Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

এই বাজেট জনগণের সঙ্গে বিরাট ধাপ্পাবাজির বাজেট : মির্জা ফখরুল ইসলাম

প্রস্তাবিত বাজেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি

| প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ও আগামী অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জনগণের সঙ্গে সরকারের বিরাট অংকের ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাজেট প্রস্তাবকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি
অর্থমন্ত্রী গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপনের ১০দিন পর গতকাল রোববার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বাজেট নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয় বিএনপি। দলের সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতি ও অংশ গ্রহণে সেই প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেটকে প্রত্যাখ্যান করেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৫ শতাংশ ভ্যাটের হার কমিয়ে ‘সহনীয় পর্যায়ে আনা’ এবং ব্যাংক আমানতের ওপর বর্ধিত হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব বাতিলের দাবি জানান। তিনি বলেন, বাজেটে উপেক্ষিত থেকেছে মানবসম্পদ খাত, এমনকি কৃষিও। প্রাধান্য পেয়েছে চোখ ধাঁধানো কিছু মেগা প্রকল্প। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় ও জনকল্যাণমূলক খাতসমূহকে অবহেলা করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এটা নিছক বিরাট অংকের প্রচারণার ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। এটা মানুষকে বোকা বানানোর বাজেট। এটা প্রতারণার বাজেট। ফখরুল বলেন, বাজেট দেখে তার মনে হয়েছে, কল্যাণমুখী লক্ষ্যগুলো অর্থমন্ত্রীর বিবেচনায় আসেনি। এই কারণে আমরা আশাহত ও ক্ষুব্ধ। জনগণের কাছে সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই বলেই এই বঞ্চনার বাজেট জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই বাজেট আমরা প্রত্যাখান করছি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ঝুঁকির শঙ্কা প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, বাজেটের কিছু কিছু প্রস্তাব দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে বলে তারা মনে করছেন। তিনি বলেন, লোকের চোখে দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে গিয়ে, দ্বিগুণ চারগুণ অর্থ ব্যয় করে একদিকে সম্পদের অপচয় ঘটানো হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণের স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে না। প্রকল্প ব্যয়ে স্বচ্ছতা নেই, ব্যয়ের গুণগত মান বজায় রাখা হচ্ছে না। এই বাজেটে ব্যয়ের গুণগত মান বাড়ানোর কোনো দিক নির্দেশনা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, বিদায়ী বছরের তুলনায় এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) আকার আসন্ন অর্থবছরে ৩৮ দশকি ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এক লাফে ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি অলীক ও অবাস্তব। একদিকে প্রস্তাবিত বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় জিডিপির আকারের ১০ দশমিক ৮ শতাংশ, অন্যদিকে উন্নয়ন ব্যয় জিডিপির ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে অতীতের ধারায় অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রাধান্য অব্যাহত থাকছে।
ফখরুল বলেন, এতো বিশালাকারের বাজেটেও ওই ধারা ভাঙা সম্ভব না হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করছে বিএনপি। বাজেট ঘাটতি পূরণে বিদেশি উৎস থেকে প্রাপ্তি ৮০ শতাংশ বেশি হবে বলে যে প্রত্যাশা অর্থমন্ত্রী করেছেন, তা অসম্ভব ও কল্পনাপ্রসূত বলে মন্তব্য করেন ফখরুল।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, মনে হচ্ছে, বাজেট প্রণয়নকারীরা নিছক হিসাবের অংক মেলাতে গিয়ে তাদের পছন্দসই সংখ্যাটি বসিয়ে দিয়েছেন। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মন্তব্য করেছে, অর্থায়নের সব উৎস দেখার পর যখন ব্যয়ের হিসাব মিলছে না, তখন পুরোটাই বৈদেশিক সাহায্য থেকে আসবে বলে ধরে নিয়ে যোগ করে দেয়া হয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসেব দিয়েছে, খাদ্যশস্য উৎপাদন এবার ২.৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রশ্ন হল, ধান উৎপাদন যদি আগের বছরের বাম্পার ফলনের চেয়ে ২.৫ শতাংশ বাড়ে, তাহলে দাম এতো চড়া কেন? বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে চালের দাম ৪৮ টাকা হয়ে যাওয়ায় প্রায় ২ কোটি নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে। একইসঙ্গে সরকার কৃষিখাতে ধনাত্মক প্রবৃদ্ধির যে সম্ভাবনার কথা বলেছে তাও বাস্তবসম্মত নয়।
টানা দ্বিতীয় বছরের মত বাংলাদেশের সাত সতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকে সরকারের পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি হিসেবে দেখছেন ফখরুল। তিনি বলেন, সরকার পরিসংখ্যানজনিত বিভ্রাট ঘটিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। প্রশ্নবিদ্ধ জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে নীতিনির্ধারকরা এক ধরনের আত্মতুষ্টির রোগে ভুগছেন।
স¤প্রতি প্রকাশিত গেøাবাল ফাইনানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা জিডিপির চার শতাংশের মত। এই পাচার হওয়া টাকার একটি বড় অংশ হলে অবৈধ উপায়ে অর্জিত কালো টাকা। আমরা মনে করি, পাচার হওয়ার পেছনে কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেশে বিনিযোগের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দেশের অর্থনীতির প্রতি আস্থার অভাব এবং দেশের বাইরে একটি নিরাপদ বলয় তৈরি করে রাখা, যাতে সুযোগ মত বেরিয়ে যাওয়া যায়। ব্যাংকিং খাতের করুণ অবস্থায় লুটের টাকার একটি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করাও এর উদ্দেশ্য। বিদেশে বাংলাদেশের এত অর্থ চলে যাচ্ছে, অথচ সরকার একেবারেই নীরব, কোনো উদ্যোগ তাদের নেই।
ঘাটতি পূরণে বাজেটে জনগণের ওপর বাড়তি করারোপের প্রস্তাবের সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, সামগ্রিক বিবেচনায় বাজেটে কর কাঠামো অত্যন্ত পশ্চাদমুখী। বেশিরভাগ কর আসবে পরোক্ষ সূত্র থেকে। পরোক্ষ করের বোঝা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সব শ্রেণির ভোক্তাদের ওপর সমান হারে বর্তায়। এই ধরনের কর জনকল্যাণবিরোধী।
মির্জা ফখরুল মূল্যস্ফীতির নিরিখে আয়করের সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ এবং কৃষি যন্ত্রপাতির শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানান। তিনি বলেন, বাজেটের আকার বাড়লেও আনুপাতিক হারে কৃষিতে ভুর্তকি বাড়েনি।
ফখরুল বলেন, প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ। এবারের বাজেটে আরোপিত ভ্যাট প্রায় সব পণ্যের ওপর প্রযোজ্য। তবে অর্থমন্ত্রী মানুষকে বোকা বানানোর জন্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের লম্বা তালিকা যোগ করে বাহাবা কুড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এগুলোর মধ্যে জীবন্ত ঘোড়া, খচ্চর, শুকরের মাংস, টার্কি ও বিভিন্ন জীবন্ত পক্ষীসহ বেশ কিছু পণ্য সামগ্রী রয়েছে। বেশ কিছু পণ্য রয়েছে, যেগুলো দেশের সাধারণ মানুষ আদৌ ব্যবহার করে না। এভাবে শুন্য ভ্যাটের তালিকা একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, উচ্চহারে ভ্যাট আহরণের ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে, মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ ভয়ানক দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে বলে আমরা মনে করি। আমরা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ ভ্যাটের হার সহনীয় পর্যায়ে হ্রাস করার দাবি জানাচ্ছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যেভাবে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের পকেট থেকে জোর করে অর্থ আদায়ের মত। অতীতে যেভাবে ইংরেজরা জোরপূর্বক কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করত, ঠিক সেভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হয়েছে। একইভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই পণ্যের ওপর বার বার ট্যাক্স দিতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, বিএনপির সময়ের বাজেটগুলো দেখবেন- অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় উন্নয়ন খাতের ব্যয়ের তুলনায় শতকরা হারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আমরা রেখেছি। আর এখন বাজেটে অনুন্নয়ন খাতের ব্যয় বেশি রাখা হয়েছে বলেই তা কখনো স্বাস্থ্যকর বাজেট হতে পারে না। এখন আনপ্রোডাক্টিভ খাতে ব্যয় মেটানোর জন্য কী করতে হয়েছে সরকারকে? দরিদ্র মানুষের ওপর করের বোঝা চাপাতে হয়েছে। এটা অত্যন্ত আনহেলদি ট্রেন্ড।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাজেটে যে প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। বাস্তবতা হচ্ছে, গত কয়েক বছরে সাধারণ মানুষের সত্যিকারের আয় কমে গেছে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে আয় তো বাড়বে, সেটা তো হচ্ছে না।
খসরু বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করার খরচ অনেক বেশি। চাঁদাবাজী, দুর্নীতি, আর্থিকখাতে অব্যবস্থাপনার কারণে এখানে ব্যবসা থেকে আয় কমে গেছে। এর ফলে বিনিয়োগ হচ্ছে না, টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ, রিয়েল ইকোনমি পারফর্ম না করার কারণে পুরো চাপটা চলে যাচ্ছে জনগণের ওপরে, যেটা ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারী শুল্ক ইত্যাদি ইত্যাদি
বিএনপির আনুষ্ঠানিক বাজেট প্রতিক্রিয়ার এ সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট

১৩ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ