Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নশিপুর ভিত্তি পাটবীজ খামারে লুটপাট

| প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কাটা ফসল ওজন ও স্টোরে জমা না করেই প্রক্রিয়াকরণ, ম্যাজিস্ট্রেটের তল্লাশিতে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ, প্রাথমিকভাবে ৩ জন বরখাস্ত : হোতাদের অনেকেই অধরা
দিনাজপুর থেকে মাহফুজুল হক আনার
বিএডিসি অধিভুক্ত দিনাজপুরের নশিপুর ভিত্তি পাট বীজ খামারে হরিলুটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। বছরের পর বছর খামারের জমিতে উৎপাদিত হাজার হাজার টন ধান, গম, আলুসহ বিভিন্ন ফসলের কোন হিসাব নেই। সরকার দলীয় শ্রমিক নেতা আর খামারের হাতে গোনা কয়েকজন কর্মকর্তা ইচ্ছেমত ভোগ করে চলেছে। সম্প্রতি চোরাপথে বিক্রি করে দেয়া কয়েক শ’ বস্তা ধান ও গম আটকের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের দ্বারা দু’দফায় চোরাপথে বিক্রি করা ১৮৬ বস্তা ধান ও গম আটকের পর জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ম্যাজিষ্ট্রেট খামারের গোডাউন ও রেজিস্টার পর্যালোচনা করার সময় বছরের পর বছর ধরে শত শত একরের উৎপাদিত ধান, গম আলু ও পাটের কোন সঠিক রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে সরকারী এই প্রতিষ্ঠানটিতে পুকুর চুরির ঘটনা উৎঘাটনে পুনরায় গোডাউন তালাবদ্ধ করে অধিকতর তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করা হয়েছে। চুরির ঘটনা ধরা পড়ার পর বিএডিসি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজারকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, খামারের বাইরে দু’দফায় চোরাই ধান ও গম উদ্ধারের পরও খামার কর্তৃপক্ষ থানায় ন্যূনতম একটি সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত করেনি। উল্টো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ শ্রমিকদের ছাঁটাই করে তাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ নশিপুর পাট বীজ খামারের যুগ্ম পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন, সহকারী উপ পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ও স্টোর ইনচার্জ আমজাদ হোসেনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। তবে আত্মসাতের অন্যতম নায়ক সহকারী উপ-পরিচালক সামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ওদিকে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য একটি মহল ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
দিনাজপুর শহরের উত্তর উপকন্ঠে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)’র আওতাধীন নশিপুর ভিত্তি পাট বীজ খামার। অতি পুরাতন এবং কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির জমি আরো অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে পাট আবাদ কমে যাওয়ার পাশাপাশি গম গবেষণা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন কৃষি ভিক্তিক প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি ছাড় দিতে দিতে বর্তমানে খামারটির জমির পরিমাণ প্রায় ৬৩০ একর। এর মধ্যে ৫১০ একর জমিতে ফসল আবাদ করা হয়। পাটের আবাদের পাশাপাশি আবাদের ক্রমানুবর্তিতার উপর ভিত্তি করে ধান, গম ও আলু’র আবাদ করা হয়ে থাকে। খামারের জমি উৎপাদিত এসব ফসল থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করা হয়। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বীজ সংরক্ষণের পর অবশিষ্ট অবীজ ধান, গম, আলুসহ অন্যান্য ফসলা খামারে ফেরত এনে স্টোরভুক্ত করা হয়।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাঠে ফসল কর্তনের পর উৎপাদনের হার নির্ণয়সহ মোট পরিমাণ রেকর্ড করার কথা। নশিপুর ভিত্তি পাট বীজ খামারেও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে ধান গম কর্তন ও আলু উত্তোলন করা হয়। এসব কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ও স্থানীয় অধিবাসীরা জানান মাঠ থেকে বস্তায় ভরে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকল ফসল খামারের ভিতর নিয়ে যাওয়া হয়। আর সকল ফসলই বøক ভিত্তিক সহকারী উপপরিচালকদের নিয়ন্ত্রনে থাকে। একমাত্র সহকারী উপ পরিচালকরাই উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ জানতে পারেন। খামারের মোট তিন জন উপ পরিচালকের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন যুগ্ম পরিচালক। এর মাঝে আর কেউ নেই। ফলে ফসল উৎপাদনের খরচ থেকে কর্তন সবকিছুই হয়ে থাকে সহকারী উপ-পরিচালকদের মাধ্যমে। আর এর সবকিছুর মূল নিয়ামক হিসাবে কাজ করে থাকেন সরকার দলীয় দুই থেকে তিন জন সরকার দলীয় শ্রমিক নেতা। সাম্প্রতিককালে পর পর কয়েকটি চুরি বা আত্বসাত ঘটনা শ্রমিকরা ধরে ফেলার পর বিষয়টি মিডিয়ায় চলে আসায় থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। অবশ্য এর আগে আরো কয়েকবার চুরির ঘটনা ঘটেছে এবং এ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর পরই বিষয়টি যেভাবেই হউক ধামা চাপা দেয়া হয়েছে।
গত ২৭ জুন ঈদের পর দিন স্থানীয় শ্রমিকেরা খামার থেকে পাচার করা ১৬২ বস্তা গমের সন্ধান পেয়ে পার্শ্ববর্তী সরকার টেক্সটাইল মিলের গোডাউন ঘিরে ফেলে। পাচার করা গম উদ্ধার এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবীতে দিনাজপুর ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে। খবর পেয়ে কাহারোল থানা পুলিশ উপস্থিত হয়ে স্থানীয় কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে চোরাই গম থাকা গোডাউনটিতে অতিরিক্ত তালা ঝুলিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সদর টিএনও প্রতিনিধি পাঠিয়ে গোডাউনটির তালা ভেঙ্গে গমগুলি জব্দ করে স্থানীয় ইউনিয়ন কার্যালয়ে নিয়ে আসে। এখানে উপস্থিত শ্রমিকরা জানায় এর আগে ২২ জুন খামার থেকে পাচার করা ২৪ বস্তা ধান উদ্ধার করে স্থানীয় ১নং ইউপি কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। তার কয়েকদিন আগে শ্রমিকদের অভিযোগ জুন মাসে ১২৮ বস্তা ধান পুলহাটে বিক্রির সময় আটক করা হলেও পরে নেতারা ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা জানায়, শ্রমিক দলীয় শ্রমিক নেতা জব্বার, শ্রমিক সর্দার ভূষন এর সহযোগিতায় যুগ্ম পরিচালক মোশাররফ হোসেন, সহাকারী উপ পরিচালক সামসুজ্জামান ও জাহাঙ্গীর আলম খামারের লক্ষ লক্ষ টাকার চুরি’র সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আর এসবের নিরব স্বাক্ষী হচ্ছে স্টোর ইনচার্জ আমজাদ হোসেন। এর সত্যতা পাওয়া গেল শ্রমিক উদয় ও আবু বক্করের বক্তব্যে। তারা জানায় শ্রমিক সর্দার ভুষন ও জব্বারের নির্দেশেই তার খামারের ভিতরে চাটাল ও পাশের খোলা টিন শেডের নীচে থাকা ধান ও গম ট্রলিতে তুলে দিয়েছে। ট্রলিগুলি যথারীতি বাহিরে চলে গেছে।
সূত্রটির মতে, মাঠ থেকে উৎপাদিত ফসল খামারে এনে স্টোরভুক্ত করা হতো না। কোন প্রকার নথিভুক্ত না করে সহকারী উপ-পরিচালকেরা নিজ উদ্যোগেই শ্রমিকদের দ্বারা ফসল চাটালে শুকানোর (সাইনিং) কাজ করতো। শুকানোর পর তারা কোন ওজন ছাড়াই সাধারন চালানের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী বিএডিসি’র প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিত। কত মন বা টন ধান গম আলু পাঠানো হলো তার কোন হিসাব স্টোর রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করা হতো না। এ ব্যাপারে যুগ্ম পরিচালক ইনকিলাব প্রতিনিধিকে জানান, মাঠ থেকে ফসল আনা এবং স্টোর ভুক্ত করার বিষয়টি সম্পূর্ণরুপে সহকারী উপপরিচালকদের দায়িত্ব। সহকারী উপপরিচালক সামসুজ্জামান ও জাহাঙ্গীর আলমকে মাঠে ফসল কর্তনের পর ওজন না করে স্টোর জমা না দেখিয়ে চাতালে শুকিয়ে সরাসরি প্রক্রিয়াকেন্দ্রে পাঠানো নিয়ম বহির্ভূত নয় কি জানতে চাইলে টাল বাহানা করতে থাকে। এক পর্যায়ে সরাসরি তা স্টোর ইনচার্জের দায়িত্বে থাকে বলে জানায়। একই সময় স্টোর ইনচার্জ আমজাদ হোসেন জানান, ফসল এনে প্রক্রিয়াকেন্দ্রে পাঠানো পর্যন্ত তাকে কিছুই জানানো হয় না। ফলে স্টোর রেজিস্ট্রারে উঠানো এবং মুল গোডাউনে ঢোকানো সম্ভব হয় না।
শ্রমিকদের অভিযোগ প্রক্রিয়ার নামে ১০ গাড়ী ফসল খামারের বাহিরে নিয়ে যাওয়ার পর অর্ধেক চলে যেতো ব্যবসায়ীদের হাতে। প্রক্রিয়াজাত করনের পর বীজের উপযুক্ত নয় এমন ফসলাদি ফেরত আসতো খামারে। এখানেও কোন সঠিক রেকর্ড করা হতো না। ইচ্ছেমত আত্মসাত শেষে কিছু ফসল স্টোরভুক্ত করে বিএডিসি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হতো। পরে অবীজ ফসলসমূহ টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা হতো।
এসকল বিষয় এতদিন অধরাই ছিল। যদি না ঈদের পরদিন ২৭ জুন পাচার করা ১৬২ বস্তা গম উদ্ধার হতো। পরদিন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট উচিং মার্মা ও খায়রুল আলম পাট বীজ খামারের গোডাউন ও রেজিস্ট্রার পর্যালোচনা করতে যেয়ে ব্যাপক অনিয়ম দেখতে পান। দেখাতে পারেননি কোন রেকর্ড। ফলে ব্যাপকভাবে পরিমাপ নির্ণয়সহ সুষ্ঠু তদন্তের জেলা প্রশাসককে অভিহিত করার কথা জানান কর্তব্যরত ম্যাজিষ্ট্রেটদ্বয়। অপরদিকে জেনারেল ম্যানেজারকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তবে বিষয়টি ধামা চাপা দেয়ার জন্য শ্রমিক নেতা থেকে বিভিন্ন মহল জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: লুটপাট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ