Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মামলার খরচে নিঃস্ব

পারিবারিক আদালতে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা

| প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

৬০ হাজারের বেশি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় : পৃথক আদালত স্থাপনের দাবি আইনজ্ঞদের
মালেক মল্লিক : শামীমা খাতুন (ছদ্মনাম)। বিয়ে বিচ্ছেদের পর ২০১৩ সালে দেনমোহর ও ভরন পোষণের টাকা চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। দেনমোহর ও ভরন পোষণ বাবদ দুই লাখ টাকা দাবি করেন। বর্তমান ঢাকায় ১২তম পারিবারিক আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। এ মামলাটির নোটিশ জারি করতে লেগেছে ২০ মাসের বেশি সময়। নোটিশ জারি হলেও আসামী হাজির হননি। এ পর্যন্ত মামলা চালিয়ে আসতে বাদির খরচ হয়েছে ৫০ হাজারের মতো। চূড়ান্ত পর্যায় যেতে দুই লাখের মতো খরচ হবে। এরপর ফলাফল কি হবে তা কেউ বলতে পারে না। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে শামীমার মতো অনেকেই জমি-জমা বিক্রি করে নি:স্ব হয়েছেন। তার উপর নানা ভোগান্তিও তো আছেই। বছরের পর বছর আদালতে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। প্রতিকার চাইতে গিয়ে উল্টো ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকাসহ সারাদেশে পারিবারিক আদালতে ৬০ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের একটি প্রতিবেদনেও পারিবারিক আদালতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির বিষয়টি উঠে এসেছে।
আইনজ্ঞনা জানিয়েছেন, দেওয়ানি মামলার চাপে পারিবারিক আদালতের মামলার প্রতি বিচারকরা আলাদা দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ কমই পান। এতে করে বিচারপ্রার্থীদের মামলা পরিচালনার ব্যয়ও বাড়ছে। দুর্ভোগের কমাতে পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপনে করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এই সব বিরোধগুলো বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইন মন্ত্রী ব্যরিস্টার শফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধগুলো নিস্পত্তি করলে উভয় পক্ষের জন্য কল্যাণকর। কারণ এক্ষেত্রে বাদি ও বিবাদি কাউকে টাকা পয়সা খরচ করতে হবে না। তিনি আরো বলেন, এখন কিন্তু আমেরিকাসহ উন্নত দেশেগুলোতে এই পদ্ধতিতে ছোট খাটো অনেক অপরাধগুলোর নিষ্পত্তি করছে। বিশেষ করে পারিবারিক বিরোধ। পৃথক আদালত গঠন করলেও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে। তবে এটার সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। সময়ের প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য এলাকায় পারিবারিক আদালত নেই। তারা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ওই সব মামলার নিষ্পত্তি করছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশের সাতটি বিভাগে বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, মোহরানা, ভরণপোষণ ও সন্তান-সন্ততিদের অভিভাবকত্ব ও তত্ত¡াবধান সম্পর্কিত ৬০ হাজার ৭৭৬টি পারিবারিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১৭ হাজার ১৩৬টি, চট্টগ্রামে ৯ হাজার ১১৯টি, রাজশাহীতে ৯ হাজার ৫৭টি, খুলনায় ১০ হাজার ৫৫টি, বরিশালে ৩ হাজার ৩০৭টি, সিলেটে ২ হাজার ১৭৮টি এবং রংপুরে ৬ হাজার ৬২১টি মামলা রয়েছে। এছাড়া বিচারাধীন পারিবারিক আপিলের সংখ্যা ৩ হাজার ৩০৩টি। সুলতানা নামের একজন বিচারপ্রার্থীরা জানালেন, কি আর করব; মামলা চালাতে আমি এখন নি:স্ব। গরীব মানুষ; সামান্য এক খন্ড জমি ছিল মামলার নানা খরচ চালাতে সেটাও বিক্রি করছি। করে রায় পাবো জানি না।
এসব মামলা নিষ্পত্তি করে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে পৃথক পারিবারিক আদালত স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিচারকরা। পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এর অধীনে দায়েরকৃত মামলা নিষ্পত্তি সমস্যা ও সমাধানের উপায় শীর্ষক কর্মশালায় এ পরামর্শ দেন তারা। গত এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট একটি কর্মশালার আয়োজন করে। এতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি অংশনেন।
বক্তারা পারিবারিক আদালত সম্পর্কিত আইনের কিছু বিষয়ের অস্পষ্টতা তুলে ধরেন। বিশেষ করে কোর্ট ফির পরিমাণ, মামলার মুলতবি প্রক্রিয়া এবং মুলতবি খরচের ক্ষেত্রে কী ধরনের বিধান অনুসরণ করা হবে, আর্জি সংশোধনে কোন বিধান অনুসরণ করতে হবে, পর্দানসিন মহিলা ছাড়া অন্য কেউ আমমোক্তারনামা মূলে মামলায় প্রতিদ্বদ্বিতা করতে পারবে কি না, মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, মধ্যস্থতা নিয়োগের ক্ষেত্রে আদালতের ক্ষমতা কতখানি, কোনো মামলার একপক্ষ যদি যুগ্ম জেলা জজ আদালতে নিকাহনামা বাতিলের মামলা করে তখন পারিবারিক আদালতের বিচারকের করণীয় কী, বিবাদী বিদেশে বসবাস করলে ডিক্রি জারির ক্ষেত্রে সমস্যা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অপ্রতুলতা এবং স্বতন্ত্র পারিবারিক আদালত না থাকা।
ওই প্রতিবেদন বলা হয়, দ্রæত বিচার নিষ্পত্তি করতে মামলার বিভিন্ন ধাপে উল্লেখিত সময়সীমা কঠোরভাবে অনুসরণ, সাক্ষী বা দলিল উপস্থাপনে ব্যর্থ হলে জরিমানা বৃদ্ধি, আপিল নিষ্পত্তির সময় বেঁধে দিয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্ত, জেলা লিগ্যাল এইড অফিস এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, এনজিওর সমন্বয়ে পারিবারিক মামলাসমূহের মনিটরিং সেল গঠন, লিগ্যাল এইড অফিসে পারিবারিক মামলার বাদী-বিবাদীদের জন্য কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা করা দরকার।
এতে বলা হয়েছে, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে পারিবারিক আদালতে বিচারপ্রর্থী দরিদ্র নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নানা ভোগান্তির শিকার হন।যেমন, সময়মত দেনমোহর ও ভরণপোষণের টাকা না পাওয়া, মামলার প্রত্যেক তারিখে আইনজীবীর ‘ফি’সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ প্রদান এবং আদালতে হাজিরা দেয়া ইত্যাদি। এছাড়া আদালতের শরণাপন্ন হওয়া নারীদেরকে সামাজিকভাবে অপবাদ দেয়া, পুলিশ, কোর্ট স্টাফ ও আইনজীবী সহকারীর দ্বারা হয়রানির শিকার, স্বামী বা তার আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক হুমকি দেয়ার বিষয়টিও রয়েছে। এসব ভোগান্তি ও বাধা দূর করে নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণ আদায়ে সহায়তা করতে পারিবারিক সহায়তা সেল গঠন করা যেতে পারে। কর্মশালায় পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ-১৯৮৫ সংশোধনসহ ৩২ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। সুপারিশে আরও বলা হয়, দেওয়ানি কার্যবিধির মতো এই আইনেও বিনা তদবিরে খারিজের অথবা একতরফা সূত্রে ডিক্রির আদেশ সরাসরি রদ করার বিধান সংযোজন করা প্রয়োজন। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ৬-৮ ধারায় আদালতে ডিক্রিকৃত অর্থ জমাদানের বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মামলা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ