Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

লবণাক্ততার চ্যালেঞ্জে উপক’লের ৩ কোটি মানুষ কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ও পরিবেশ হুমকির মুখে

| প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম


কোন দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে না : খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস

আবু হেনা মুক্তি, খুলনা থেকে : কৃষি নির্ভর অর্থনীতির জন্য উপকূলীয়াঞ্চলে লবণাক্ততা জনজীবনে ক্যান্সারের মত। ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে সবুজ বেষ্টনী। লবণাক্ততার সাথে যুদ্ধ করে জীবনযুদ্ধে টিকে আছে উপকূ লের প্রায় ৩ কোটি মানুষ। তাদের চ্যালেঞ্জ প্রকৃতি প্রতিবেশ আর লবণাক্ততার সাথে। কালজয়ী এসব মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বিভিন্ন সময়ে সভা সমাবেশ সেমিনার ওয়ার্কশপে মিটিং সিটিং ইটিং হয়। মিডিয়ায় প্রচার হয় ফলাও করে। কিন্তু লবণাক্ততার বিষয়ে বিশেষ কোন দীর্ঘ মেয়াদী মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
লবণাক্ততায় ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থিত পানি এবং মাটিকে এমনভাবে লবণায়ন করে যা খুলনাঞ্চলের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য চরম হুমকি সরূপ। জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততার ক্ষীপ্রতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা ভবিষ্যতে উপকুলবাসীর জন্য শুধু মানবিক বিপর্যয় নয় তা কাল হয়ে দাড়াতে পারে। লোনা পানিতে কোথাও কোথাও মৎস চাষ হলেও লোনা পানির কারণে এ অঞ্চলের জীবনযাত্রা এখন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত। এমনকি সুন্দরবনও হুমকির সম্মুখীন। বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে বিশেষ সমীক্ষা বা প্রকল্প হাতে না নেয়ায় এবং যত সামান্য ক্ষুদ্র প্রকল্পগুলো যেনতেন ভাবে বাস্তবায়িত করায় সমস্যার কোন দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। বরং ক্রমাগত ঝুকির মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে নানাভাবে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে।
সূত্রমতে, সিটিএসএলআর এর এক গবেষণায় বলা হয়, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এ যাবৎকারের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী মানবসৃষ্ট এক বিশ্বগ্রাসী দুর্যোগের মোকাবেলা করতে হবে সেটা হলো জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বিশ্বগ্রাসী এই দুর্যোগের অনিবার্য পরিণতিতে লবন আগ্রাসনে পিষ্ট হবে উপকুলের ৩ কোটি মানুষ এবং তাদের জীবন-জীবীকা এবং অর্থনীতি। খুলনা ও বাগেরহাটে পানি স্বল্পতার মৌসুমে ভূমির লবণাক্ততার মাত্রা থাকে ৮ থেকে ১৫ ডিএস/এম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানি স্বল্পতার মৌসুমে লবণাক্ততার বিস্তার অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
অনুমিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট লবণাক্ততা তিনটি স্তরে প্রভাব বিস্তার করবে। এগুলো হলো ভূ উপরিস্থিত পানি, ভূ গর্ভস্থ পানি এবং মাটি। সৃষ্ট মাটির লবণাক্ততা আশঙ্কাজনকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস করবে। ইতিমধ্যেই লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় ভূমি খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষমতা কমে গেছে যা অনুমতি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিস্থিতি আরো সংকটময় করে তুলবে। একটি মডেল স্টাডিতে নির্দেশ করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শীতের মৌসুমে শুষ্কতা আরো বাড়বে। সেক্ষেত্রে শুষ্কতাজনিত কারণে পাইপ দিয়ে পানি টেনে আনা বেড়ে গেলে জমির লবণাক্ততার সমস্যা আরোও ঘনীভূত হবে। জানা যায়, বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ১২০ থেকে ১৬০ কি:মি: ভেতর পর্যন্ত লোনা ও স্বাদু পানি পাশাপাশি অবস্থান করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে এটা উত্তরের দিকে অগ্রসর হয়ে যশোর অঞ্চল পর্যন্ত চলে আসতে পারে।
নদী ও মোহনা দিয়ে স্রোত ঢুকে পড়ার ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। উজানের স্বাদু পানির প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে আসার ফলে এ সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। একটি মাস্টারপ্ল­ান সংস্থার ধারণা অনুযায়ী, উপকূলীয় এবং তীরবর্তী এলাকার ১৪,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় লবণাক্ত মাটি রয়েছে এবং এগুলো জলোচ্ছ¡াসজনিত প্ল­াবনে ক্ষতিগ্রস্ত। এ অবস্থায় যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়ে তাহলে আরো ১৬,০০০ বর্গকিলোমিটার উপকূলীয়  ভূমি তলিয়ে যাবে এবং লবণাক্ততা আরো ভেতরে দিকে অগ্রসর হবে।
দক্ষিণাঞ্চলে ও মোহনার পোল্ডারগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে লবণাক্ততার মাত্রা পরিবর্তন হতে পারে। এই পোল্ডারগুলোর নির্মান কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে উপকূলীয়  বেড়িবাধ প্রকল্পের আওতায়। যার লক্ষ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রন ও লবনাক্ত পানির বিস্তার রোধ। যেহেতু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার ফলে লবণাক্ত পানির আগ্রাসন বাড়ে আর অন্যদিকে বৃষ্টিপাতের ফলে লবণাক্ততা হ্রাস পায়, কাজেই পোল্ডারগুলো অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শস্যভূমিতে নেট প্রভাবের মাত্রা থাকে অনির্দিষ্ট। বেশকিছু স্টাডিতে দেখানো হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্লাবন, নদীর পানির স্রোতে পরিবর্তন, সাইক্লোন ও উপকূলীয়  বেড়িবাধ ইত্যাদির মিলিত প্রভাবের কারণে উপকূলীয়  অঞ্চলের দুর্দশা সংকটাপূর্ন হবে।
লবণাক্ততার প্রভাবে অনুমতি আশংকার মধ্যে রয়েছে, লবণাক্ত জমির বিস্তৃতি এবং লবনের ঘনত্বও বাড়া। এছাড়াও কৃষি জমির প্রাপ্তি/উৎপাদন হ্রাস, প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে যাতে কিনা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে। নিরাপদ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। শহরে গ্রামে সর্বত্র পানির জন্য হাহাকার দেখা দিবে। জীববৈচিত্র ধ্বংস হবে। ফলে উদ্ভিদ প্রজাতি ও স্বাদু পানির মাছ হ্রাস পাবে। আর্থসামাজিক সমস্যা তীব্রতর হবে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা আরো সংকটে পড়বে।
সূত্র বলছে, লবণাক্ততায় উপকুলের মৎস্য উৎপাদনকেও হ্রাস করবে। মাছের অনেক প্রজাতির জন্যই পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্তাত বৃদ্ধি সহনীয় নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মাছ চাষের জন্য স্বাদু পানির এলাকা হ্রাস করার মধ্য দিয়ে মৎস্য উৎপাদন ব্যহত করবে। উপকূলীয়  এলাকাগুলোতে পুকুরে লবণাক্ত পানির বিস্তারের মাধ্যমে পুকুরে মাছ চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। উপকূলীয়  এলাকায় চিংড়ি ঘের একটি লোভনীয় ব্যবসা হলেও লবণাক্ততা বৃদ্ধির তীব্রতায় চিংড়ি চাষও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। গত কয়েক দশক ধরে সামুদ্রিক আর লোনা পানির মাছে প্রতি অনেক মনোযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তণ এগুলোও শেষ করে দিতে পারে। স্বল্প নদীর স্রোত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও সমুদ্রগর্ভে ভূমির বিলীন হবার কারণে নদীর মোহনা ও ভূগর্ভস্থ পানির মধ্যে লবণাক্ত পানির বিস্তার আরো বাড়বে। লবণাক্ত পানির বিস্তারের বাজে প্রভাব উপকূলীয়  কৃষির উপর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাড়বে এবং নিত্য ব্যবহার ও শিল্প কারখানার কাজে প্রয়োজনীয় স্বাদু পানির প্রাপ্যতা দুরূহ হয়ে পড়বে।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং উপকূলীয়  ভূমি ধান চাষের জন্য অত্যন্ত উর্বর হলেও বর্তমানে লবণাক্ততার বিস্তার ও ভূমির লবণাক্ততা কৃষির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উপকূলীয়  ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে মোট ৯ মিলিয়ন হেক্টর আবাদী জমির ২দশমিক৮ মিলিয়ন হেক্টর লবণাক্ত হয়ে পড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ