছে এ বিখ্যাত নৌকারহাট। চলতি আষাঢ়ের একধারে খড়া আর অন্যদিকে ঝড়া বর্ষার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্রেতা,বিক্রেতা আর নৌহাট দেখার উৎসুখ মানুষের সমাগমে এসময়ে দেখা মেলে নৌকা বিকিকিনির এ মিলনমেলা।
কথা হয় ইলুহার গ্রামের নৌকা বিক্রেতা মোঃ মনির হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, বর্ষাকালে গোখাদ্য সংগ্রহ, পেয়ারা পারাসহ ভাসমান সবজির বাজারে ব্যাবসার কাজে এখানকার মানুষের কাছে নৌকার কদর অনেক। তবে, সাধারনত আটঘর কুড়িয়ানা ও ঝালকাঠি অঞ্চলের মানুষেরা গাছ থেকে পেয়ারা সংগ্রহের কাজেই বেশি নৌকা কিনে থাকেন। এ বর্ষা মৌসুমে এ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়িসহ জলাবাড়ি, সোহাগদল, বলদিয়া, গুয়ারেখা ও সিমান্তবর্তী ঝালকাঠি জেলার প্রতিহাটে কয়েকশতাধিক লোক আসে নৌকা ক্রয়ের জন্য। মনির জানায়, আজকের হাটে সে বিক্রির জন্য ২৭টি নৌকা নিয়ে এসেছে। আকার ও কাঠের প্রকারভেদে একেক নৌকার একেক রকমের দাম রয়েছে। মনির আরো বলে, সে গ্রাম থেকে ঘুরে ঘুরে নৌকা কিনে প্রতি হাটে একসাথে ২০-৩০টি নৌকা নিয়ে আসে। হাটে চাম্বলের নৌকা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। একটি আটহাতি চাম্বল কাঠের তৈরী নৌকা তিনি বিক্রি করেন দু‘হাজার থেকে ২২শ টাকায়। এতে তিনি খরচপাতি পুষিয়ে মোটামুটি লাভের মুখ দেখছেন।
হাট দেখা যায় ওই এলাকার বিদ্যালয় সংলগ্ন খালে ও জলে বিক্রেতারা সারি সারি নৌকা সাজিয়ে সমানতালে বিক্রি করে চলছেন। আর বরিশাল বিভাগের বিল ও চরাঞ্চলের বিভিন্ন মানুষেরা হাটে এসে প্রয়োজন অনুযায়ি একসাথে তিন থেকে চারটি নৌকা কিনে নসিমন ও ট্রলারযোগে নিয়ে যাচ্ছেন গন্ত্যব্যে। বিক্রেতারা নৌকার একটু বেশি দাম হাকালেই ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে নৌকার সঠিক দামদর যাচাই করে পছন্দের নৌকাটি কিনে নিচ্ছেন।
উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের নৌকা কারিগর মো. আজমল হোসেন জানান, পনের বছর ধরে তিনি এহাটে নৌকা বিক্রি করতে আসেন। আজকের হাটে সে ১৫টি নৌকা নিয়ে এসেছে। বেঁচাবিক্রি ভাল। তিনি জানান, একটি ১২ হাতি নৌকা তৈরীতে একজনের সময় লাগে ৩/৪দিন। যাহার মজুরি ও কাঠপাঠ মিলিয়ে খরচ পড়ে ২৫শ থেকে ৩ হাজার টাকা। হাটে সেই নৌকাটি তার বিক্রি হয় ৩ হাজার ৭শ থেকে ৪ হাজার টাকায়। হাটে সাধারনত আট হাত ও দশহাতি নৌকার বেশি চাহিদা। নৌকা ব্যবসায়ি ও হাটের স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌনসুমের এই নৌকার হাটে পিরোজপুর,বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলার ভিবিন্ন পেশার লোকেরা আসে। তারা একসাথে কয়েকটি নৌকা কিনে কেহ নৌকার উপর নৌকা; আবার, কেউ কেউ নসিমন ও ট্রলারে ক্রয়কৃত নৌকাগুলো একসাথে সাজিয়ে নিয়ে যান দূর-দূরান্তে। নৌকা বিক্রির সময় সাথে বৈঠা না দেয়ায় নৌকার হাটের সাথেই রাস্তার উপরে বসে বৈঠার দোকান। বিলাতি গাভ, মেহগীনি ও আমইর কাঠ দিয়ে বানানো হয় বৈঠাগুলো। হাটে বিলাতিগাভ ও আমইর কাঠের বৈঠার চাহিদা বেশি। বলদিয়া ইউনিয়নের চামী গ্রামের বৈঠা বিক্রেতা মো. মহাসিন জানান, হাটে সে ১০৭টি বৈঠা নিয়ে এসেছে। বেঁচা-বিক্রি মুটামুটি ভাল। তবে নৌকারমত বেশি বৈঠা বিক্রি হয়না। কারন, একটি আমইরকাঠ ও বিলাতি গাভের বৈঠা অনেক বছর সময় দেয়।
হাটের ইজারাদার মোঃ মোস্তফা কামাল বলেন, প্রতিহাটে ৯০০-১০০০খানা নৌকা ওঠে। হাটে ভিবিন্ন আকারের ৬০০-৭০০খানা নৌকা বিক্রি হয়। হাটে একশ টাকায় দশ টাকা খাজনা নেয়া হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ