Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বিলুপ্তির পথে লাঙ্গল জোঁয়াল মই ও হালের বলদ

| প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আদমদীঘি (বগুড়া) উপজেলা সংবাদদাতা ঃ ফজরের নামাজের সাথে সাথে কৃষকেরা লাঙ্গল, জোঁয়াল কাধেঁ নিয়ে গুরুর সাথে যা যা হাঁঠ হাঁঠ কথা বলতে বলতে জমি চাষতে মাঠে যেত। কালের বিবর্তনে কৃষকের কাঁধে আর হাঁল উঠেনা। আগেরমত চাষীদের নামে কৃষাণীদের পান্তা নিয়ে যাওয়ার দৃর্শ্য আর চোখে পরেনা। সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা” এমনটাই লিখেছিলেন রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী তার ‘চাষী’ কবিতায়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কবিতাগুলোর সাথে বাস্তবতার এখন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায় পশ্চিম বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা ও এর আশপাশ এলাকার মানুষ দিন দিন যন্ত্র নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কৃষি নির্ভরশীল এবং সূতা দিয়ে কাপড় তৈরীতে বেশ খ্যাতি ও সুনাম করলেও এখানকার ৯০ ভাগ মানুষই এক সময় কৃষি নির্ভরশীল ছিল।
কৃষি কাজ করার জন্য যেসব ধারণা, পদ্ধতি, যন্ত্র বা জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলোই হচ্ছে কৃষি প্রযুক্তি। কতগুলো প্রযুক্তি আছে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখন তার স্থান দখল করে নিচ্ছে নতুন প্রযুক্তিগুলো। প্রাচীনকালের লাঙ্গল, জোঁয়াল কৃষি যন্ত্র হলেও আদমদীঘি ও আশপাশ এলাকায় এর ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। জমি চাষের কাজে এ উপজেলাসহ এর আশপাশের কৃষকেরা এক সময় কাঠের তৈরী লাঙ্গল, জোঁয়াল, মই ও হালের বলদ ব্যবহার করতো। ফসলি জমিতে চাষাবাদের জন্য এসব কৃষি উপকরণ হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহার করে এসেছে কৃষকরা। কৃষকরা ফজরের আজানের সাথে সাথে কাঁধে লাঙ্গল, জোঁয়াল নিয়ে গরুর সাথে সাতে যা-যা হাঁঠ হাঁঠ কথা বলতে বলতে জমি চাষতে মাঠে যেত। কিন্তু কালের বিবর্তনে কুষকের কাঁধে আর লাঙ্গল জোঁয়াল উঠেনা। ঐতিহ্যবাহী লাঙ্গল, জোঁয়ালের ব্যবহার প্রায় বিলুপ্তির পথে। পরিবেশ বান্ধব লাঙ্গল-জোঁয়ালের স্থান দখল করে নিয়েছে পরিবেশ ও শব্দ দূষণকারী আধুনিক প্রযুক্তির তৈরী যান্ত্রিক পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর। আগে লাঙ্গল-জোয়াল ছাড়া চাষাবাদের কথা চিন্তাই করা যেতনা।
বর্তমান আধুনিক যুগে যুগের সাথে তাল মেলাতে চাষাবাদের জন্য ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলারের মতো যান্ত্রিক সব উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে কৃষক যেমনি উপকৃত হয়েছে তেমনি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণ, শব্দ দূষণ ও বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কৃষি শ্রমিকের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে যন্ত্রচালিত কৃষি উপকরণগুলো। আর এসব আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে চাষাবাদে আগের তুলনায় সময়, শ্রম এবং অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে কৃষক আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে চাষাবাদ করে জমিতে ফসল ফলাচ্ছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লাঙ্গল, জোঁয়াল, মই আর হালের বলদ। বর্তমানে আদমদীঘি উপজেলার প্রায় সব কৃষকই জমি চাষের জন্য পাওয়ার টিলার তৈরী বা ট্রাক্টর ব্যবহার করে থাকে। এখন লাঙ্গল জোঁয়াল তৈরীর ভরা মেীসুম। জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে কৃষকরা হাঁট বাজার থেকে নতুন লাঙ্গল জোঁয়াল হারচাষের জন্য প্রস্তুত করতো এবং পুরাতনগুলো ঠিকঠাক করে নিত। লাঙ্গল-মইসহ কৃষি সরঞ্জাম তৈরি করা  এ পেশায় যারা জড়িত তাদের অনেকেই বাপ দাদার এ আদি পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আর যারা এখনো কস্ট করে এ পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছেন তারাও ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। একদিন হয়তো লাঙ্গল তৈরির পেশায় থাকা ব্যক্তিরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই কাজকে পেশা হিসেবে নিতে আর আগ্রহ প্রকাশ করবে না। নতুন পেশা খুঁজে নেবেন তারা। বগুড়া জেলার আদমদীঘি ও আশপাশের উপজেলাগুলোতে কম বেশি সব গ্রামেই দেখা যেতো লাঙ্গল, জোঁয়াল ও হালের বলদ কিন্তু এখন আর চোখে পড়ে না।
উপজেলার কেশরতা গ্রামের কৃষক আব্দুল গফুর জানান, লাঙ্গল, জোয়াল, মই এখন আর তেমন একটা কাজে আসে না। তিনি আরো বলেন এখন শুধুমাত্র বীজতলা তৈরী করার জন্য লাঙ্গল- জোঁয়াল ব্যবহার করে থাকি। আধুনিক সভ্যতা থেকে পরিবেশ বান্ধব লাঙ্গল-জোঁয়ালের জায়গা দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরসহ বেশ কিছু মেশিন।
উপজেলার করজবাড়ি গ্রামের কৃষক আনু মিয়া বলেন, আগে লাঙ্গল, জোয়াল, মই ও হালের বলদ দিয়ে জমি চাষাবাদ করে কৃষকেরা যে আনন্দ পেত এখন আর তা নেই। তবে বাপ-দাদার সেই পুরোনো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য এখনো বাড়িতে লাঙ্গল, জোয়াল, মই ও হালের বলদ রাখা হয়েছে এবং মাঝে মধ্যে ব্যবহার করি। কৃষি কাজের সাথে জড়িত অনেকে বলেন উৎপাদিত কৃষি পণ্যের উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় কৃষকরা অনেকটা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে কৃষি কাজের প্রতি। জমিতে ভালো মানের বীজ কিংবা সার কীটনাশকের ব্যবহার কম হওয়াতে ফসলের উৎপাদনও কম হচ্ছে। এক্ষেত্রে জাতীয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এখন প্রয়োজন দ্রæত কৃষিখাতে নজর দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। অন্যথায় খুব শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়বে এই উপজেলাসহ এই এলাকার কৃষি শিল্প।




 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ