বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
পৃথিবীর যে কয়টি পূরাকীর্তির তালিকা রয়েছে তার মধ্যে পাহাড়পুরের উল্লেখ রয়েছে। মানব সভ্যতার এগুলো প্রধান সোপান। প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিল্প, সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক জীবন ধারায় ইতিহাস বিনির্মাণে যে কটি প্রতœস্থান বিশেষভাবে বিবেচ্য তার মধ্যে পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহারটি অন্যতম। আমাদের গর্ব আর অহংকার এই পাহাড়পুর। ইউনেস্কো কর্তৃক এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃত।
প্রতিদিন শত শত মানুষ প্রাকৃতিক সবুজঘেরা অসাধারণ এক স্থাপত্য কীর্তি দেখতে ছুটে যান। আসুন আজ আমরা ঘুরে আসি ঐতিহাসিক পাড়ারপুর বৌদ্ধবিহার।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৪ কিমি উত্তরে বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুরে এই বৌদ্ধবিহার অবস্থিত। এই পাহাড়পুরের আদি নাম ছিল সোমপুর। পাল বংশের রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে আনুমানিক (৭৭৫-৮১০ খ্রি.) এ বিহার নির্মাণ করেন। মোট ২৭ একর জমির উপর সোমপুর বিহার অবস্থিত। এটি এশিয়ার বৃহত্তম প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। বিহারের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। মূল দালানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ১৭৭টি কক্ষ ছিল। ৮০০ ভিক্ষু বসবাসের উপযোগী ছিল এই বিহার। সোমপুর বিহার এশিয়া বিশেষ করে ব্রক্ষদেশ ও জাভার স্থাপত্য কলাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এ বিহারটি ধ্বংস হয়ে প্রায় ৪০ একর জমি জুড়ে রূপ নিয়েছিল অনুচ্চ পাহাড়ের। এই বিশাল ঢিবি পাহাড়ের মতো লাগতো বলে স্থানীয় লোকেরা পাহাড়পুর নামে আখ্যায়িত করে। সোমপুর নামটি হারিয়ে যায়।
খনন কার্যের ফলে সোমপুর বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলার প্রাচীন জনপথ বরেন্দ্র অঞ্চলের শিল্প, শিক্ষা, ধর্ম, অর্থ প্রভৃতি বিষয়ের সাক্ষ্য-চিহৃস্বরূপ বহু মূল্যবান প্রতœসামগ্রী আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে প্রাচীন মুদ্রা, অলংকৃত ইট, পোড়ামাটির ফলক, ৬৩টি প্রস্তর ভাস্কর্য, তা¤্র ও প্রস্তর লিপি ধাতব মূর্তি প্রভৃতি অন্যতম।
বৈদিক যুগের গুরুগৃহকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি বিবর্তিত হয়ে উপমহাদেশীয় প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থায় বিহার ও সংগ্রামকেন্দ্রিক শিক্ষার যে সূচনা ঘটে সোমপুর বৌদ্ধবিহার সে অর্থে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছে। বিশ্বমানের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বাংলার প্রাচীন জনপথ বরেন্দ্র অঞ্চল যে বিহারভিত্তিক বিদ্যা ও জ্ঞানশীলনের পীঠস্থান ছিল তা আজ প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। ভারতবর্ষে নালন্দা, শালবন, তক্ষশীলা প্রভৃতির ন্যায় সোমপুর বৌদ্ধবিহারও আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষাদান ও জ্ঞানচর্চার অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে চীন, তিব্বত প্রভৃতি দূর দেশ থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিদ্যার্জনের জন্য আসতেনÑতা আজ ইতিহাস স্বীকৃত। ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি আর ধর্মীয় সহনশীলতার প্রকৃষ্ট ঐতিহ্য স্মারক পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহার ও তৎসংলগ্ন জ্ঞান বিদ্যাচর্চার পীঠস্থানগুলোর অবদান অসামান্য।
বর্তমান পাহাড়পুরকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ‘সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম-ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)’-এর অর্থায়নে পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে পাহাড়পুরের উন্নয়ন কর্মকা- এখন শেষ পর্যায়ে।
পুরাতনের আদলে সোমপুর বৌদ্ধবিহারকে নতুনভাবে সংস্কার করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে ফুড কোর্ট, রেস্টহাউজ। আয়োজন করা হয়েছে দেশীয় খাদ্যের। তৈরি করা হয়েছে সেডের নিচে বসার জায়গা। প্রাচীন দিনের ঐতিহ্যের আলোকে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। দেয়া হয়েছে স্থানীয় মহিলাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ। পর্যটকদের বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকদের বিনোদনের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে নৃতাত্ত্বিক শিল্পীগোষ্ঠী।
পৃথিবীর প্রাচীনতম শিক্ষা নগরীর অন্যতম প্রাচীন বাংলার বিশ্ববিদ্যালয় পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহার আপনাকে মুগ্ধ করবে।
লেখক : বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের সাবেক মহাব্যবস্থাপক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।