হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : গতবছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানত বৃদ্ধি পেয়ে ৪ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার খবরে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও এবারের প্রতিবেদনে সে অঙ্ক প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছলেও সরকারের সংশ্লিষ্টরা বা দেশের গণমাধ্যম আগের মত তেমন সক্রিয় প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। যদিও বিরোধিদল বিএনপি’র পক্ষ থেকে যুগ্ম মহাসচিব রূহুল কবির রিজভি আহমেদ সুইস ব্যাংকের ক্রমবর্ধমান এই টাকা পাচারের ঘটনাকে সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আমলাদের লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা বলে দাবী করেছেন। গত কয়েক বছর ধরে সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন অথবা আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং ইনডেক্স প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের তরফ থেকে এসব পাচারের নেপথ্যে কারা জড়িত রয়েছে তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি এসব অর্থ ফেরত আনার প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত এক টাকাও ফেরত এসেছে বলে আমরা শুনিনি। শুধু বিদেশে বা সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের বিষয়ই নয়, গত ১০ বছরে দেশে যে সব অভ’তপূর্ব বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুটপাট, জালিয়াতি, ভিওআইপি কেলেঙ্কারি, আইটি সেক্টরের স্কাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল পাচার পর্যন্ত ঘটনাবলির কোনটির বিষয়েই কোন সুস্পষ্ট তদন্ত রিপোর্ট এবং তদানুসারে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ব্যাংক জালিয়াতি ও শেয়ার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে জনগনের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পর গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় রাঘব বোয়ালদের জড়িত থাকা এবং নিজের অক্ষমতা বা অসহায়ত্বের কথা প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর এই অসহায়ত্ব সম্পর্কে জনমনে যে ধারনা তৈরী হয়েছে তা’ দেশের রাজনীতিতে সরকার ও সরকারী দলের জন্য নিশ্চিতভাবেই একটি নেতিবাচক প্লাটফর্ম তৈরী করেছে। এখন বিএনপি’র তরফ থেকে সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের পেছনে যখন আওয়ামিলীগের এমপি,মন্ত্রী ও নেতাদের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরা হচ্ছে তখন আওয়ামিলীগ সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কোন তদন্ত ছাড়াই সাফ বলে দিচ্ছেন, আওয়ামিলীগের কারো টাকা সুইস ব্যাংকে নেই। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে কোন দেশের নাগরিকদের নামে নগদ কত টাকা জমা আছে শুধু তারই হিসাব প্রকাশ করে থাকে। সেই সাথে সোনা-গয়না, হিরা জহরতসহ অতিমূল্যবান সামগ্রীও সেখানে গচ্ছিত রাখা হলেও এসবের তথ্য তাদের প্রতিবেদনে আসেনা। এমনকি নিজের আসল পরিচয় গোপন করেও অনেক কালো টাকার মালিক সেখানে টাকা রাখার সুযোগ নিয়ে থাকেন। অন্যদেশের নাগরিকত্ব রয়েছে এমন অনেক বাংলাদেশির অবৈধ টাকাও সুইস ব্যাংকে জমা হয়। অর্থাৎ সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে পাচার হওয়া টাকার পরিমান আসলে কত তা’ জানা যাচ্ছেনা। যেখানে দেশ থেকে বছরে লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেখানে পাচারকৃত অর্থের মাত্র এক শতাংশ সুইস ব্যাংকে জমা হচ্ছে-এমন তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ হলেও এই ব্যাংক প্রতিবছর তাদের প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের আমানতকারিদের সম্পর্কে একটি মোটাদাগের ডেটা প্রকাশ করে থাকে বলেই আমরা এ বিষয়ে কিছুটা অবগত হতে পারছি। তবে বছরে দেশ থেকে পাচার হওয়া লক্ষকোটি টাকার গন্তব্য ও পরিসংখ্যান সম্পর্কে আমরা এখনো অন্ধকারে। শুধুমাত্র সুইস ব্যাংকের টাকা নিয়ে হইচই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে নানা মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া লক্ষকোটি টাকার হিসাব ও নেপথ্য কুশীলবদের সহজেই আড়াল করা হচ্ছে।
অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ থেকেই জানা যায় সম্পদ সসীম এবং মানুষের চাহিদা অসীম। মানুষের শ্রম, বুদ্ধিজাত ও সেবামূলক উৎপাদনশীলতা থেকে প্রাপ্ত অর্থমূল্য সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে এবং উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে ব্যয় করে দেশকে সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে যাওয়া হয়। কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত সেই সম্পদ মিথ্যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নামে বিদেশে পাচার করে দিয়ে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে ফেলা হচ্ছে। গত বছরের জিএফআই(গেøাবাল ফিনান্সিং ইন্টেগ্রিটি) রিপোর্ট অনুসারে গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬.১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে ৬১.৬৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। জিএফআই’র হিসাবে প্রতি বছর গড়ে অর্ধলক্ষ কোটি টাকা এবং ১০ বছরে ৫ লক্ষকোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। টাকা পাচারের হার বছরে গড় ৫০ হাজার কোটি টাকা হলেও কোন কোন বছর তা বছরে লক্ষকোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিশেষত: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নির্বাচনের বছরগুলোতে টাকা পাচারের পরিমান দ্বিগুন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। দেশে বেসরকারী বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা এবং অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীর্তিকেই টাকা পাচারের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জিএফআই ইউনিট। বিরোধিদলের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতায় না গিয়ে তাদেরকে সহিংস আন্দোলনে ঠেলে দেয়া এবং একতরফা নির্বাচনের সময় ২০১৩ এবং ১৪ সালে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমান টাকা পাচার হয়েছে। জিএফআই হিসাবে ২০১৩ সালে ৯.৬৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৪ সালে ৯.১ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। তবে ভিন্ন এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় শুধুমাত্র ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমান ছিল ১ হাজার ২৫৭ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। যা আগের অর্থ বছরের চেয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা বেশী। টাকা পাচার রোধ, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা অথবা পাচারকারিদের সম্পর্কে কোন রকম তদন্ত না হওয়ায় টাকা পাচারের এ ধারা অব্যাহত রয়েছে বলেই আমরা ধরে নিতে পারি। গত দুই বছরে কি পরিমান অর্থ পাচার হয়েছে এবং আগামী বছরে যে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে এবং ক্ষমতার পালাবদলের যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তাতে চলতি বছর টাকা পাচারের মাত্রা আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফা হওয়ায় তা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্যতা পায়নি। সেই সাথে দেশে অব্যাহত রাজনৈতিক সংঘাত ও জঙ্গিবাদি তৎপরতার কারণে জননিরাপত্তা ও ব্যবসায় বাণিজ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হওয়ায় বিনিয়োগকারিরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে তা বিদেশের সেইফ হ্যাভেনে সরিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ দেশের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা চর্চায় তেমন ব্যাঘাত না ঘটলেও দেশের বিনিয়োগ,ব্যবসায় বাণিজ্য, দেশি-বিদেশি কর্মসংস্থান, উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। অর্থনীতি ও সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার এই গ্যাড়াকল থেকে জাতিকে নতুন সম্ভাবনার পথে নিয়ে যেতে হলে দেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন এবং স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে দেশে আবারো একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরীর আশঙ্কা রয়েছে। একটি অবাধ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে চলতি অর্থ বছরে ক্ষমতাসীন দলের রাঘব বোয়ালদের টাকা পাচারের হার আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। আমদানী রফতানী খাতে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং, মিথ্যা ঘোষনা, জালিয়াতি, বিদেশে সেকেন্ড হোম, ট্যাক্স হ্যাভেন ইত্যাদি সুযোগ নিয়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও সম্ভাবনা ধ্বংস করে দেয়ার প্রবণতা রোধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে।
শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের ব্যাংক জালিয়াতি, ডেস্টিনি গ্রুপের অর্থ আত্মাসাৎ, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, হাজার হাজার কোটি ডলারের টাকা পাচার এবং সুইস ব্যাংকের আমানতসহ প্রতিটি বড় বড় অর্থ কেলেঙ্কারির পর কিছুদিন গণমাধ্যমে ও টিভি টকশোতে কিছু হইচই হলেও সরকারের সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে কখনো কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা দূরের কথা, এমনকি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতেও তারা অপারগতা প্রকাশ করেছেন। দেশের দরিদ্র কৃষকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির কারণে ক্ষুদ্র ঋনের ৫-১০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ব্যাংকের মামলায় পুলিশ কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে যায়। আর ব্যাংক জালিয়াতি ও কারসাজি করে শত শত কোটি টাকা নিয়ে ফেরত না দিয়ে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে দেয়ার পরও কথিত রাঘব বোয়ালদের কিছুই হয়না। হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি নিয়ে গণমাধ্যমের শোরগোলের মুখে কখনো দু’একজনকে ধরা হলেও তাদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার বা শাস্তি কোনটাই কোন উপসংহারে পৌছায় না। গত শনিবার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, কথিত মহাজনের দাদনের পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলায় দরিদ্র কৃষক জবান আলী দীর্ঘদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এবার ঈদের ছুটিতে বাড়িতে ঈদ করার পর জবান আলী তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় আসার পথে পুলিশ পরিবারের প্রায় সকলকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। আটকের ৩৫ মিনিটের মধ্যেই থানায় পুলিশি নির্যাতনে জবান আলীর মৃত্যু হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিয্গো করা হয়েছে। সারাদেশে এমন হাজার হাজার জবান আলী মহাজনের দাদন বা ক্ষুদ্র ঋণে খেলাপি হওয়ার কারনে ফেরারি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অথবা আত্মহত্যা করে মুক্তির পথ খুঁজছে। গত বছর প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ২ লাখ গ্রাহক সার্টিফিকেট মামলার সম্মুখীন। এদের মধ্যে সাড়ে ১২ হাজারের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হলেও বেশীরভাগ ঋণ গ্রহিতাই মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব ঋন গ্রহিতারা গড়ে ৩০ হাজার টাকার ঋণগ্রস্ত। অর্থাৎ ২ লাখ সার্টিফিকেট মামলার বিপরীতে সরকারী ব্যাংকগুলোর পাওনা প্রায় সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কৃষিব্যাংক(বাকৃবি), রাকাব, অগ্রনী, সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের মামলায় লাখ লাখ কৃষক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ৫-১০ হাজার টাকার কৃষিঋণ সুদাসলে বেড়ে তিনচারগুন হয়ে যাওয়ায় তাদের জন্য পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় তারা পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে হাজার হাজার কৃষকের পারিবারিক জীবন এবং উৎপাদনশীলতা বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে, কৃষিঋণ আদায়ের এ প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে বছরে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ও রাজস্ব খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট করে বিদেশে পাচার করে দিয়ে রাজনৈতিক রাঘব বোয়ালরা কোটি টাকার গাড়ী হাঁকিয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক হলমার্ক গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কারসাজির মাধ্যমে লোপাট হওয়া টাকার পরিমান সার্টিফিকেট মামলার সম্মুখীন হওয়া ২ লাখ কৃষকের সম্মিলিত ঋণের চেয়ে ১০ গুণের বেশী। দেশের রাজনীতি, পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচারব্যবস্থাসহ সব কিছুই তাদের কালোটাকার কাছে প্রকারান্তরে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ স্থান থেকে মাঝে মধ্যে দুর্নীর্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে শোনা যায়। কখনো প্রভাবশালী রাঘর বোয়ালদের ধরে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে দেখা যায়না।
গত বছর জিএফআই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহনের কারনে ভারত থেকে সুইস ব্যাংকে আমানতের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানা যায়। পানামা রিপোর্ট নামে পরিচিত মোসাক ফনসেকা নামের একটি ল’ ফার্ম থেকে ফাঁস হওয়া রিপোর্টে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শত শত প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাসহ নানা ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক দুর্নীতির চিত্র প্রকাশিত হওয়ার পর সেখানে স্থান পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও দুর্নীতি বিরোধি সংস্থাগুলো তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করলেও সেই তালিকায় থাকা বাংলাদেশের ২৬ জনের কাউকেই কোন তদন্ত বা আইনগত জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। গত বছর এশিয়া প্যাসিফিক গ্রæপের মানি লন্ডারিং বিষয়ক রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা বলা হয়েছে, অর্থপাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত। দেশের আইন, ব্যাংকিং ব্যাবস্থা, কেন্দ্রিয় ব্যাংকের মনিটরিংসহ কোনকিছুই অর্থপাচার রোধে কার্যকর ভ’মিকা রাখতে পারছেনা। ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুন বড় এবং একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়া সত্বেও সর্বশেষ জরিপে সুইস ব্যাংকের আমানতে ভারতীয়দের অবস্থান বাংলাদেশের প্রায় সমান। মাথাপিছু ৩০ হাজার টাকা ঋণ খেলাফের দায়ে দেশের লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের উপর সার্টিফিকেট মামলার খড়গ ঝুলিয়ে দেয়া হলেও এই মুহূর্তে দেশের প্রত্যেক নাগরিক, সদ্যজাত শিশু থেকে নবতিপর বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই মাথাপিছু ৪৬ হাজার টাকা ঋণগ্রস্ত। এই ঋণের দায় রাষ্ট্রের। গত এক দশকে দেশ থেকে যে পরিমান টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে আমাদের সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমান তার চেয়ে কিছুটা বেশী। আর গত চল্লিশ বছরে পাচার হওয়া সম্পদের পরিমান নি:সন্দেহে বৈদেশিক ঋণের চেয়ে অনেনক বেশী হবে। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষনার সময় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে আমাদের জাতীয় ঋণের পরিমান ছিল ৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা, যা বছর শেষে দাড়াবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এ অঙ্ক আমাদের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র ৩৪.৫ শতাংশ। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও কর্মংসংস্থানের কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র দুর্নীতি, লুটপাট ও টাকা পাচার বন্ধ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও সম্ভাবনা কোথায় গিয়ে দাড়াত তা সহজেই অনুমেয়। আমদানী রফতানী বাণিজ্যে ওভার ইনভয়েসিং, মিথ্যা ঘোষনার মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার পাচার ছাড়াও মালয়েশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম ও বিনিয়োগের নামে অর্থপাচারের এই বল্গাহীন তৎপরতার পেছনে কাজ করছে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং আর্থিক খাতের অস্বচ্ছতা। দেশি বিদেশি বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমশ সঙ্কোচিত হলেও বিভিন্ন সেক্টরে বৈধ-অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতিবছর শত শত কোটি ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশী। টাকার অংকে চল্লিশ হাজার কোটি টাকার বেশী। অন্যদিকে বৈধ অবৈধ ভারতীয় শ্রমিকরা বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাণিজ্য বৈষম্য এবং রেমিটেন্স আকারে শুধুমাত্র ভারতেই বাংলাদেশ থেকে বছরে লক্ষকোটি টাকা চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার সবচে বড় অংশই চলে যাচ্ছে ভারতে। এ হিসাবে শুধু ভারতেই চলে যাচ্ছে জিএফআই রিপোর্টে উল্লেখিত পরিমানের চেয়ে বড় অঙ্কের টাকা। বাংলাদেশে বিগত একদলীয় নির্বাচন এবং রাজনৈতিক সংকটের পেছনেও যে ভারতীয়দের হাত আছে তা’ও অস্বীকার করা যায়না। আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংকেটর কারনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং অর্থপাচার বেড়ে যায়। দেশের ভবিষ্যত নিয়ে সরকার এ্ং রাজনৈতিক দলগুলো যতই ভিশন বা রূপকল্প ঘোষনা করুক। ঋণের বোঝা এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সম্ভাবনা নস্যাতের রাজনীতি পরিহার না করলে এসব ভিশন শুধু স্বপ্নই রয়ে যাবে। টাকা পাচার ও দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিনত করে স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন অসম্ভব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।