Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অথঃ চিকুনগুনিয়া-ডেঙ্গু ও স্লিপ টেস্ট : চিকিৎসা ব্যয়ে আকাশ-পাতাল তফাৎ

| প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোবায়েদুর রহমান : গত ১৬ মে মঙ্গলবার আমি চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হই। আজ ২৪ দিন হয়ে গেল, মনে হচ্ছে হয়তো অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার ডেঙ্গু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান ড. প্রফেসর নজমুল আহসানের কাছে আমি মেডিসিন সংক্রান্ত চিকিৎসা করাই। তার চেম্বার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আরেক জন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছেও আমি এ সংক্রান্ত চিকিৎসা করাই। তিনি হলেন ড. প্রফেসর এফ এম সিদ্দিকী। এবার যখন অসুস্থ হলাম তখন ডক্টর সিদ্দিকীকে টেলিফোন করার পর  জানতে পেলাম, তিনি দেশে নেই, আমেরিকা গেছেন। আমি আরেকজন বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা করাই। তিনি বক্ষ্য ব্যাধি হাসপাতালের  সাবেক পরিচালক ডক্টর প্রফেসর রাশেদুল হাসান। তার খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনিও ঐ  একই সময় আমেরিকা আছেন। গেলাম ডক্টর নজমুল আহসানের নিকট। তিনি পপুলারেই আমার রক্ত পরীক্ষা করালেন। ডেঙ্গু টেস্টে দেখা গেল আমার ক্ষেত্রে এটা নিগেটিভ। তখন প্রফেসর নজমুল আহসান বললেন, যেহেতু আপনার  ডেঙ্গু টেস্ট নিগেটিভ , তাই আপনার চিকুনগুনিয়া হয়েছে বলে  আমার সন্দেহ হচ্ছে। সুতরাং তিনি আমাকে কলেরা হাসপাতালের পাশে কাঁচা বাজারের গলি দিয়ে প্রলম্বিত রাস্তায় অবস্থিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠালেন। ওখানে চিকুনগুনিয়া টেস্ট করা হয়। কিন্তু সেখানে রয়েছে একটা ফ্যাকড়া। আক্রান্ত হওয়ার চার দিনের মধ্যে যদি আপনি পরীক্ষা না করান  তাহলে আপনার পরীক্ষা তারা আর নেবে না। তবে নিতে পারে যদি আপনি ১৭ হাজার টাকা ফি দেন। আমাকে যেহেতু প্রফেসর নজমুল আহসান পাঠিয়েছেন, তাই আমাকে ঐ ১৭ হাজার টাকা খাতির  করা হলো। তিন দিন পর টেস্ট রিপোর্ট পেলাম। দেখা গেল ডেঙ্গু নিগেটিভ, চিকুনগুনিয়া পজেটিভ। আমার আপন বড় ভাইও ডাক্তার। তিনি অবশ্য আমাকে আগেই বলেছিলেন যে, তোমার ডেঙ্গু হয়নি। ২০০৮ সালে তোমার একবার ডেঙ্গু হয়েছিল। সেটি ছিল সিরিয়াস ডেঙ্গু। হেমোরেজিক ডেঙ্গু। বারডেমের পরিচালক প্রফেসর ড. একে আজাদ খান সেবার আমাকে কোন রকম টেস্ট না করেই বলেছিলেন যে, তোমার ডেঙ্গু হয়েছে। তিনি আমার বড় ভাইয়ের ক্লাসমেট আর সেই সুবাদে আমার বড় ভাই। এক ঘন্টার মধ্যেই আমার  এ্যাডমিশন এবং ক্যাবিনের ব্যবস্থা হয়ে গেল।  ৭ দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে আল্লাহর মেহেরবাণীতে ঘরে ফিরে এলাম।
এখনও আমি অসুস্থ। তবু আমি লিখছি। কারণ আমি নিজের হাতে লিখতে পারি না। আমার যখন চাকরী জীবনের শুরু হয় তখন থেকে আমি একজন   স্টেনোগ্রাফার পাই। সেই থেকেই আমি ডিক্টেশন দেওয়ায় অভ্যস্ত। নিজের হাতে লিখতে পারি না। নিজে লিখতে গেলে  ধারাবাহিকতা এলোমেলো হয়ে যায় এবং পয়েন্ট  গুলো হাবিজাবি হয়ে যায়। কিন্ত আজকে এত ব্যক্তিগত কথা লিখছি, দু তিনটি পয়েন্ট আপনাদেরকে জানানোর জন্য। প্রথম কথা হলো, ঢাকায় যখন এবার  চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে তখন পত্র পত্রিকায় এর রোগ নিয়ে খুব লেখালেখি শুরু হয়। অনেক মেডিসিন বিশেষজ্ঞই পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কে লেখেন। টেলিভিশনের টক’শোতেও এটি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ছাড়া আর কোথাও চিকুনগুনিয়ার টেস্ট করানো হয় না। তবে পপুলারের কাস্টমার সার্ভিসের জেনারেল ম্যানেজার আমাকে জানান, শীঘ্রই তারা চিকুন গুনিয়া টেস্ট চালু করতে যাচ্ছেন। তবে খরচ নাকি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা  পড়তে পারে। এখন পাঠক, আপনারাই বলুন, বাংলাদেশের গরীব এবং মধ্যবিত্তদের মধ্যে কয়জন মানুষ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে চিকুনগুনিয়া টেস্ট করতে পারে। অথচ এটি এমন একটি টেস্ট যা করাটা অত্যন্ত জরুরি।
চিকুনগুনিয়ায় ডাক্তার সাহেবরা বলেন যে, এই রোগের কোনো চিকিৎসা নাই। এক মাত্র চিকিৎসা হলো রেস্ট নেওয়াও লিকুইড খাওয়া। এ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া সাংঘাতিকভাবে নিষিদ্ধ। এর বেশ কয়েক বছর আগে প্রথম যখন ডেঙ্গু এদেশে আসে তখন ডেঙ্গু সম্পর্কে চিকিৎসকদেরও ভালো ধারণা ছিল না। এ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে অনেক  অবস্থাপন্ন রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন  হয় এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের সিংগাপুর নেওয়া হয়। তার পরে অন্তত দু জন রোগীর কথা জানি যাদেরকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তার পর থেকেই লিকুইড এবং  নাপা তথা প্যারাসিটামল এই রোগের একমাত্র ঔষধ হয়ে দাঁড়ালো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাল্টা বা কমলার জুস ,লেবুর শরবত, স্যালাইন এগুলোর উপর চলতে হবে।
\দুই\
ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনয়িার একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ডেঙ্গুর জ্বর ৭ দিন পর্যন্ত থাকে। চিকুনগুনিয়ার জ্বর ৩-৪ দিনের মাথায় ছেড়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে চিকুনগুনিয়ার নতুন একটি উপসর্গ দেখা দেয়, যেটি অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে কিনা আমি জানি না। সেটি হলো, বিরতিহীন হিক্কা বা হিকাপ। এই হিক্কা তাড়ানোর কোনো ঔষধ ডাক্তার আমাকে দেন নি। হিক্কা তাড়ানোর যে সাধারণ কৌশল রয়েছে আমার ক্ষেত্রেও সেটি প্রয়োগ করতে বলা হয়। আর সেটি হলো অকস্মাৎ এ্যাটেনশন ডাইভার্ট করা।
৫ম দিনে আমার হিক্কা চলে যায়। কিন্তু চিকুনগুনিয়ার যে সাধারণ কষ্ট সেটি শুরু হয়। সেটি হলো সারা শরীরে বিশেষ করে গিরায় গিরায় ব্যাথা। আমার ক্ষেত্রে প্রথমে দুই হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যাথা হয়। মনে হচ্ছিল হাঁটু ভেঙে গেছে। তিন থেকে চার দিন লাগলো , হাঁটুর ব্যাথা কমতে।  কমলেও একেবারে সেরে গেল না। সেই ব্যাথা ওপরে চলে গেল গলার কন্ঠা এবং কনুইয়ে। তার পর নিচে নেমে গোড়ালিতে। সে ব্যাথা প্রচন্ড ব্যাথা। ধীরে ধীরে এসব ব্যাথা কমতে থাকে। কমতে কমতে  একটি জায়গায় গিয়ে সেটি বাসা বাধে। ২৭ বছর আগে আমার ফিমার নেক ভেঙে যায়। এখনো  লম্বা দুটি স্ক্রু দিয়ে সেটি  জোড়া লাগানো আছে। অর্থপেডিক্সের ডাক্তার সাহেবরা বলেন যে, যদি কারো কোনো বাতের ব্যাথা থাকে, গেঁটে বাত থাকে অথবা হাড়হাড্ডির ভাংগা চ‚রা থাকে এবং সেখানে স্ক্রু লাগানো থাকে তাহলে সেখানে চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুর মতো ব্যাক্টেরিয়া কলোনি বানায়, অর্থাৎ সেখানে বাসা বাধে। এই কথাটিই আমাকে বললেন পঙ্গু হাসাপাতালের সাবেক পরিচালক অর্থপেডিক্স সার্জন ড. সামাদ। তিনিও  প্যারাসিটামল জাতীয়  ঔষধের ওপর অন্য কিছু প্রেসক্রাইব করলেন না।
\তিন\
এখন আমি অনেকটা সুস্থ। তবে সময় গেল ২০ দিন। কিন্তু এই ২০ দিন ধরে ডাক্তার কবরেজদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করে একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমি  অর্জন করেছি। এই চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু নিয়ে আমি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের কনসালটেন্ট ড. হামিদের কাছে যাই। সেখানে গিয়ে একটি অবাক করা তথ্য জানতে পারি। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে কিডনীর  ডাইলাইসিস করা হয় মাত্র দেড় হাজার টাকায়। অথচ, একই ডাইলাইসিস অন্য হাসপাতালে করা হয় কম করে হলেও ৫ হাজার টাকায়। কোনো কোনো হাসপাতালে ৮ হাজার টাকাতেও করা হয়। এর অর্থ হলো,  মানবতা বলে সব রকম কনসেপ্ট বাংলাদেশের মেডিকেল সায়েন্স থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। যার যেমন ইচ্ছা  তিনি তেমন ফি নিচ্ছেন।
অনেকের নিদ্রাজনিত নানান রকম সমস্যা রয়েছে। নিদ্রাজনিত একটি রোগের নাম স্লিপ অ্যাপনিয়া। স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগ সারানোর জন্য রোগীর স্লিপ টেস্ট করতে হয়। স্লিপ টেস্ট নিয়েও আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। যখন প্রফেসর ডা. রাশেদুল হাসান বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন তখন আমি স্লিপ টেস্ট করানোর জন্য সেখানে নাম লেখাই। ফি বাবদ জমা দেই  ২০০০ টাকা। সেটাই তাদের স্লিপ টেস্ট ফি। তবে যে রাতে আমার স্লিপ টেস্ট করার তারিখ ধার্য্য  ছিলো সেই রাতে অত্যন্ত জরুরি পারিবারিক কাজে আমাকে অস্ট্রেলিয়া যেতে হয়। আড়াই মাস পর ফিরে এসে পুনর্বার যখন টেস্ট করাতে যাই তখন দেখি ১ মাসের মধ্যে কোনো  ভ্যাকান্সি নাই। তখন আমি দুটো প্রাইভেট ক্লিনিকে বা হাসপাতালে যোগাযোগ করি। একটি ক্লিনিকে স্লিপ টেস্ট ফি  দাবি করে ১৪ হাজার টাকা। আরেকটি হাসপাতালে দাবি করে ১২ হাজার টাকা। প্রিয় পাঠক, একই টেস্টে দুইটি হাসপাতালে  কি আকাশ পাতাল তফাৎ। কোথায় ২ হাজার টাকা, আর কোথায় ১২ বা ১৪ হাজার টাকা। অনুরূপ ভাবে ডাইলাইসিসের ক্ষেত্রে কোথায়  দেড় হাজার টাকা, আর কোথায় ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা।
\চার\
প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এসব অরাজকতা আর কত দিন চলবে? সরকার সব সময় বলে যে তারা হেন কাজে ব্যাস্ত তেন কাজে ব্যাস্ত। কিন্তু  স্বাস্থ্য খাতে  এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারা কবে ব্যাস্ত হবে? ইতোপূর্বে আমি ইনকিলাবের এই কলামে বিদেশ এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার তুলনামূলক পর্যলোচনা তুলে ধরেছি। দেখিয়েছি সেখানে মানবতাই হলো চিকিৎসা সেবার মূল বিবেচ্য বিষয়। বিদেশে মানবতার কথা মুখে বলা হয় কম, কিন্তু কাজের বেলা হয় বেশি। আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। আমরা মুখে বকর বকর করি বেশি। কিন্তু কাজের বেলায়  অষ্টরম্ভা। আজকে শেষ করছি সেই বিখ্যাত কবিতা দিয়েঃ
    আমাদের দেশে হবে, সেই ছেলে কবে
    কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ