Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাহাড় দখল ও কর্তন বন্ধ করতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ সকল বসতি সরিয়ে দিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান : চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে ভয়াবহ পাহাড় ধসে মৃত্যুর সংখ্যা, এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত, দেড়শ’ ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া দেয়াল চাপায়, পানিতে ডুবে ও বজ্রপাতে কিছু লোক মারা গেছে। অবিরাম বর্ষণ এবং প্রচন্ড বেগে ধাবমান ঢলে এই স্মরণকালের শোচনীয় মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ঘূর্ণিঝড় মোরার কারণে যে সব এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, পাহাড়াঞ্চলের ওই সব এলাকাতেই ফের অতিবর্ষণ হয়েছে এবং ধস ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। মোরার কারণে সৃষ্ট বারিপাতে পাহাড়গুলোর মাটি নরম হয়ে যায়। অত:পর কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে প্রধানত ন্যাড়া ও কাটা পাহাড়গুলো ধসে পড়ে এতগুলো মানুষের মর্মান্তিক অকাল মৃত্যুর কারণ হয়েছে। এর আগে পাহাড় ধসে প্রাণহানির বড় ঘটনাটি ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জুন। এদিন চট্টগ্রামের সাতটি স্থানে পাহাড় ধসে মৃত্যু হয় ১২৭ জনের। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পাহাড়ধসে গত ১০ বছরে একমাত্র চট্টগ্রামেই দু’শ’র ওপর মানুষ নিহত হয়েছে। কেবল ২০১৬ সালে পাহাড় ধসে মৃত্যুর কোনো ঘটনা ঘটেনি। এবারে যেটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় সেটা হলো, চট্টগ্রামসহ গোটা পাহাড়াঞ্চলে পাহাড় ধস হয়েছে এবং সর্বত্রই কমবেশী প্রাণহাণি হয়েছে। প্রকৃতি এখনো বৈরি। সব জায়গায় যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। উদ্ধার কাজও ঠিক মতো চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আশংকা করা হচ্ছে, আরো অনেকেই মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকতে পারে। উদ্ধার কাজ সম্পন্ন হলে হয়তো দেখা যাবে মৃতের সংখ্যা আরও বেড়েছে। পাহাড়ের ওপর জবরদখল, জুলুম এবং তার প্রকৃতিবিনাশ যে আগের তুলনায় বেড়েছে এবং অনেকটাই স্বাভাবিক ও সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে, এবারের পাহাড় ধস ও প্রাণহানির ঘটনা তার সাক্ষ্য বহন করে।
পাহাড় ধস ও সেই ধসের নীচে চাপা পড়ে মানুষের করুণ মৃত্যুর ঘটনা আগে খুব একটা ঘটতে দেখা যেতো না। এখন তা প্রায় প্রতিবছরের অনিবার্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক খবরে জানা গেছে, গত ১১ বছরে পাঁচ শতাধিক মানুষ পাহাড় ধসে মারা গেছে। মৃত্যুর এই সংখ্যাটি কোনো বিবেচনাতেই উপেক্ষাযোগ্য নয়। মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যুর স্বাদ প্রত্যেকে জীবেরই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এই যে, অকাল আকস্মিক ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, তা সহজভাবে কেউ নেয় না বা নিতে পারে না। কী কারণে পাহাড় ধস ও মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে সেটা অবশ্যই একটি বড় প্রশ্ন। পর্যবেক্ষকদের মতে, পাহাড়ের মাটি কর্তন, বৃক্ষ নিধন, মাটি কেটে বসতি ও রাস্তা নির্মাণ, জুম চাষ ইত্যাদি কারণে পাহাড়ের প্রাকৃতিক বেশিষ্ট্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। শুধু তাই নয়, এমনও দেখা গেছে, এক সময় সেখানে পাহাড় বা টিলা ছিল এখন সেখানে তা নেই। হয় সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে অথবা বাড়িঘর, বসতি, দোকানপাটে ভরে গেছে। কয়েক দশক আগেও যারা চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে গেছেন তারা যদি এখন ফের ওই সব এলাকায় যান, দেখতে পাবেন, ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। অনেক চেনা জায়গাও এখন তারা চিনতে পারবেন না।
চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর ওপর নির্বিচারে অত্যাচার চালানো হয়েছে। পাহাড়খাদকেরা অনেক পাহাড় খেয়ে ফেলেছে। অনেক পাহাড় তাদের নখরাখাতে ক্ষত-বিক্ষত ও মৃত্যুপ্রায়। এক সময় যেসব পাহাড় ছোটবড় গাছে পূর্ণ ছিল, জীব জন্তু ও পাখপাখালিতে ভরপুর ছিল এখন তার অধিকাংশই ন্যাড়া, বৃক্ষহীন, রুক্ষ, ভংগুর অবস্থায় পতিত এবং কোনোরকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। পাহাড়খাদকেরা আগে পাহাড়ের গাছপালা কেটে সাবাড় করেছে। পরে মাটি সাবাড় করেছে এবং সর্বশেষ পাহাড়ের জায়গাটি বাড়িঘর, নির্মাণ, কলকারখানা স্থাপন বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করেছে। এই প্রক্রিয়াই অনুসৃত হচ্ছে, যার কারণে অনেক পাহাড়-টিলা হারিয়ে গেছে। এতে চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকায় প্রাকৃতিক ও পরিবেশিক ভারসাম্য ব্যাপক আকারে ক্ষতির সস্মুখীন হয়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পাহাড়ী ঢলের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এবারের কথায়ই যায়। বর্ষার আগেই এবার সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকায় যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে তা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বৃষ্টি ও উজানের ঢলে বৃহত্তর সিলেটের হাওর এলাকায় ফসলহানির কথা আরো অজানা নেই। হঠাৎ বোরোর এহেন ক্ষতি ও বিনাশ সম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়নি।
পাহাড় নিয়ে প্রধাণত দু’ ধরনের বাণিজ্য হচ্ছে। প্রথমত, এর গাছ ও মাটি বিক্রি। দ্বিতীয়ত, পাহাড়ের জায়গা বানিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, পাহাড়ে বা পাহাড়ের পাদদেশ ঘরবাড়ি নির্মাণ করে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। এসব পাহাড়ী বস্তির মালিক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। প্রশাসনের লোকেরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা দিয়ে থাকে। বিনিময়ে তারা বস্তিবাণিজ্যের বখরা পেয়ে থাকে। পাহাড়ে ও পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা এসব বস্তির লোকই প্রধানত পাহাড় ধসের মর্মান্তিক শিকারে পরিণত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পাহাড় কাটা, তার আকৃতি পরিবর্তনবৃক্ষ নিধন, বসতি স্থাপন ইত্যাদি নিষিদ্ধ হলেও এই নিষেধাজ্ঞায় কেউ কর্মপাত করে না। যারা পাহাড়কেন্দ্রিক বাণিজ্যের হোতা তারা আইনবিধির তোয়াক্কা করেনা। অন্যদিকে যেসব লোক পাহাড়ী বস্তিতে বসবাস করে তারা মূলত নিরূপায় হয়ে যেখানে বসবাস করে এবং সর্তক করার পরও বস্তি ত্যাগ করতে সম্মত হয় না। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি এলাকায় এরকম শত শত বস্তি বহাল তবিয়তে আছে এবং এসব বস্তিতে লাখ লাখ অসহায়, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
বিভিন্ন গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও তদন্ত রিপোর্টে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস উঠিয়ে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতি বছরই বর্ষার প্রাক্কালে পাহাড় ধসের আশংকার কথা ব্যক্ত করা হয়, স্থানীয় প্রশাসনের কিছুটা নড়চড়াও লক্ষ্য করা যায়। তবে ফলাফল যথাপূর্ব তথা পরং। কখনো কখনো বস্তি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, কখনো কখনো বস্তি থেকে লোক সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ আখেরে লোক দেখানো হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। উচ্ছেদকৃত বস্তিতে ফের বসতি গড়ে উঠেছে। এমনও দেখা গেছে, সকালে উচ্ছেদ করা হয়েছে, সন্ধ্যাতেই তারা ফিরে এসেছে। ২০০৭ সালের ভয়াবহ পাহাড় ধস ও বিপুল লোকক্ষয়ের পর চট্টগ্রামের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্ব একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটি ২৮টি কারণ নির্ধারণ করে ৩৬টি সুপারিশ প্রদান করে। ওই সুপারিশের একটিও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। চট্টগ্রাম মহানগরীর খুলশী, বায়েজিদ, পাহাড়তলী, মতিঝর্ণা, লালখান বাজারসহ অন্যান্য এলাকার পাহাড়গুলোতে মানুষ মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। আর এসব বস্তিবাণিজ্যে প্রভাবশালীদের লাখ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। ওদিকে কক্সবাজার শহরে আলীর জাহাল সাইফুল কমিউনিটি সেন্টারের পাশে অবস্থিত এক দীর্ঘ পাহাড়ের মাটি কোটে টিনশেড ঘর করে ভাড়া দিয়েছে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। শহরের অনুরূপ ১১টি পাহাড় দখল করে অন্তত ৩০ হাজার বস্তিঘর তোলা হয়েছে। সেখানে বসবাস করছে কয়েক লাখ মানুষ। শুধু চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারেই যে এই বস্তিবাণিজ্য চলছে, তা নয়, গোটা পাহাড়ি অঞ্চলেই এ বাণিজ্য রমরমাভাবে চলছে। স্থানীয় রাজনৈতিক মহল, প্রভাবশালী মহল, প্রশাসন-সবার চোখের সামানেই পাহাড়ে অনাচার, দখল, বস্তিবাণিজ্য পুরোদমে অব্যাহত আছে। কেউ কিছু বলছে না। কারো যেন করার কিছু নেই। আসলে সরিষায় ভূত থাকলে ভূত তাড়ানোর কোনো উপায় থাকেন না। এই অবস্থাটিই সর্বত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
পাহাড় প্রধানত : সরকারের। অতএব, সরকারেরই দায়িত্ব পাহাড় সুরক্ষা করা। পাহাড় দখল, কর্তন, বৃক্ষনিধন, বস্তি নির্মাণ ইত্যাদি প্রতিরোধ করতে সরকার যদি এগিয়ে না আসে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয় তবে কারো পক্ষেই পাহাড় ও তার পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব নয়। পাহাড়ের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে অনেক সমীক্ষা ও গবেষনা হয়েছে। পাহাড়গুলো দখলমুক্ত করে পারিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হলে দেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে। পাহাড়ে বৃক্ষায়ন, ফলবান বৃক্ষসহ চা, বাবার ইত্যাদির আবাদ হতে পারে। এতে পাহাড়ী জনগণ যেমন লাভবান হতে পারে তেমনি দেশও আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে। এব্যাপারে ব্যাপকভিত্তিক স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। এদিকে সরকারের তেমন নজর আছে, বাস্তবতা দেখে বা মনে করার কোনো কারণ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, যা কিছুই করা হোক না কেন, সবার আগে পাহাড় দখলমুক্ত করতে হবে। দখলের যে কোনো তৎপরতা কঠোরভাবে প্রতিহত করতে হবে।
পরিবেশ আইনে পাহাড় কর্তন ও তার আকারা-আকৃতির পরিবর্তন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন লংঘনের দায়ে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদন্ড, পাহাড় কাটার যন্ত্রপাতি জব্দ ও পাহাড়কে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিধান থাকলেও তার কোনো কার্যকারিতা নেই। ওই আইনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সীমিত ও পরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটার সুযোগ থাকায় সেই সুযোগটাই পাহাড়দস্যুরা গ্রহণ করছে। দেখা গেছে, পাহাড়ের কিছু অংশ কাটার অনুমতির সুযোগ নিয়ে আরও ৮/১০টি পাহাড়-টিলা কেটে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। অত্যন্ত দু:খজনক একটি তথ্য হলো, চট্টগ্রামে পরিবেশ অধিদফতরের কার্যালয়টিই নির্মিত হয়েছে পাহাড় কেটে। বাস্তবতা যদি এই হয়, পাহাড় দখল ও কর্তন রুখবে কে? পাহাড় দখল ও কাটা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা এবং এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে পাহাড়কে নিরাপদ করা যাবে না এবং পাহাড় ধস ও প্রাণহানি রোধ করা যাবে না। পাহাড় প্রকৃতির অনন্য সাধারণ দান। চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পাহাড় ওই গোটা অঞ্চলের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে। সারা বিশ্বেই বৃক্ষশোভিত পাহাড় জীবজন্তুু ও পাখপাখালির অভয় ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত। পাহাড়ের নয়ানাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এই মুগ্ধতাই পাহাড়-জঙ্গলে মানুষকে টেনে নিয়ে যায়। সমুদ্র, পাহাড়, বন মানুষকে এক অনিবর্চনীয় আকর্ষণে আকর্ষিত করে। একারণেই মানুষ সুযোগ পেলেই সমুদ্র, পাহাড় ও বনে ছুটে যায়। এই তিন প্রাকৃতিক দানে যেসব দেশ সমৃদ্ধ সেসব দেশ পর্যটন থেকে বিপুল অংকের অর্থ আয় করে। বাংলাদেশেরও এই আয় লাভের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্র, পাহাড় ও বনসম্পদে সমৃদ্ধ। কক্সবাজারে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। আছে পাহাড় ও বন। সিলেট এলাকায় রয়েছে পাহাড়-টিলা, দীর্ঘ ও প্রাচীন বন ও শোভাময় চা বাগান। দু:খজনক হলেও সত্য, প্রকৃতির এসব দান আমরা সংরক্ষণ করতে পারছি না, ব্যবহার করতে পারছি না। নিজেরাই সব কিছু ধ্বংস ও বিনাশ করে দিচ্ছি। আত্মঘাতী এ তৎপরতা যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা আরো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বিপর্যয়, ধস, মৃত্যু সম্পদহানি বাড়িয়ে দেবে।
প্রকৃতিতে যা কিছু আছে, তা সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য। এই সম্পদ সুরক্ষায় ব্যর্থ হলে প্রকৃতি তার নিয়মেই প্রতিশোধ-পরায়ণ হয়ে ওঠে। প্রকৃতিকে আমরা যথার্থ মূল্য দিইনি বলেই নানাভাবে তার প্রতিশোধপরায়নতার শিকার হচ্ছি। আমরা নদী রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে প্রতিবছরই ভাঙন ও বন্যার শিকার হচ্ছি। নদীকে সচল ও নাব্য রাখার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা অমার্জনীয়। অভিন্ন নদীর উজান থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে আমাদের নদীগুলোর একাংশ ভুগোল থেকে হারিয়ে গেছে। বড় নদীগুলোও শুকনো মওসুমে মরা খালে পরিণত হয়। পানির অভাবে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, মৎস্য চাষ, মাটি, প্রকৃতি ও পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসে। আবার বর্ষায় বিপুল বর্ষণ ও সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা ঢলে কখনো গোটা দেশ, কখনো অংশ বিশেষ তলিয়ে যায়। বান-বন্যায় মানুষের ক্ষতি ও দুর্ভোগের শেষ থাকে না। বিস্ময়কর ব্যাপার যে, ছোট্ট এই দেশের পূর্ব মধ্যাঞ্চলে এখন যখন বৃষ্টি ও ঢলে বন্যা ও মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, ঠিক সেই সময় উত্তরাঞ্চল অনাবৃষ্টি ও খরায় পুড়ছে। এটাও প্রকৃতির একরকম প্রতিশোধ। এর জন্য মানুষই দায়ী। আমরা নদী, প্রকৃতি, ও পরিবেশকে রক্ষা করতে পারিনি। বরং তাদের জীবনধারা ও বৈশিষ্ট্যকে বিনষ্ট বা ধ্বংস করেছি। এখন নানাভাবে তারই ফল ভোগ করছি। সম্প্রতিক বছরগুলোতে ঝড়-জলোচ্ছ¦াস, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, বজ্রপাত ইত্যাদি বেড়ে গেছে। বিশ্বের আবহাওয়ায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তনজনিত নানা প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ঝড়-জলোচ্ছাস, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, বজ্রপাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাযুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। সমুদ্রের পানি-স্ফীতি আরো কিছুটা বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এক বিরাট অংশ সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাবে, কয়েক কোটি মানুষ উদ্বাস্ততে পরিণত হবে, সহায়-সম্পদের অপূরণযোগ্য ক্ষতি সাধিত হবে। এটাও সকলের দৃষ্টিতে আসার কথা, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি হাত ধরাধরি করে আসছে এবং কোনো নির্দিষ্ট সময় মানছে না। এতে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে দেশ ও মানুষকে। এবার হাওরাঞ্চলে যে লাখ লাখ মানুষকে নিঃস্ব ও পথের ভিখারিতে পরিণত হতে হলো, তার ক্ষতি কি পূরণযোগ্য? কয়েক বছরে ভূমিকম্পের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। পর্যবেক্ষক-বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প-ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ৭ রিখটার স্কেলের অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীসহ বড় বড় শহরের অধিকাংশ ঘরবাড়ি ভূমিস্মাৎ হয়ে যাবে, ঘটবে চরম মানবিক বিপর্যয়। বজ্রপাত এদেশে কেন, কোনো দেশেই নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইদাংনিকালে গোটা বিশ্বেই বজ্রপাত ও তাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে একেবারে তালিকার চূড়ায়। বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বজ্রপাত সবচেয়ে বেশী হয়। প্রাণহানির সংখ্যাও বেশী। গোটা বিশ্বে প্রতিবছর বজ্রপাত যত মানুষ মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় বাংলাদেশে।
প্রকৃতির উপাদানের ওপর যত অত্যাচার, অনাচার ও পীড়ন চলবে প্রকৃতি ততই বিরূপ হবে এবং তার প্রতিক্রিয়াও হবে তত ব্যাপক ও বিধ্বংসী। ফের পাহাড়ের কথায় আসা যাক। পাহাড়কে আমরা লাগাতার ক্ষতি ও ধ্বংস করে যাচ্ছি। তার প্রতিফলও আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, পাহাড় বিনাশ ও ধ্বংস হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক বিন্যাস ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। এর খেসারত আরও দীর্ঘ মেয়াদে বড় আকারে আমাদের দিতে হতে পারে। আশংকার এদিকটি বিবেচনায় রেখে পাহাড় দখল, কাটা, গাছপালা কর্তন, বসতি স্থাপন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ে ও তার পাদদেশে যত বস্তি গড়ে উঠেছে তা উচ্ছেদ করতে হবে। বস্তিবাসীদের অন্যত্র পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আল্লাহপাক ভূমিকে বিছানা ও পাহাড়-পর্বতকে পেরেক হিসাবে তৈরি করেছেন। এ থেকে এটি স্পষ্ট, জমিনের স্থিতিস্থাপকতা রক্ষার জন্যই পাহাড় সৃষ্টি করা হয়েছে। পাহাড় যদি না থাকে তবে জমিনের স্থিতিস্থাপকতাও থাকবে না। সেটা হবে একটা ভয়ংকর অবস্থা। কাজেই পাহাড় রক্ষায় জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে। খবর বেরিয়েছে, আগামীতে বৃষ্টিপাত বেশি হতে পারে এবং সেই সঙ্গে ঢল। সে বাস্তবতায় পাহাড় ধস ও প্রাণহানি আরো হতে পারে। সুতরাং, এখনই পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে লোকদের অনতিবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে। তাদের আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে। স্থায়ী পুনর্বাসনের কথাও চিন্তা করতে হবে।



 

Show all comments
  • S. Anwar ২২ জুন, ২০১৭, ১০:৫১ পিএম says : 0
    বাংলাদেশের একমাত্র জেলা শহর রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই হ্রদের কারনে যার পুরোটাই পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত। মানিকছড়ি নামক জায়গাটি পার হয়ে গেলে আর কোথাও বিন্দুমাত্র সমতল জমি চোখে পড়ে না। তাই রাঙ্গামাটি শহরের যে কোন এলাকায় ঘর বাঁধতে গেলে পাহাড় না কেটে কোন উপায় নেই। এখানে আরো একটা অতি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো ভৌগলিক কারনে রাঙ্গামাটির পাহাড়গুলো অন্যান্য এলাকার পাহাড়ের তুলনায় এতোবেশী খাড়া যে, খালি শরীরে একজন লোকের সোজা উপরের দিকে বেয়ে উঠাও দুঃসাধ্য। তাই অতি বৃষ্টি কিংবা ভূমিকম্পে যে কোন সময় পাহাড় ধসের সম্ভাবনা খুবই ব্যপক। এখানে গৃহায়ন তথা আবাসনের জন্য সুনির্দিষ্ট সরকারী পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রনয়ন অতি জরুরী বলে মনে করি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ