Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ বাড়ছে

সক্রিয় চোরাচালানি সিন্ডিকেট

| প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম


রফিকুল ইসলাম সেলিম : বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে অপরাধীদের হাতে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ বাড়ছে। সক্রিয় হয়ে উঠেছে অস্ত্র চোরাচালানি সিন্ডিকেট। পিস্তল, রিভলবারের মতো ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি সীমান্ত হয়ে আসছে ভারী যুদ্ধাস্ত্র। দেশে তৈরী অস্ত্রের চাহিদাও বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক দলের ক্যাডার মাস্তান আর এলাকা ভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোও তাদের অস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে শুরু করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে নানা মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। জানা যায়, সম্ভাব্য এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। পাতাল জগতের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতেও চলছে নানা প্রস্তুতি। আর এতে করে অস্ত্রের চাহিদাও বাড়ছে।
অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং আনাগোনা বাড়ছে। এই কারণে বিশেষ কোন অভিযান ছাড়াই র‌্যাব-পুলিশের নিয়মিত অভিযানে প্রতিনিয়ত অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদ ধরা পড়ছে। তবে অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার হলেও এর সাথে জড়িত রাঘব-বোয়ালরা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। র‌্যাবের অভিযানে মঙ্গলবার রাতে বন্দরনগরীর পাঁচলাইশের একটি বাসা থেকে গ্রেফতার হয় নৌ-দস্যু সর্দার কালাম বাহিনীর প্রধান কালাম। তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৮টি আগ্নেয়াস্ত্র বিপুল সংখ্যক গুলি, রকেট প্লেয়ার।
ভোলার বাসিন্দা কালাম চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। এসময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৮টি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল সংখ্যক গুলি, ইয়াবা ও ইয়াবা বিক্রির ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব জানায় তার বাহিনীর সদস্যদের কাছে আরও বিপুল সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। ১১ মামলার আসামী হলেও কালাম আগে কখনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়েনি। র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর ওই দস্যু সর্দার তার বাহিনীর অন্যান্য সদস্য ও তাদের অস্ত্রভান্ডার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলে জানান র‌্যাবের এক কর্মকতা।
গত ২১ জুন কক্সবাজারের মহেশখালীতে দেশীয় তৈরি ২২টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২২ রাউন্ড গুলি এবং অস্ত্র তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করে র‌্যাব। অভিযানে অস্ত্র তৈরির সঙ্গে জড়িত দুইজনকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা ২২টি অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে, ১৪টি এক নলা বন্দুক, ৬টি ওয়ান শুট্যারগান, একটি থ্রি কোয়ার্টার বন্দুক ও ১ টি দেশীয় রাইফেল। এছাড়াও ২২ রাউন্ড গুলি, ড্রিল মেশিন, বন্দুকের পাইপ, এয়ার মেশিনসহ অস্ত্র তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব জানায়, এসব অস্ত্র ডাকাত, রোহিঙ্গা ও নৌদস্যুদের কাছে বিক্রি করা হতো। পেশাদার অপরাধীরাও এসব অস্ত্রের বড় ক্রেতা। এর আগেও অস্ত্র তৈরীর কারিগর আবদুল মাবুদ আটক হয়ে কারাগারে ছিলেন। স¤প্রতি কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও তিনি একই কাজে লিপ্ত হন।
ওই অভিযানের পরদিন কক্সবাজারের কুতুবদিয়া থেকে ১৯টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ স্থানীয় শ্রমিক লীগের এক নেতাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের পরান সিকদারপাড়ার একটি বাড়ি থেকে মনোয়ারুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি কক্সবাজার জেলা শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এ সময় তার বাড়ি থেকে ৬২১টি গুলি উদ্ধার করা হয়। ৬ মামলার আসামী এই শ্রমিক লীগ নেতার বাড়ি থেকে উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ১৩টি ওয়ান শুটারগান ও ৬টি এসবিবিএল।
মাত্র পনের দিনের মধ্যে তিনটি অভিযানে ৪৯টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। পুলিশের অভিযানেও নিয়মিত অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। মে মাস পর্যন্ত চলতি বছরের ৫ মাসে নগরীতে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় ৭১টি মামলা হয়েছে। গতবছর মহানগরীর ১৬টি থানায় শতাধিক অস্ত্র উদ্ধার হয়। যার ৬টিই একে-২২ রাইফেল। আর জেলার ১৪টি উপজেলায় উদ্ধার হয়েছে ৮২ টি অস্ত্র। এর মধ্যে একে-২২ চারটি।
জানা গেছে দিন যত যাচ্ছে, ততই সন্ত্রাসীদের গ্রæপ বাড়ছে। এসব অপরাধী চক্র সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ীদের। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুনসহ নানা অপরাধে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। সিএমপির একজন দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, অবৈধ অস্ত্রের চালান ঠেকাতে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। নগরীরর প্রতিটি প্রবেশপথে চেকপোস্টে নিয়মিত তল্লাশি চলছে। সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোর উপরও নজরদারী অব্যাহত আছে। এরপরও কিছু আগ্নেয়াস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে আসছে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে তথ্য আছে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে এবং নিজেদের প্রভাব বাড়াতে অপরাধী সিন্ডিকেটগুলো অস্ত্র সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি নিজেদের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্যও অস্ত্র সংগ্রহ করছে তারা। তবে অস্ত্র ব্যবহারের চেষ্টা করলে সেটা পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে। কাজেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নেই।
জঙ্গিদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারী অস্ত্র ধরা পড়েছে। গত তিন বছরে জেএমবি, শহীদ হামজা ব্রিগেডসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি একে-২২ রাইফেলসহ ২৫টি অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করেছে র‌্যাব। এসব ভারী অস্ত্র সীমান্ত পথে চট্টগ্রাম এসেছে। নগরীর সদরঘাটে জেএমবি সদস্যরা ৫ লাখ টাকা ছিনতাই করতে গিয়ে নিজেদের বোমায় ২ জন মারা যায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় তাদের ফেলে যাওয়া ২টি একে-২২ রাইফেল। বিগত ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর আজিমপাড়া লালমিয়া কন্ট্রাক্টর সড়কের হাজি নূর আহমদ টাওয়ার এলাকায় জেএমবির আস্তানার সন্ধান পায় গোয়েন্দা পুলিশ। ওই আস্তানা থেকে গ্রেনেড, বোমা ও অস্ত্রসহ জেএমবির পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। ওই আস্তানার নেতৃত্বে ছিল ফারদিন নামে শীর্ষ এক জঙ্গি নেতা। পার্বত্য একটি জেলা থেকে সে-ই একে-২২ রাইফেল দুটি নগরীতে নিয়ে আসে এবং সদরঘাটের ছিনতাইয়ে ব্যবহার করে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়। হাটহাজারী একটি আস্তানা থেকেও উদ্ধার হয় আমেরিকান ¯œাইপার রাইফেল।
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়ও অস্ত্রের মজুদ গড়ে উঠার তথ্য মিলেছে। রাজনৈতিক দলের ক্যাডার গ্রুপগুলো অস্ত্র ছাড়া নিরাপদ ভাবতে পারছেনা নিজেদের। অপরাধের নানা ঘাটসহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও ভাগ ভাটোয়ারাকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে এসব গ্রুপ। এ কারণে এক গ্রুপ সহজেই জেনে যাচ্ছে অন্য গ্রুপের অস্ত্রের সংখ্যা। তাই মজুদ করতে মরিয়া প্রত্যেক গ্রুপ। মহানগরীতে এসব গ্রুপের ক্যাডারা নিয়মিতই সংঘাত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। ব্যবহার করছে আগ্নেয়াস্ত্র। রাজনৈতিক দলের ক্যাডারা বৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রও নিজেদের দখলে রাখছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চারপাশে পাহাড় সাগর বেষ্টিত হওয়ায় বৃহত্তর চট্টগ্রামে সহজে অস্ত্র আসতে পারছে। অস্ত্র চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাই বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলকে তাদের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের বান্দরবান সংলগ্ন বিভিন্ন স্পট হয়ে অস্ত্র চোরাকারবারীদের তৎপরতা বেড়েছে। বিভিন্ন সময়ে ওই এলাকায় ভারী অস্ত্রের অনেক চালান ধরা পড়েছে। সীমান্ত গলে অরক্ষিত অঞ্চল দিয়ে এসব অস্ত্রের চালান পৌঁছে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে। পাহাড়ি বা চরমপন্থী কিছু সংগঠন অর্থাভাবে অস্ত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। অপরাধীরা তা কিনে নিচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ