Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান

জাহাজ ভাঙা ও রি-রোলিং মিলস শিল্পে চরম দুঃসময়

| প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সৌমিত্র চক্রবর্তী, সীতাকুন্ড থেকে : সীতাকুন্ডে গড়ে উঠা দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙা শিল্প ও চট্টগ্রামের রি-রোলিং মিলসগুলোতে ঘোর দুর্দিন চলছে। স্ক্র্যাপ জাহাজের উপর বারবার শুল্কারোপ, বিদেশ থেকে রড তৈরী সস্তা-মানহীন কাঁচামাল আমদানি ও সর্বপরি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বারবার লোহার দর উঠা নামার কারণে এ দুটি শিল্পে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছেন শিল্প উদ্দ্যোক্তারা। এতে গত ৩ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধ শতাধিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ড ও ৬০ শতাংশ রি-রোলিং মিলস। ফলে বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সীতাকুন্ডে জাহাজ ভাঙা শিল্পের গোড়াপত্তন হয় ৬০ এর দশকে। প্রথম জাহাজটি ভাঙা হয় ফৌজদারহাট এলাকায়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে শিপব্রেকিং শিল্পের বিকাশ ঘটে। বিগত অর্ধ শতাব্দীতে এটি ছড়িয়ে পড়ে কুমিরা-বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত অন্তত ২৫ কি.মি. এলাকায়। শুরু থেকে এ শিল্পটি লাভজনক হয়ে প্রসার লাভ করে দেশের নির্মাণ শিল্পে ব্যাপক অবদান রাখলেও বহু চড়াই উৎরাই পেরোনো শিল্পটির চরম দুঃসময় শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। এসময়ে আর্ন্তজাতিক বাজার ও স্থানীয় লোহার বাজারে বারবার দর উঠা নামায় দিশেহারা হয়ে পড়েন শিপব্রেকিং ও রি-রোলিং মিলস মালিকরা। জাহাজ কিনে কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে থাকেন শিল্প উদ্দ্যোক্তারা। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে শুধু একজন শিপইয়ার্ড ব্যবসায়ী সর্বোচ্চ ২‘শ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান দিয়েছেন। এছাড়া ১০/২০ কোটি থেকে ৫০/৬০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছেন এমন মালিকও বহু। এতে ঋণে জর্জরিত হয়ে অর্ধ শতাধিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ড বন্ধ। যার মারাতœক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রি-রোলিং মিলস শিল্পেও। কারণ, রি-রোলিং মিলস গুলোতে রড তৈরী অন্যতম কাঁচামাল হলো শিপব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে পাওয়া স্ক্র্যাপ জাহাজ। এ কারণে জাহাজের দাম উঠা নামা ও লোকসানের প্রভাবে বন্ধ হতে থাকে রি-রোলিং মিলসগুলোও। কয়েক বছর ৬০ শতাংশ রি-রোলিং মিলস বন্ধ হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। শিপব্রেকিং শিল্পের দুরাবস্তার কারণ জানাতে গিয়ে এক প্রবীন শিল্প উদ্দ্যোক্তা বাংলাদেশ শিপব্রেকিং এন্ড রি-সাইক্লিং এসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি মোঃ কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০১৪ সালে চীন তাদের উৎপাদিত নিন্ম মানের প্রচুর বিলেট (রড তৈরীর কাঁচামাল) প্রতি টন ৬’শ ডলারের পরিবর্তে মাত্র ২৪০ ডলারে বিক্রি করতে থাকে। এ সুযোগে কিছু আমদানিকারক প্রচুর পরিমান চায়না বিলেট আমদানি করে। এতে দেশের রি-রোলিং মিলসগুলোতে স্ক্র্যাপ জাহাজের প্লেট বা অন্য লোহার চাহিদা কমে যায়। তখন স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম প্রতি টন ৫২০ ডলারের পরিবর্তে হটাৎ কমে গিয়ে ২৩০ ডলারে নেমে আসে। এতে টন প্রতি ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান হতে থাকে জাহাজ আমদানি কারকদের। শিল্পপতি মোঃ কামাল উদ্দিন আরো বলেন, এখানে যেসব স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয় সেগুলোর বেশিরভাগই ওজন ১০ হাজার টনের উপরে। এমনকি ৬০ হাজার টনের জাহাজও আনা হয়েছে। মন্দার সময় টন প্রতি ১০ হাজার টাকা লোকসান হলে ১০ হাজার টন কিংবা তার চেয়েও বড় জাহাজগুলোতে বিশাল অংকের লোকসান হয়েছে। বাংলাদেশ শিপব্রেকিং এন্ড রি-সাইক্লিং এসোসিয়েশনের কার্য নির্বাহী সদস্য মোঃ লোকমান বলেন, দেশের উন্নয়ন কাজে প্রতিবছর ৪৪ লাখ টনের মত লোহার প্রয়োজন হয়। যার ৭০ শতাংশই আমরা (জাহাজ ভাঙা শিল্প) যোগান দিই।
গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালেও ৩৪লাখ ৮৩ হাজার টন লোহার যোগান দিয়েছি। এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট রি-রোলিং মিলস, লোহার সরঞ্জামের দোকানসহ নানা খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোটি মানুষ নির্ভরশীল। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে বিদেশ থেকে রডের কাঁচামাল আমদানি, স্ক্র্যাপ জাহাজের উপর শুল্ক বৃদ্ধি, সাপটা চুক্তির কারণে ভারত থেকে নিন্মমানের বিলেট আনাসহ নানান কারণে জাহাজ ভাঙা ও রি-রোলিং মিলস শিল্প ধংসের মুখে পড়েছে। ১৫১টি ইয়ার্ডের লাইসেন্স থাকলেও বর্তমানে চালু আছে ৩০জন শিল্পপতির মালিকানাধীন ৫০টি ইয়ার্ড। ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় অনেকেই আর জাহাজ আনতে পারছেন না। এ কয়েক বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে জাহাজ ভাঙা শিল্পে। বেকার হয়ে গেছে ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক-কর্মচারী। এদিকে শিপব্রেকিং শিল্পে মন্দার চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রি-রোলিং মিলস শিল্পেও। চট্টগ্রাম ষ্টিল এন্ড রি-রোলিং মিলস ওনার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশের সেক্রেটারী মোঃ লোকমান বলেন, শিপব্রেকিং এর কাঁচামাল থেকে এসব রড তৈরী হতো। অধিকাংশ ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে স্ক্র্যাপ জাহাজের প্লেট সংকট সৃষ্টি হওয়া, দাম উঠানামা করায় অধিক মূল্যে কাঁচামাল কিনে লোকসানে রড বিক্রি করছিলেন মালিকরা।
এভাবে দীর্ঘদিন লোকসান দিতে দিতে শেষে এসব মিল বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে ৫০টি ম্যানুয়েল রি-রোলিং মিলসের মধ্যে ৩০টি অর্থাৎ ৬০% এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ৪/৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। শত শত কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। চট্টগ্রাম ষ্টিল এন্ড রি-রোলিং মিলস ওনার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি সাবেক চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আলহাজ্ব মঞ্জুরুল আলম প্রতিবেদককে বলেন, জাহাজ ভাঙা শিল্পে মন্দার প্রভাব রি-রোলিং মিলসেও পড়েছে। এ কারণে লোকসানে অনেক মিল বন্ধ। তিনি বলেন, যেসব রি-রোলিং মিলস মালিকের জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ড আছে তারা ঐ ইয়ার্ড থেকে কাঁচামাল (স্ক্র্যাপ লোহা) নিয়ে রড উৎপাদন করেন। আর যাদের নিজস্ব ইয়ার্ড নেই তাদের কাঁচামালের ক্রয়মূল পড়ছে বেশি বিক্রয় মূল্য কম। ফলে তারা লোকসান দিচ্ছেন। আর দীর্ঘদিন লোকসান হওয়ায় অনেকেই আর মিলস চালাতে পারছেন না।



 

Show all comments
  • তানবীর ৮ জুলাই, ২০১৭, ১১:২৬ এএম says : 0
    এই শিল্পকে রক্ষায় সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ